শিল্প, পরিবেশ, রাজনীতি: কোনটা আগে?

গাজী
Published : 25 April 2017, 06:35 PM
Updated : 25 April 2017, 06:35 PM

অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলা চলছে চামড়া শিল্পকে নিয়ে। কতিপয় চিহ্নিত মহল ঠাণ্ডা মাথায় এই শিল্পটিকে ধ্বংস করার মঞ্চ তৈরি করছে। এই শিল্পের সাথে জড়িত সবাই তাদেরকে চিনে কিন্তু কোন এক মায়াবী হাতের ছোঁয়ায় কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না। এই ছোট্ট কিন্তু প্রভাবশালী একটা মহল চামড়া শিল্পের সাথে জড়িত লক্ষ্যাধিক ব্যাবসায়ী ও শ্রমিকের, এমনকি কিছু সংখ্যক ছোট ট্যানারী মালিকের ভাগ্য নিয়েও খেলছে।

সরকার-
সাধারণভাবে বলা যায় বিসিক হলো সরকার, মানে শিল্প মন্ত্রণালয়। সচিব মহোদয় টিভি সাক্ষাৎকারে বলছেন ইটিপি প্রস্তুত না এবং খুব তাড়াতাড়ি প্রস্তুত করে দিবেন এবং চীনা সামগ্রী নিম্নমানের তাই চীনা কোম্পানীকে শাস্তির আওতায় আনবেন। অথচ তাদের তত্ত্বাবধানেই ১৮টি বৃহৎ কন্টেইনার ভর্তি সেই নিম্নমানের ইটিপি সামগ্রী চিটাগাং পোর্ট থেকে খালাশ হয়ে গভীর রাতে ঢাকার আশেপাশে অবস্থান নেয় এবং সুযোগ বুঝে হেমায়েতপুর চামড়াপল্লীতে ঢুকে পরে। মাননীয় সচিব মহোদয়ের সাপ্তাহিক ছুটির দিনের দৌড়ঝাঁপেই ট্যানারী মালিকদের সন্দেহ হয় কিছু একটা হচ্ছে। তাই আজ সোমবার চামড়া ব্যাবসার সাথে যুক্ত সবাই সকালেই হাজির হয় হেমায়েতপুরে এবং সেই অনুপযুক্ত ১৮ কন্টেইনার ইটিপির সামগ্রী হেমায়েতপুরে আটকে দেয়।  ব্রাভো!

পরিবেশবাদী –

এতেই প্রমাণ মিলে চামড়া ব্যাবসায়ীরা প্রো-এক্টিভ, পরিবেশবাদীদের মত রিঅ্যাক্টিভ না। তারা পরিবেশ বজায় রেখেই ব্যবসা করতে চায়, দেশেকে সমৃদ্ধ করতে চায়। হাজারীবাগের চামড়া ব্যবসায়ীরা হয়তো পরিবেশবাদীদের মত পিএইচডি ডিগ্রিধারী উচ্চ শিক্ষিত না কিন্তু জ্ঞ্যানে কোন অংশেই কম না। পরিবেশবাদীদেরই জানা উচিত ছিল তুরাগ বা ধলেশ্বরী ধ্বংস করতে কবে কখন সেই নিম্নমানের সামগ্রী ঢাকায় প্রবেশ করলো এবং সামনে থেকে কে সেটাকে পরিচালিত করলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের কেউ সেখানে ছিল না। হতে পারে আজ শনিবার না, কারণ ওনারা 'Saturday Party' নামে সমধিক পরিচিত। এখনো সময় আছে পরিবেশবাদীরা যদি সত্যিই দেশের এবং বুড়িগঙ্গা নদীর কথা চিন্তা করে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প 'উচ্ছেদ' করে থাকেন, তাহলে এই শিল্পের সাথে জড়িতদের পাশে দাঁড়ান, তারাও এখন তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদী রক্ষা করতে বিসিকের তথা শিল্প মন্ত্রণালয়ের লুকোচুরির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। '৭২ ঘণ্টার' নোটিশদাতাকে আদালতে তলব করেন, এই চালানের সাথে সরাসরি বড় ধরনের দুর্নীতি জড়িত। এখন যদি তাদের পাশে না দাঁড়ান তাহলে আপনারাও 'চামড়া শিল্প উচ্ছেদকারী' হিসাবেই সমাজে ঘৃণিত হবেন যেমন ঘৃণিত হয় রাজাকার মতিউর রহমান নিজামি পাটশিল্প ধ্বংসের জন্য। ইতিহাস আপনাদেরকে এখনি লিখতে হবে, আপনারাই ঠিক করবেন কোথায় থাকবেন আপনারা।

শ্রমিক –

চামড়া ব্যাবসা একটা বৃহৎ শিল্প, দেশের ২য় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্য। এটা শুধু ট্যানারি মালিক, ব্যবসায়ী অথবা শ্রমিক কারো একক অবদানে এই পর্যন্ত আসে নাই। ট্যানারি মালিকেরা ধানক্ষেত থেকে শ্রমিক ধরে এনে ট্যানারিতে কাজ করাতে পারবেন না এইটা যেমন সত্য তেমনি শ্রমিকেরাও কাজ হারাবেন যদি ট্যানারী না থেকে। এখন সময় হলো সবাই কে একসাথে বর্তমান সমস্যা মোকাবেলা করা। এখানে যেন কোন 'মধ্যসত্ত্বভোগী' ব্যাক্তিগত সুবিধা না নিতে পারে শ্রমিকদের ব্যবহার করে। এখন 'মালিকের চামড়া, তুলে……' টাইপের শ্লোগানের সময় না বরং সময় হলো মালিকদেরকে বুঝানো যে আপনারা ছাড়া হেমায়েতপুরেও তাদের চলবে না কারণ আপনারাই এই কাজে সবচেয়ে যোগ্য ও দক্ষ, আপনারা তাদের সুসময়ে ছিলেন, আজকে দুঃসময়েও আছেন। আগামী কোরবানিতে কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়ার জন্য আপনাদেরকেই ডাকতে হবে, ট্যানারী মালিক নিজে লবণ দিবেন না। হেমায়েতপুরে খেলার মাঠ, হাসপাতাল, স্কুল, বিনোদনকেন্দ্র ইত্যাদি দেয়ার দায়িত্ব সরকারের, ট্যানারি মালিকদের না, এইটাও আপনারা বুঝবেন। সুতরাং বিভেদ সৃষ্টিকারীদের থেকে সাবধান থাকেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প নগরী গড়তে ট্যানারি মালিকদের সহায়তা করুন।

ট্যানারি মালিক –

ট্যানারী মালিকদেরও উচিত শ্রমিকদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। আপনার আজকের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের জন্য আপনার শ্রমিকের অবদান সবচেয়ে বেশী। ট্যানারী বন্ধ হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় আপনি তাকে বাড়িতে চলে যেতে বলতে পারেন না। এরা আদমজীর শ্রমিকের মত না, এরা আপনাদেরই গ্রামের লোকজন, কেউ কেউ আছেন যারা ট্যানারী মালিকেরও আত্মীয়। এরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী, যে কোনো কাজ খুঁজে নিতে পারবে। আপনি কিন্তু আজকেই নতুন কাউকে এনে আপনার কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়াতে পারবেন না। তাই এই দুঃসময়টা তাদেরকে সাথে রাখুন তারা সবসময় আপনাদের সাথে থাকবে। আর এটাও সত্য শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করে মালিক কিন্তু মালিক-শ্রমিক এই দুইয়ের মধ্যে যখন 'অ-শ্রমিক শ্রমিকনেতা' ঢুকে যায় তখনই শ্রমিকদের ভাগ্য ঝুলে যায়। এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের প্রয়োজনই পড়তো না যদি আপনারা শ্রমিকদের দিকে সুদৃষ্টি দিতেন।

রাজনীতি-

হাজারীবাগের বর্তমান সমস্যার জন্য রাজনীতির একটা বড় ভূমিকা আছে। চলমান চামড়া শিল্প বাঁচাও আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্রগামী এবং এলাকায় প্রচণ্ড জনপ্রিয় ট্যানারস এসোসিয়শনের চেয়ারম্যান জনাব শাহীন আহমেদ ছাড়া নেতা পর্যায়ের প্রায় অনেকেই সরকারি দলের বিভিন্ন পদ-পদবীতে ভারাক্রান্ত। ট্যানারি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আদালতে আইনজীবীর ভূমিকাতেও এই এলাকার আওয়ামী লীগের মাননীয় সংসদ সদস্য। সব আন্দোলনেই যেমন ষড়যন্ত্রকারী থাকে তেমনি চামড়া শিল্প বাঁচানোর আন্দোলনেও কারো কারো "ভিন্ন-চিন্তা" থাকতে পারে, আশ্চর্যজনক ভাবে তারাও সরকারই দলের বড় সাইজের নেতা। তাই একটা আন্দোলন পরিষদের দুইজন কো-চেয়ারম্যান থাকেন এবং আন্দোলনটাকে কোন ভাবেই জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এর বাইরে নিয়ে যেতে পারে নাই। হকাররাও আজকাল তাদের সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপির দেয়ার মাধ্যমে পেশ করে। কিন্তু  'চামড়াশিল্প ধ্বংস ঠেকাও' আন্দোলন জিগাতলার বাইরে নিয়ে যেতে পারলো না আমাদের একজন ব্যবসা বান্ধব, শ্রমিক বান্ধব নরম হৃদয়ের প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও। বিষয়টা যার কান পর্যন্ত গেলেই উনি নিজ উদ্যোগী হয়ে ব্যাবস্থা নিতেন সময় বাড়ানোর অথবা হেমায়েতপুরের সঠিক অবস্থা জানার। যেখানে শাহীন আহমেদ ট্যানারী মালিকদের এসোসিয়েশনের সভাপতি হয়েও এখন এই সম্পূর্ণ সেক্টরের (এই শিল্পের সাথে প্রায় ২০টি সহযোগী) নেতা, সুউচ্চকন্ঠে কথা বলছেন শ্রমিক থেকে শুরু করে মালিক পর্যন্ত সবার স্বার্থ নিয়ে, সেখানে অনেক ট্যানারী মালিকই তার নিজের স্বার্থের বাইরে যেতে পারছেন না শুধু মাত্র রাজনীতিক কারণে। যদিও তাদের সেই ক্ষমতা ব্যাবহার করে নিজেদেরকেও রক্ষা করতে পারেন নাই, তাদের ট্যানারিও আজ অন্ধকার! কিন্তু সম্পূর্ণ চামড়া সেক্টরে আজ আলোকিত নাম শাহীন আহমেদ।

শিল্প বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে, শ্রমিক বাঁচলে মালিক বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। কেউ কাউকে ছাড়া নয়। সুতরাং কোন ষড়যন্ত্র না বরং সবাই এক হয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করুন অনেকেরই এইটা পূর্বপুরুষের ব্যাবসা, রাজনীতিকে আপাতত দুরে রেখে এই শিল্পকে রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।