চাপা আর্তনাদে মুখরিত মরুভূমি

কাওছার আহমদ
Published : 7 Jan 2015, 06:18 AM
Updated : 7 Jan 2015, 06:18 AM

বাংলাদেশী শ্রমিকদের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার ইউনাইটেড আরব আমিরাত। দেশের প্রবাসী রেমিটেন্সের অতুলনীয় একটা অংশ। যেখানে প্রায় ১০ লক্ষ বাংলাদেশীর বসবাস। কিন্তু বড়ই বেদনাদায়ক ও আক্ষেপন বিষয় হলো এদের লুকায়িত বুক চাপা আর্তনাদ, সুখ দুঃখ হাসি কান্নার খবরা-খবর নেওয়ার মত সংশ্লিষ্ট কারো নেই মাথা ব্যাথা।

আমাদের অনেক বাংলাদেশী ভাই বুক ভরা আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাড়ি জমান এই মরুভূমির দেশে। স্বদেশ থেকে যে কর্মস্থলে ভিসা নিয়ে আসেন সেখানেই পড়ে থাকতে হয় সবার। মালিকপক্ষের বিরূপ মন-মানসিকতা, কর্মদক্ষতা পর্যাপ্ত মান না পাওয়া, অসংখ্য অপমান আর ঘৃণার পাত্র হওয়া, এমন আর অনেক অনেক মর্মস্পর্শী উল্লেখ যোগ্য কারণে বদলি হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্তেও সম্বব হয়না তাদের।এর কারন বাংলাদেশী শ্রমিকদের উপর আমিরাত শ্রম মন্ত্রনালয়ের নিষেধাজ্ঞা। আর এই সমস্যায় জর্জরিত আজ লক্ষ লক্ষ অবাগা বাংলাদেশী শ্রমিক।

সত্যিই এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের কাহিনী খুবই করুণ। শহরের রাস্তায় বের হলে অবলোকন করা যায় কি পরিস্তিতিতে আছেন আমার দেশের সোনার ভাইয়েরা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিদিন তা সত্ত্বেওএরা পাচ্ছেন না কর্মের ন্যায্য পাওনা। সীমাহীন পরিশ্রম করার পরেও মাস শেষে অনেকে পাচ্ছেন না নির্ধারিত মজুরী, আর যারাও পাচ্ছেন তাঁদেরকে একেক মাসের বেতন দেওয়া হচ্ছে দুই তিন চার মাস পর পর। তার উপর অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর কষ্ট। অভিযোগ করলে দূরব্যবহারের সহিত বিভিন্ন টালবাহানা করা হচ্ছে মালিক পক্ষ থেকে, আবার বেশি চাপাচাপি করলে দেওয়া হচ্ছে দেশে ফেরত পাটানোর হুমকি। বিষয়টা দাঁড়িয়েছে এমন যে "থাকলে থাক আর না হয় রাস্তা মাপ"।

বেচারা শ্রমিক ভাইয়েরাই বা করবে কি! দেশ থেকে মা-বোন স্ত্রীর গহনা, ব্যাংক থেকে সুদে উত্তোলিত ঋণ, বাপের ভিটা বাড়ি এই সব বিক্রি করে পাড়ি জমিয়েছে এই পরবাসে। এখন না পারবে দেশে ফেরত যেতে আর না পারবে সহ্য করতে এত অবহেলা সমিত সীমাহীন কষ্ট। আর অবলা শ্রমিকদের এই দুর্বলতাটুকু নিজেদের সুযোগ হিসেবে খুব ভালো ভাবেই কাজে লাগাচ্ছে চতুর মালিকপক্ষ। ওরা জানে যে বাংলাদেশীর শ্রমিকদের জন্য নতুন ভিসা এমনকি মালিক পরিবর্তন বেবস্তাও বন্ধ।হয় কাজ করতেই হবে আর না হয় যেতে হবে ফেরত। আর দেশে যাওয়া তো এতো সহজ না এইটাও ওরা নিশ্চিত কারন শ্রমিকদের সকল দুর্বলতার খবর ওরা খুব ভাল করেই রাখে।

বিষয়টা সত্যিই খুব দুঃখজনক, কেউ যদি মাথার ঘাম পেয়ে ফেলে সারা মাস কাজ করে তার ন্যায্য পাওনাটুকু না পায় তখন আর কি বা করার থাকে! এর পরেও এরা বুক ভরা আশা নিয়ে পথ চেয়ে বসে আছেন কখন যে বদলি ভিসার বেবস্থা উম্মুক্ত হবে আর খুজে নিতে পারবেন নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ মত কাজ।

২০১২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয় আরব আমিরাত সরকার। সাথে যারা বর্তমানে আমিরাতে অবস্থান করছেন তাদের জন্যও বন্ধ করে দেওয়া হয় কর্মস্থল বদলির বেবস্থা (ভিসা ট্রান্সফার)। আজ অবদি এখনও এই নিয়ম বহাল। যদিও পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে মাত্র কিছুসংখ্যক নারী শ্রমিক গৃহপরিচারিকা ভিসায় আসতেছে কিন্তু পুরুষদের জন্য আর খুলে দেওয়া হয়নি নতুন কর্মস্থলের দুয়ার। নতুন শ্রমিক তো দূরের কথা উল্টো যারা এখানে আছেন তাদের দেখ ভাল করার মত নেই তেমন কোন বেবস্থা। যার ফলে এখানের অবস্থানরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।

এই সব ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পদস্থ কারো সুনজর কখন পড়েনি আর আদৌ পড়বে কি না সেই ব্যাপারেও নেই কোন নিশ্চয়তা। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জনাব এইচ এম এরশাদ ঘোষণা করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশ সফর করবেন পাশাপাশি শ্রমিক সমস্যার সকল সমাধান করবেন। আর সেই আশায় বুক বেঁধেছিল এখানের ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশী। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় অতিতের সবার মত জনাবএরশাদ সাহেবের সেই ঘোষণা ঘোষণাই রয়ে গেছে তা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। অবস্য বিগত কিছু দিন আগে মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী সফর করেছেন আরব আমিরাত, কিছু চুক্তি হয়েছে তাদের সঙ্গে কিন্তু শ্রমিক সমস্যার সমাধানের বিষয়ে কোন আলোচনা আর হয়ে উঠেনি, নিচু পর্যায়েও কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য কিন্তু এতে আর গুরুত্ব দেয়নি আরব আমিরাত কতৃপক্ষ।

এখানে উল্লেখ্য যে চলতি বছরে ২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড এঙ্পো আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেয়ার কারণেআরব আমিরাত সরকার নতুন ভিসা ও বদলির বেবস্তা সংক্রান্ত সকল আলোচনা বন্ধ করে দেয় বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।যার দরুন আজকের এই পরিস্তিতি বলে মনে করছেন এখানের অবস্থানরত অনেক বংলাদেশী।

আমিরাতের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশীদের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় এদের প্রায় সবারই একি অবস্থা, সবার মনেই কাজ করছে নতুন ভিসা আর কর্মস্থান বদলি ব্যবস্থা বন্ধ থাকার ক্ষোভ। প্রতি মাসে এরা দেশে প্রচুর পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠায়, দেশের অর্থনৈতিক আয়ের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আজ এই সব সমস্যার সম্মুখীন। আর এই নাজুক পরিস্তিতিতে যদি আপন দেশের সরকারকে পাশে না পায় তাহলে নিশ্চয় এদের কর্মক্ষেত্রে উৎসাহ উদ্দীপনা হারিয়ে যাবে, আর যার ফলাফল এসে পড়বে দেশের অর্থনৈতিক খাতে।

তবুও ওরা আশা হারাচ্ছেন না, দেশের সরকারের পানে পথ চেয়ে বসে আছেন। এইসব লেখালেখির ক্ষুদ্র প্রয়াস যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীবর্গের বিন্দুমাত্রও যদি নজর আকর্ষণ করে উপর্যুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাহলেই এরা সার্থক। এই সুদুর পরবাসে থেকেও দেশের সবার জন্য এতো কষ্ট করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত তবুও এরা দেশের সাধারণ জনগণের মত এতো বেশি দাবী দাওয়া নিয়ে জ্বালাতন করেননা, শুধু মাত্র নিজেরদের একটু খেয়াল রাখার জন্য দাবী জানাচ্ছে সরকারের কাছে, শুধু নিজেরদের বললেও ভুল হবে কারন এতে দেশের অর্থনীতি, জনগন, সরকার সর্বোপরি স্বার্থ জড়িত।এদের একটাই চাওয়া দয়া করে আমাদের উল্লেখিত সমস্যা সমূহ দ্রুত তৎপরতার সহিত লাঘব করা হউক। অন্তত এখানে যারা আছে এদের কর্মস্থান বদলি বেবস্তা উম্মুক্ত করে এতো জামেলা অপমান আর কষ্ট থেকে রেহাই পেতে চায় সবাই। গুরুত্তের সহিত সমস্যাগুলি বিবেচনায় এনে উপর মহল থেকে যথাযত বেবস্থা নেবে সরকার। এটাই আরব আমিরাতে অবস্থানরত লক্ষ লক্ষ অবাগা বাংলাদেশীদের প্রাণের দাবী।

কাওছার আহমেদ
আবুধাবি, ইউনাইটেড আরব আমিরাত।
Email:- kkoysor@hotmail.com