এ বছরের গোড়ার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগরতলা সফরকে কেন্দ্র করে সারা ত্রিপুরা রাজ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দিপনা তৈরী হয়। আগরতলার সাথে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক প্রানের। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগরতলা নামটি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় বাঙলাদেশিদের সাথে আগরতলা তথা ত্রিপুরার মানুষের হৃদয়ের বন্ধনটা আরো গাড় হয়েছিল। বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনের অনেক মুক্তিযোদ্ধারাই ট্রেনিং নিয়েছিল আগরতলায়। ১৯৭১ এর নয় মাসে আমাদের কাছে আগরতলা, গৌহাটি, শিলং, এবং কোলকাতা নামগুলো ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের চেয়েও বেশী আপন মনে হতো। কিন্তু সেই আগরতলা সফর করার জন্য আমাদের কোণ সরকার প্রধানকে ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হলো। এটা দূঃখজনক। আগরতলার মানুষেরাও যেন অপেক্ষা করেই ছিল বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে দু'হাত দিয়ে বরণ করে নিতে। এত বড় এবং এত আন্তরিক সংবর্ধনা অন্য কোন দেশের সরকার প্রধান কিংবা রাজনৈতিক নেতাকে এর আগে কখনো দেওয়া হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সেই গুলি পড়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে।
আগরতলার সবচেয়ে বড় খোলা মাঠটিতে সেদিন দাড়ানোর জায়গা ছিলনা। সব ধর্মের, বর্ণের, বয়সের মানুষেরা সকাল থেকেই ভীড় করেছিল মুজিব-তনয়াকে একবার দেখার জন্য। জনসভায় আসা হাজার হাজার মানুষের হাতে হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা, আর কন্ঠে ছিল "আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…"। সারাদিন ধরে মাইকে বেজেছিল শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন আর স্বাধীন বাংলা বেতারের সব গান। সে নিঃসন্দেহে এক আবেজ্ঞহন পরিবেশ। আগরতলা যেন বাঙলাদেশীদেরকে তাদের সব ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলিরই মতো। ১৯৭১ সালে ত্রিপুরার নিজস্ব জন্সংখ্যার চেয়েও বেশী সংখ্যার বাংলদেশী শরণার্থিদেরকে তাদের নিজেদের বাড়ী ঘরে জায়গা করে দুয়েছিল। আমরা সেকথা কোনদিনও কি ভুলতে পারি? না, ভুলেননি আমাদের প্রধানমন্ত্রীও। তিনি আমাদের সবার ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তাদেরকে। আগরতলার সফরে প্রমাণিত হয়েছে যে ভারত সরকার আর তার জনগণ এক জিনিষ নয়। ভারতের সাধারন জনগণ এখনো বাংলাদেশীদের কে ভালোবাসে আগের মতই। আমরাও তাই।
বাঙালিরা অকৃতজ্ঞ জাতি না। শেখ হাসিনা ভারত সরকার এবং তার জনগণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের পাশে দাড়ানোর জন্য আবারো ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন এবং বলেছেন, বিপদের বন্ধ্বুই প্রকৃত বন্ধ্বু। বাংলাদেশীরা ত্রিপুরা তথা ভারতবাসীদেরকে বন্ধু হিসাবেই সবসময় পেতে চায়। সে লক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের সরকার ভারতের জন্য কম কিছু করেনি। শেখ হাসিনা আগরতলার মানুষের জন্য আমাদের সরকারের ইদানিংকালে দেওয়া কিছু উপহারের কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন ত্রিপুরা রাজ্যের পালটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সমস্ত ভারী যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম আশুগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর দিয়ে যাতায়তের ব্যবস্থা বাংলাদেশ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, সেটা করা হয়েছে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি না হওয়ার আগেই। আরো যেটা শেখ হাসিনার সরকার করেছে তা হলো, ভারতকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আমাদের দেশের তিতাস নদীটিতে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা করা হয়েছে ভারতের বড় বড় লরী যাতায়তের কারণে। তাতে কি, একটি বন্ধু দেশের জন্য এটা করা যেতেই পারে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের পক্ষে যা যা দেওয়া সম্ভব তার সবই বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার ভারতকে দিয়েছে, এবং সে কথাটা ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখাও হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের তুলনায় ভারত একটি মহাশক্তি, তবুও লেনদেন এবং ব্যবসা-বানিজ্যের হিসাবের খাতাটা কিন্তু তাদেরই অনুকূলে। বাংলাদেশ যেহেতু ভারতের তূলনায় একটি ছোট্ট দেশ, এবং অনেকটাই ছোট ভাইয়ের মতো, সেহেতু ভারত বাংলাদেশের স্বার্থকে আগলে রাখতে পারতো; কিন্তু সেটা স্বাধীনতার পর থেকে কোন ভারতীয় সরকার কখনো করেছে বলে নজীর নেই। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কখনো তাদের ন্যায্য হিস্যার বাইরে কিছুই চায়নি, অথচ এই ন্যায্য পাওনাটা দিতেই ভারত আন্তরিকভাবে কখনো এগিয়ে আসেনি। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অভিন্ন ৫১টি নদীর মধ্যে মাত্র একটি নদীর পানি বন্টন চুক্তি করা সম্ভব হয়েছে, তাও পত্রিকান্তরে জানা যায় যে গত ১৫ বছরের মধ্যে ১২ বছরই বাংলাদেশ তার ন্যায্য পানি্র হিস্যা ফারাক্কা থেকে পায়নি। ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি ভকারতীয় পত্রিকায় এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, ফারাক্কার ২টি স্লুইসগেইট অকেজো হয়ে পড়ায় চুক্তির পরিমাণের চেয়ে বেশী পানি বাংলাদেশে ঢুকে যাচ্ছে এবং তার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চলে লোনা পানি ঢুকে পরার সম্ভবনা আছে। মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করেছে। অথচ প্রায় সব শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ যথন তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয় তখন কিন্তু কোন ভারতীয় পত্রিকায় একবারো খবর হয়না যে বাংলাদেশের সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, কৃষি, নৌচলাচল, পরিবেশ, এবং অর্থনীতি দ্বংসের মুখে পড়েছে। অন্যদিদকে, তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে পশ্শ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী গত কয়েক্মাস ধরে কি নাটকটাই না করে যাচ্ছে। এখন আবার শুনা যাচ্ছে যে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনকে সম্পুর্ণ বায়ে ফেলে মমতা ব্যানার্জী কল্যাণ রুদ্রকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেছেন তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি চুড়ান্ত করার জন্য, এবং তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে রুদ্র কমিশনের পরামর্শের বাইরে গিয়ে তিনি তিস্তা চুক্তি মেনে নেবেননা। কল্যণ রুদ্র বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় একাধিক বার বলেছেন শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত পানি তিস্তাতে থাকেনা, এবং বাংলাদেশ ২৫% বেশি পানি পেতে পারেনা। তিস্তা নদীর বাংলাদেশের অংশের অববাহিকায় ৭০% মানুষের বাস। গোজালডোবায় ব্যারাজ তৈরী করে এবং বিভিন্ন সংযোগ খাল কেটে ইতিমধ্যেই তিস্তার পানি মহানন্দা-মেচী নদীর অববাহিকায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়, যাকিনা আন্তঃনদীসংযোগেরই নামান্তর। অথচ, শেখ হাসিনার সরকার এ ব্যাপারে একটি কথাও বলছেনা। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পানি সম্পদ সহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে কথা বলবে নয়া দিল্লীর সাথে – কোলকাতার সাথে নয়। নয়া দিল্লী কিভাবে কোলকাতা কিংবা সিকিমকে রাজী করাবে সেটা তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও শেখ হাসিনার সরকার স্পষ্ট কোন অবস্থান নিচ্ছেনা। বাংলাদেশ একতরফাভাবে আর কতদিন ভারতকে শুধু দিয়েই যাবে? বাংলাদেশের দানবীর মনোভাবটির জন্য ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকাও শেখ হাসিনার আগরতলা সফর নিয়ে হেডলাইন করেছে এভাবে, "দিয়েছেন কম নয়, প্রতিদানে চাইছেন নদীর জলের ভাগ"। বাংলাদেশ যে নিরন্তর শুধু দিয়েই যাচ্ছে, আর বিনিময়ে পাচ্ছে অসম আচরন, সীমান্তে ঝুলে থাকা লাশ, ৫৪টির মধ্যে ৪৩টি নদীতে ভারতের তৈরী বাঁধের মণিহার একথাটা এখন ভারতের অনেক সুধীজনরাই মানেন। যেমন সাম্প্রতিককালে টিপাইমুখ বাঁধের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছেন যে, ভারতের জন্য এটা বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের সামিল। ভারতকে একতরফাভাবে সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে গেলেও শেখ হাসিনা তার বদান্যতার খাতিরে আগরতলার সেই বিশাল জনসভায় বলেছেন, "রিক্ত আমি, সিক্ত আমি, দেবার কিছুই নাই, চেয়েছিলে ভালবাসা, দিলেম শুধু তাই" (ডেইলী দেশের কথা, জানুয়ারী ১২)।
বাংলাদেশের ভিতরে কোথাও যে কথাটি স্পষ্ট করে শেখ হাসিনা কখনো বলেনি, সে কথাটা তিনি বলেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বলকে। তিনি বলেছেন, "পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভারতকে আরও উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে"। অথচ, এ কথাটাই যদি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মিডিয়াতে জোড়ে সোড়ে বলতেন তাহলে দেশের মানুষ অনেক আশ্বস্ত হতো। আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, এই চুক্তির উপর যে তার সরকারের ভবিষ্যতও অনেকটা নির্ভর করবে তাও তিনি ভারত সরকারকে জানিয়েছেন।
শেখ হাসিনার সফরের খবরটি সিপিআইএম এর মূখপত্র গণশক্তি হেডলাইন করেছে এভাবে, "প্রানের আবেগে সংবর্ধনা ঘরের মেয়েকে"। এই খবরটি এক অর্থে খুবই হৃদয়কাড়া এবং আন্তরিক যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের জনগন 'ঘরের মেয়ে' হিসাবে মনে করে। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়। একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী অন্য একটি দেশের 'ঘরের মেয়ে' হতে যাবে কেন? যদিও আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে একথা তারা বলেও থাকে, তাহলেও কথার সঙ্গে কাজের মিলতো থাকতে হবে। ঘরের মেয়ের সঙ্গেতো কেউ অন্যায়, অযৌক্তিক, অসম আচরণ করেনা। বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য পাওনা থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত করে সে দেশের সরকার প্রধানকে 'ঘরের মেয়ে' বললেই তো প্রকৃত অর্থে ঘরের মেয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়না। শুধুই মুখের কথায় আর যাই হোক চিড়ে ভিজেনা। ভারত একটি বৃহৎ রাষ্ট্র হিসাবে তাদেরকেই এগিয়ে এসে প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ে তারা যে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেটা ছিল একান্তই মানবতার খাতিরে, অন্য কোন স্বার্থ সেখানে জড়িত ছিলনা। ঘরের মানুষের সঙ্গে বৈরী আচরন একটি উদিয়মান পরাশক্তির শোভা পায়না।
***
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে: http://www.kishorgonj.com, ১৫ জানুয়ারি ২০১২