তিন বছরে জাবি ভিসির ভালবাসা

আধার রাতের জোনাকি
Published : 3 May 2012, 06:08 PM
Updated : 3 May 2012, 06:08 PM

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণ করেন জাবি উপচার্য শরিফ এনামুল কবীর । ৩টা খুঁটি আখড়ে ধরে শত অনিয়ম করেও বসে থাকার শক্তি পাচ্ছে । প্রথমত, তিনি 'পিওর' আওয়ামী লীগার। সম্ভবত তার আগে নিয়োগপ্রাপ্ত খুব কম উপাচার্যই, তার মতো সক্রিয় ও বিশ্বস্ত আওয়ামী লীগার ও সাবেক ছাত্রলীগার ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। তৃতীয়ত, তিনি বর্তমান সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা, জাবির সাবেক উপাচার্য ড. আলাউদ্দিন আহমেদের বিশেষ 'অনুগামী'। আলাউদ্দিন আহমেদ যখন জাবি'র উপাচার্য ছিলেন, তখন বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। উল্লেখিত এই তিন খুঁটির জোরে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন ভিসি শরীফ এনামুল!

ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি চোখ দেন তাদের উপর যারা সাধারন শিক্ষার্থীদের কথা বলেন ক্যাম্পাসের সাংবাদিক ছাত্রদের উপর । মাওলানা ভাসানী হলে 'পানিবাহিত রোগে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি শীর্ষক নিউজ করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক মাহফুজুল হককে শোকজ করা হয়।মে মাসে ভিসির মদদে অর্থনীতি বিভাগে ছাত্রলীগ ক্যাডার শামীমের হাতে নির্যাতনের শিকার হন কালের কণ্ঠের সাংবাদিক ইমনসহ ৪ সাংবাদিক ।এর কয়েকদিন পর সোহেল-জনি গ্রুপের ক্যাডারদের হাতে তৎকালীন সাংবাদিক সমিতির সভাপতি রেজাউল হক কৌশিকসহ ৭ সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন। ডিসেম্বর মাসে সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৪ সাংবাদিক লাঞ্চণার শিকার হন ।এছাড়াও তার অপকর্মের কথা প্রকাশ করায় বিভিন্ন ভাবে হুমকির শিকার হন সাংবাদিকরা,ছবি উঠাতে গেলে তিনি নিজেই এক সাংবাদিককে ধমক দেন । শুধু তাই নয় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তিনি সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তার অনুগত পোষা সাংবাদিক দিয়ে তার অপছন্দের সাংবাদিকদের লাঞ্চিত করেন ।

শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ রাখতে এবং নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে গঠন করেন ভিসিপন্থী নামে পরিচিত ছাত্রলীগ।ছাত্রলীগ না আসলে পেটোয়া বাহীনি ।২০০৯ সালের ১৯মে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশেদুল ইসলাম শাফিনকে সভাপতি ও নির্ঝর আলম সাম্যকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু উপাচার্যের এলাকার সাগর, শামিম, প্রিতম পদ বঞ্চিত এবং পারভেজ ছোট পদ পাওয়ায় তিনি এ কমিটিকে মেনে নিতে পারেননি। আওয়ামীলীগের বড় বড় নেতার কাছে গিয়ে কমিটিতে ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে উপাচার্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তার মদদে করে ২৩ মে রাত তিনটার দিকে মওলানা ভাসানী হলের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক সরকার মোঃ আজগর আলী গ্রুপের জুনিয়র কর্মীরা ডিকেন গ্রুপের উপর হামলা চালায়। সংঘর্ষের ঘটনায় ডিকেন সহ প্রায় ১০ নেতা-কর্মী মারাত্মক আহত হয়। এ ঘটনায় যুগ্ম-সম্পাদক আজগর আলীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জাবি শাখা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হলেও ভিসির সাহায্যে সে ক্যাম্পাসে মাথা উচু করে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে ।

আর তাই অবশেষে তার প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে ৫ জুলাই আল বেরুনি হলে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় ৭/৮ জন গুলিবিদ্ধসহ ৫০ জনেরও বেশি আহত হয়। উভয় পক্ষে ৩০ রাউন্ড গুলি বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। এ সংঘর্ষের জের ধরে উপাচার্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ২ বছর এবং ৬ জন আজীবনসহ আরো ১৩ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে বিতাড়িত করে নিজের এলাকার পছন্দের ছাত্রদের দিয়ে একটা দল গঠন করেন । আর সেই দল ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ভাবে লাঞ্চিত করছে ইভটিজিং,ছিনতাই, চাঁদাবাজি তাদের নিত্য দিনের কাজ হয়ে দাড়িয়েছে ।সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে মিছিলে নেয়া, ভিন্ন মতের ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিভিন্ন সময় মারধর করলেও ভিসি চোখ বুজে থাকতেন।

সংস্কৃতির রাজধানী নামে খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম সারা দেশে পৌঁছে দিতে সমর্থ এবং যাদের প্রচেষ্টায় ক্যাম্পাস হতে শিবিরকে বিতাড়িত করা হয় অথচ সেই সাংস্কৃতিক কর্মীদের আজ শিবির হিসেবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিভিন্ন সময় তার পেটোয়া বাহিনী দ্বারা নির্যাতন করেন। ২০১১ সালে তার বাহিনী মুক্ত মঞ্চে হামলা করে আহত করেন সাংস্কৃতিক কর্মীদের কিন্তু এর কোন সুষ্ঠু বিচার তিনি করেননি।সাংস্কৃতিক কর্মীদের দমানোর জন্য ধ্বনির কক্ষে আগুন লাগানো হয় প্রশাসনের মদদে। অবশেষে ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল ১১ দফা দাবিতে মিছিল করলে তার অনুগত অছাত্র সম্রাট,শাকিল,শরিফের নেতৃত্বে তাদের উপর হামলা করে। এতে গুরতর আহত হয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সহ আরও ৭ জন ।

গত ২০১১ সালের ১ জুন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হলে প্রশাসন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে গাছ কাটা শুরু করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গাছ কাটায় বাঁধা দিলে ওই দিন গাছ কাটা বন্ধ থাকে। পরে ক্ষুব্ধ হয়ে উপাচার্য নিজে উপস্থিত থেকে শুক্রবার সকালে পুনরায় গাছ কাটা শুরু করে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন অজুহাতে গাছ কাটা শুরু করে। ছুটির শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশের সামনে রাস্তার সড়কদ্বীপের পাশে ৫৬টি গাছ কাটার জন্য চিহ্নিত করে। প্রথম দিনে ৪০টি গাছ কাটার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে গাছ কাটা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন ছাত্র হলের ভেতরে ১৪টি বড় গাছ কাটতে শুরু করে প্রশাসন। এতে হলের ছাত্ররা বাধা দেয়। কিন্তু হলের রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের মুখ বন্ধ করে নির্বিঘ্নে গাছগুলো কাটা হয়েছে বলে অনেক ছাত্রই অভিযোগ করেছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, পুরান বড় বড় গাছ কেটে নতুন গাছ রোপন করলে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য যেমন বাড়বে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে কিছু অর্থও জমা হবে।বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং প্রশাসনের নিজের কোষাগারে অর্থ জমা করতে গাছ কাটা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে ।গাছ কাটার ফলে রোদে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন অনেক ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীরা।

এছাড়াও মেডিকেলের উন্নয়ন হবে বলে অর্থ বরাদ্দ হলেও তিন বছরে কোন পরিবর্তন হয়নি মেডিকেলের । শিক্ষার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত অ্যামবুলেন্স ।বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ পল্লী বিদ্যুৎ এর আওতায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বন্ধ করেন ।এ বিষয়ে জানতে গেলে তিনি জানান যেখানে সারাদেশে বিদ্যুৎ এর এত সমস্যা সেখানে শিক্ষার্থীরা এত বিদ্যুৎ দিয়ে কি করবে।

সম্প্রতি প্রথম বর্ষ ভর্তি ফি, এমএ ভর্তি ফি বাড়িয়ে দেন । অডিটেরিয়ামের ভাড়া সহ মুক্ত মঞ্চের ভাড়া বাড়িয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ নিয়োগ হয় তার আমলে।অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে ধ্বংস করেছেন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান দাম্ভিক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তমঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাড়ার পদ্ধতি চালু করেন তিনি। তার শাসনামলে কোনো ছাত্র কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে অতিথি-বক্তার নাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। রাত ১১ টায় ছাত্রদের হলগেট বন্ধ করার ফতোয়া দিয়েছেন তিনি। ছাত্রদের বাস ও রুটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। ডাইনিং চিরতরে বন্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা এনে নিজের কোষাগার বড় করছেন। উপাচার্যের বর্তমান বিত্ত-বৈভবের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কয়েকটি গাড়ির মালিক উপাচার্যের একটা গাড়ির দাম প্রায় কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গাড়ির তেলের যে বিল করেছেন, সেই তেলের হিসাব অনুযায়ী সেই গাড়িকে প্রতিদিন (ছুটির দিনসহ) গড়ে কমপক্ষে ৩০০ কি.মি. চলতে হয়েছে। এই ঘটনা থেকেই বর্তমান উপাচার্যের শাসনামলের দুর্নীতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

তিন বছরে এই ভিসি শুধু নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে আর পকেট বড় করতে ব্যস্ত ছিলেন।তাই সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগের দাবিতে ফুসে উঠেছেন। তার পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কিন্তু অনশনের ৪৮ ঘন্টা হয়ে গেলেও স্বৈরাচারী ,ক্ষমতা লোভী এই ভিসির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।অথচ এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন শিক্ষার্থীদের জন্য আমার মন কাঁদে। এই যদি হয় একজন উপাচার্যের ভালবাসার নির্দশন তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কি হবে????????????