প্রগলভ রাজনীতি কি আদৌ সাবধান হবে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 12 August 2011, 08:06 PM
Updated : 14 Oct 2015, 04:26 AM

অদৃশ্যে বিশ্বাসী জাতির মতো রাজনীতিও দেখি অদৃশ্যেই বেশি আস্থাশীল। খালেদা জিয়া এখন দেশে নেই। বিএনপি অর্ধমৃত। তাদের দু চারজন সেকেন্ড ক্লাস নেতা ছাড়া বাকিরা 'আউট অব সিন'। মামলা-হামলা-স্বার্থের ভয়ে সামনে আসেন না; মুখও খোলেন না। যে দু-চারজন নড়াচড়া করেন তারাও রুটিনমাফিক একগাদা তারযন্ত্র আর সাংবাদিকের সামনে তোতার মতো বুলি আউড়ে যান। কেউ কেউ কাগজ দেখে পাঠ করেন। মাঠে-ঘাটে-রাস্তায় বিএনপির অস্তিত্ব নেই। আন্দোলনের নামে মারামারি, হানাহানি আর সন্ত্রাসের পর তারা বুঝে নিয়েছে, সে পথে কাজ হবে না। অন্যদিকে, জামায়াতের ছায়াসঙ্গী হবার মাশুলও চুকাতে হচ্ছে তাদের।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি বিএনপির জন্য নতুন। অনেক নাটকের পর খালেদা জিয়া এখন বড় পুত্র তারেকের কাছে লন্ডনে। সেখানে তিনি কী করছেন, আদৌ কোনো ছক কাটছেন কিনা সব কিছু অস্পষ্ট আর ধোঁয়াশা। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে খুন-খারাবির ঘটনা বেড়ে গেছে। এবারের টার্গেট বিদেশিরা। এটা বুঝতে খুব বেশি মেধার দরকার পড়ে না যে, কেন তারা টার্গেট পাল্টেছে। দেশে যখন ভিত্তি নড়বড়ে আর জনগণকে সঙ্গে নেওয়া যাচ্ছে না তখন তো মুরব্বিই ভরসা।

আমরা ছেলেবেলায় কারও সঙ্গে শক্তি, যুক্তি বা কৌশলে না পারলে তাদের অভিভাবকদের কাছে 'বিচার' দিতাম। বিএনপি যেন তেমন বালসুলভ আচরণে ব্যস্ত। তারা যাবতীয় বিদেশি দূতদের কাছে ধর্ণা দিয়ে নালিশ জানিয়ে ব্যর্থ হবার পর এখন যদি এমন চোরাগোপ্তা হামলায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, অবাক হবার কিছু থাকবে না তাতে। তাছাড়া পরিকল্পিত খুনের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকাটাই স্বাভাবিক।

যে কথা বলছিলাম, খালেদা জিয়া প্রবাসে, বিএনপি হতোদ্যম, তারপরও দেশের সরকারপ্রধান বলছেন, তিনিই এসব ঘটনার পেছনে সক্রিয়। তাই যদি হয়, তবে তো মানতে হবে যে, খালেদা জিয়ার হাত অনেক লম্বা। তিনি লন্ডনে বসেও দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন। আর সরকার যখন তা জানেই, তাহলে নিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের করণীয় কী? তারা কি এগুলো দমনে কঠোর হচ্ছেন? আগামীতে কি আমরা এর অবসান দেখতে পাব? না, অতীতের মতো ধারাবাহিক দোষারোপ প্রক্রিয়া ও কথার ভিড়ে বিচার বা শাস্তি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে?

আওয়ামী শাসনের বড় দুর্বলতা তাদের কথার চোটপাট। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কথার জন্য এই দলের নেতাদের ওপর তিতিবিরক্ত। সেটা আজ থেকে নয়। পটল নামের এক যুবনেতা বহুকাল আগে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেত্রীর জিভ উপড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়ে্ছিলেন– প্রকাশ্য জনসভায়। সে ফজলুর রহমান পটল বহু আগেই রাজনীতি থেকে পটল তুলেছেন। সেদিনের জনসভায় তাকে দিয়ে আসলে বলানো হয়েছিল কথাগুলো।

মঞ্চে উপবিষ্ট তখনকার আপোসহীন নেত্রী বেগম জিয়া সে অশ্লীল আক্রমণ উপভোগ করে মিটিমিটি হাসছিলেন। নিজে কিছু না বললেও এসব আক্রমণের মজা নিতেন 'একশ পার্সেন্ট'।

আওয়ামী লীগের কেউ তাতে ধৈর্য বা সহিষ্ণুতা দেখাতে পারেননি। শীর্ষ পর্যায় থেকেই হুঙ্কারের শিকার হয়েছিলেন পটল। খালেদা জিয়া এসব বিষয়ে সব সময় এগিয়ে। আমাদের দেশ ও সমাজের 'পালস' বা নাড়ি বোঝার জায়গাটা দীর্ঘকাল ধরে রাখতে পারার কারণে 'ফলস' রাজনীতি আর আদর্শহীন দল হবার পরও বিএনপি ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে শাসনে অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছিল। তাদের পতনের পেছনে আওয়ামী লীগের যতটা কৃতিত্ব তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী তাদের কুকর্ম আর তারেক রহমানের ভূমিকা।

আজ যখন দেশের পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা চলছে তখন শাসক দলের কাছ থেকে মানুষ কী চায়? কী তাদের কামনা? খালেদা জিবার মতো গতায়ু নেতাকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নেওয়ার কি আসলে প্রয়োজন রয়েছে? মানুষ চোখে দেখছে উন্নয়নের এক ধারা তার আপন গতিতে সামনে চলেছে। এই ধারায় মানুষের আয়-উপাজর্ন বাড়ছে; মানুষ আগের মতো অস্বচ্ছল নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতেও এখন টাকা-পয়সার অভাব নেই। এত সব অগ্রগতির পরও চাপা কষ্ট আর বেদনার দিকটা এড়ানো যাবে না।

মানুষ কেন বিরক্ত বা অখুশি সে জায়গাটা আওয়ামী লীগের নেতারা খুঁজে দেখেন না। বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের পর থেকে তাদের রাজনীতিতে একদিকে যেমন উগ্র কথার আধিক্য, আরেক দিকে যা খুশি বলার প্রবণতা। যেবার শুধু ভাষণের কারণে ভোটে পরাজয় মানতে হল, তারপর প্রয়াত মেয়র হানিফ সাহেব প্রথম ভুল স্বীকারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে তার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরই তারা সে কথা ভুলে আবারও কথার প্রেমে উগ্র হয়ে পড়লে শাসনভার চলে যায় বিএনপির কাছে।

এখন বিএনপির জায়গাটা নড়বড়ে। মানুষ দেখছে দেশে আসলে সাচ্চা কোনো বিরোধী দল নেই। কথিত বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ মূলত অকার্যকর। আর এরশাদ সাহেব একদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, আরেক দিকে বিরোধিতার নামে মানুষ হাসানোর কাজে ব্যস্ত। গণতন্ত্রে 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' বলে যে বিষয় তার নমুনা নেই রাজনীতিতে।

এতে কিন্তু সরকারি দলেরই লোকসান বেশি। তাদের ভালো কাজ যেমন জনগণের সামনে আসতে পারে না, তেমনি ভুল সংশোধনের জায়গাটাও সংকুচিত হয়ে পড়ে। ব্যক্তিজীবনের মতো সমাজ বা দেশের রাজনীতিতে একপেশে খেলাধুলার পরিণাম শেষতক ভালো হয় না। রাজনীতি বিজ্ঞান বলে, All power corrupts, absolute power corrupts absolutely– বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সন্তানদের বেলায় আমাদের যে বিশ্বাস, আস্থা আর ভরসা, সেটা যেন বজায় থাকে সে কারণেই এ ব্যাপারে মনযোগী হয়ে ওঠা প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগের মতো দল ক্যাডারভিত্তিক দল নয়। তাছাড়া আমাদের দেশে ক্যাডার পলিটিক্সের গোড়াই এখন নড়বড়ে। বাম হয়ে গেছে ঘোর ডান, ডান হয়ে গেছে উগ্র, কেউ এখন অন্ধ, কেউ-বা ঝাপসা দেখে পথ চলতে পারে না। সেখানে বহুমত ও পথের দলগুলোতে ঘোর আদর্শিক মানুষ বা নেতা মেলাটা অস্বাভাবিক। যে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা আর প্রশ্নাতীত দেশপ্রেমের পরও নানা কারণে মানুষের মনে অনাস্থা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য যার বেশিরভাগই তাঁর অজান্তে ঘটে।

ঘটান কিন্তু দলের নেতা বা মন্ত্রী-মিনিস্টাররা। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষের মনে আর মুখে এখন এক কথা বা এক চিন্তা নেই। তাদের মন ও মুখের ভিন্ন ভাষা বোঝার জায়গাটা অন্ধকারে ঢেকে আছে। তাদের আশা ও পাওয়ার ভেতরেই বেড়ে উঠছে অন্য এক অখুশি দানব। সে দানবের নাম জঙ্গি। সে দানবের নাম অনাচার, গুম বা অন্য কিছু। এই অবস্থায় দেশে যখন বিদেশিরা খুন হচ্ছেন, তখন লন্ডনে থাকা খালেদা জিয়াকে টেনে আনা বা প্রমাণহীনভাবে তাকে দায়ী করার ব্যাপারটা প্রকারান্তরে তাঁকে শক্তিশালী করছে।

তিনি কিন্তু এখনও কৌশলে কথা বলছেন। ভাঙন ধরানোর উদ্দেশ্যে বা যে কারণেই হোক না কেন, বললেন, আগামীতে সরকারগঠনে তারা নাকি আওয়ামী লীগ থেকেও কাউকে কাউকে নেবেন। এই খবরে আওয়ামী লীগের বঞ্চিত বা হতাশ নেতাদের শরীরে এক ধরনের শিহরণ বয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। সেটার যোগ্য প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল না। উল্টো শুনলাম, 'আসল ফালু ফেলে শত্রুদলে ফালু খোঁজার' মতো রসিকতাপূর্ণ মন্তব্য। মানুষের মনে এর কেমন প্রভাব পড়তে পারে বলে বোঝাতে হবে?

সরকারের অর্জন কম নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা বা শক্তিও প্রশ্নাতীত। তারপরও কিন্তু আওয়ামী রাজনীতি তেমন পপুলার নয়। যার মূল কারণ তাদের প্রগলভতা। বিনয় এমন এক ঔদার্য যা দীর্ঘ সময় ধরে ফল দেয়। প্রকৃতি জানায়– কিছু দিতে না পারার ক্যাকটাস বা ফণিমনসাই লকলক করে ওপরের দিকে ওঠে– আর ফলভারে নত হওয়াটাই দরকারি গাছের স্বভাব।

আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাই বাল্যপাঠে সাবধান করে দিয়েছেন যেন আমরা স্বীয় জিহ্বা শাসনে রাখি। চাইনিজ প্রবাদে আছে, 'তলোয়ার-কামানের চেয়েও ধার কয়েক ইঞ্চির জিভ'। আওয়ামী লীগের নেতারা শাসনে গেলে তা ভুলে যান।

এটা তাদের যত না ভোগায় তার চেয়ে বেশি ভোগায় আমাদের। যাদের জীবনে জঙ্গিবাদ অভিশাপ, যাদের কাছে বিএনপির রাজনীতি মানে হঠকারিতা, যারা জানে বাম মানে গ্লাসনস্তের নামে দামি দোকানে গ্লাস নষ্ট করা, তাদের জন্য এর চেয়ে উদ্বেগের আর কিছু নেই। কিন্তু তারা কি কথা শুনবেন না বলতেই থাকবেন! কবিগুরু বেঁচে থাকলে হয়তো আবারও লিখতেন, 'আমার এই কথা বলাতেই আনন্দ'।

রাজনীতি কিন্তু ক্রমেই তার আসল চেহারা আর পথ হারিয়ে কথানির্ভর হয়ে পড়ছে। এটা সুস্থতা বা স্বাভাবিকতার পরিচায়ক নয়।

অজয় দাশগুপ্ত: কলামিস্ট।