ঈদের যাত্রা ‘ঘরমুখো’, নাকি ‘হাসপাতালমুখী’?

রাশিদুল রাশেদ
Published : 14 Feb 2012, 08:56 AM
Updated : 20 July 2021, 04:09 PM

বড় সংকটময় সময়ে এসেছে এবারের কোরবানির ঈদ। এ উৎসব এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন সারাদেশে মহামারী কোভিড-১৯ এর ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস ভাইরাস ধরন অতিমাত্রায় সংক্রমণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর থাবায় জেরবার বিভিন্ন জেলা।

গত দশ-বারো দিন যাবত সরকারি তথ্য মোতাবেক আক্রান্তের হার প্রতিদিন দশ-বারো হাজার। প্রতিদিন মৃত্যুও প্রায় দুইশরও বেশি। গত কয়েক দিন আগের একটি পরিসংখ্যানে এসেছে কোভিড-১৯ এর ডেল্টা এবং ডেল্টা প্লাস ধরনে দৈনিক শনাক্তে এশিয়ায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ, বিশ্বে চতুর্থ!

দু;খের বিষয়, এতো শনাক্ত এবং মৃত্যুর মিছিলের মাঝেও ঈদ উৎযাপনে বাঙালির মধ্যে কোনও ইতস্তত দেখা যাচ্ছে না। কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সরকার কর্তৃক ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস ধরনের সংক্রমণ কমাতে লকডাউন কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। এ মুহূর্তে যা বিষ্ময়কর, হতাশারও।

এ যাত্রা ডেল্টা সংক্রমণের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের দেওয়া লকডাউন প্রশাসনের বেশ কড়াকড়ি ছিল। জনগণও নানা বিধিনিষেধ সে কারণে মানতে বাধ্য হচ্ছিল। যাতায়াত ও লোকসমাবেশ সীমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে হঠাৎ লকডাউন কর্মসূচি স্থগিত করায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও পরামর্শকরা আশ্চর্য হওয়ার পাশাপাশি বিব্রতবোধ করছেন। কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গণমাধ্যমে রীতিমত প্রতিবাদের সুরে কথা বলেছেন। লকডাউন উঠিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত মোটেই বিজ্ঞানসম্মত হয়নি বলে মন্তব্যও করেছেন জোরালোভাবে।

হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এরই মধ্যে আশঙ্কা জানিয়ে বলেছেন, "ঈদ উদযাপনের জন্য এখন মানুষ ঘরমুখো, ঈদ পরবর্তীতে হাসপাতালমুখো হবে।" তিনি আরও বলেন, "করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য আমরা যেসব স্থানকে অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন ও গণজমায়েত। এবারের ঈদযাত্রা কেন্দ্র করে এই দুইটি বিষয়ই চূড়ান্তভাবে ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে ভিড়, গাদাগাদি অবস্থা, গণপরিবহন বা অন্য পরিবহনে মানুষ ঠাসাঠাসি করে যাত্রা করার ফলে এসব স্থানে করোনা সংক্রমণের জন্য অতি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে আমরা আশঙ্কা করছি, ঈদের পরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার দ্রুত বেড়ে যেতে পারে এবং সেই বেড়ে যাওয়াটা আমাদের হাসপাতাল ও অক্সিজেনের যে সামর্থ্য সেটাকে অতিক্রম করতে পারে।" একই কারণেই রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও সম্প্রতি বলেছেন, "এবারের ঈদযাত্রা হচ্ছে আত্মহত্যার শামিল।"

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হজ। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে সৌদি আরবের সরকার গত দুই বছর সে হজই সীমিত আকারে পালন করে আসছে। কিন্তু সেখানে বাঙালি কোরবানির ঈদ উৎযাপনে গাদাগাদি করে, জ্যাম-ভিড় ঠেলে বাড়িতে ফিরছে এবং হাটে গিয়ে বিভিন্ন পশু কিনছে কোরবানির জন্য। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির মানার বালাই নেই বললেই চলে। তাহলে এই ঈদযাত্রা কি মৃত্যু পথযাত্রা হয়ে যাচ্ছে না? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের বহুল আলোচিত কুম্ভ মেলার কথাও। যেখানে জীবনের মূল্য উপেক্ষিত হয়েছিল ভীষণভাবে।

আমরা ইতিমধ্যে ভারতসহ পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে এরকমই সংকট দেখেছি। ভারতে মহামারী কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত হাজার হাজার লাশ নদীতে ভাসতে দেখেছি এবং শত-শত লাশের গণকবর দিতে দেখেছি। ঘণ্টা বাজিয়ে, নদীতে দুধ ঢেলে, গো-মূত্র পান করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে আটকানোর অবৈজ্ঞানিক পথেও হাঁটার ফল হিসেবে প্রতিবেশি দেশটিতে মৃত্যুর মিছিলও আমরা দেখেছি। 

কিছুদিন আগে ইউরোপের মানুষ ইউরো ফুটবল-২০২০ দেখার জন্য স্টেডিয়ামে জমায়েত হয়েছিল। সেটা ভেবে কোন অজুহাত দেখানোর সুযোগ নেই। কেননা তাদের বেশিরভাগই কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকেছিল। সেখানকার বেশিরভাগ দেশেই ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ভ্যাক্সিন নিয়েছেন। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হয়তো ৫ শতাংশ মানুষও টিকা নিতে পারেননি। রাষ্ট্রীয়ভাবে টিকা কার্যক্রম যতটুকু করা হয়েছে, তা যথেষ্ট অল্প। গণহারে কোভিড-১৯ এর টিকা কার্যক্রম এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। ওরা আনন্দ করেছে খেলা দেখার মাধ্যমে, আমরা আনন্দ করবো ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে- এমনটি ভাবার কোনও সুযোগ নেই। কেননা এমনটি ভাবা চরম বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

চরম আশংকার বিষয় যে, এই জনপদ ইউরোপের মতো নয়, প্রতিবেশি ভারতের মতোই ঘনবসতিপূর্ণ। তাই কোভিড সংক্রমণ বা ট্রান্সমিশনের হার দ্রুত বাড়তে পারে। তখন নিরুপায় হবেন আপনি, আমি এবং রাষ্ট্র। অবশ্য আমি এ ধরনের সংকট হওয়ার জন্য দায়ী করবো বাঙালি মননের।

জীবন সবসময়ই উৎসবে মেতে উঠবে, তা কিন্তু মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। কিছু সময় ভোগ করা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়, ভোগ পরিহার করতে হয়, না হলে উল্টো দুর্ভোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। তবুও আশা করব কোন জীবন যেন দুর্ভোগের শিকার না হয়। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে ও অন্যকে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচান। না হলে আপনাকে অথবা আপনার খুব কাছের কাউকে কোভিড-১৯ ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস ধরনের কারণে ভয়াবহ মৃত্যুও ভোগ করতে হতে পারে।

ঈদ পরে  যদি কোভিডের ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস ধরনের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে সংকট হবে- হাসপাতালের, আইসিইউয়ে, অক্সিজেনের, ডাক্তার এবং নার্সের। এমনকি মৃতের লাশ সৎকারে নিয়োজিত মানুষের সংকটও হতে পারে। রীতিমতো স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়তে পারে। অবশ্য আমরা ইতিমধ্যে যশোর, খুলনা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ হাসপাতালে দেখতে পাচ্ছি। সেখানে রোগী রাখার জায়গা নেই, পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই, অক্সিজেন সংকট। এসব সংকটের কারণে প্রতিদিন বহু মানুষ এসব হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করছে।

বাংলাদেশের মানুষ বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। আর সে স্বর্গে ঈদ উদযাপনের হিড়িক লেগেছে লকডাউন সাময়িকভাবে স্থগিতের মাধ্যমে। এখন ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস সংক্রমণের জন্য ঈদের পরে এ উৎসবমুখী মানুষগুলোকে যদি হাসপাতালমুখী হতে হয়, তবে সেটা হবে রাষ্ট্রের জন্য তীব্র সংকট। বরাবরের মতো প্রশ্নটাও থেকে যাবে- চারদিকের মৃত্যু মিছিল, স্বজন-প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ দেখে আমরা কতটুকু শিখলাম?