ছেলেবেলার দুঃখ কথন (১)

নীলকণ্ঠ জয়
Published : 12 August 2012, 07:50 PM
Updated : 12 August 2012, 07:50 PM

মায়ের মুখে শুনেছি ছোটবেলায় আমি নাকি পাখি দেখলে কান্না থামিয়ে দিতাম।তাই খাঁচাবন্দি একটা পাখিও ছিলো আমাদের বাড়িতে।বাবা নাকি তখনো কোন চাকরি পাননি।অর্থ এই বেকার অবস্থাতেই বিয়ে করেছিলেন। কারণটা খুবই সাধারণ!!! আমার পিতামহ মৃত্যুর আগে বংশের নতুন বাতি দেখে যেতে চান!!!যদিও তার সেই সৌভাগ্য হয়নি।আমার জন্মের ছয় মাস আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

আমার জন্মের পর আমার বাবা একটা স্কুলে চাকুরি পেয়ে যান।তবে শহরে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা তার তখনো হয়নি।তাই আমাদেরকে থেকে যেতে হয় গ্রামে বাবা-কাকাদের যৌথ পরিবারের মাঝে। মায়ের ঠিকানা ছিলো তিনবেলা রান্না ঘরের মাঝে।সাথে সাথে বাড়ির সব দায়িত্বও আমার মায়ের উপর বর্তে ছিলো।শুধু সংসারের চাবিটা ছিলো অন্য হাতে।সে কথা না হয় নাই বললাম।

ঘুমানোর আগে ছাড়া কখনোই মায়ের কাছে থাকতে পারতাম না। পাড়ার কারো না কারো কোলে অথবা ধুলার মাঝে কেটেছে সারাটা দিন। মা কতটুকু কষ্টে ছিলো সে সময় ওইটুকুন বয়সে আমার বোঝার কথা নয়।তবে বুদ্ধি হওয়ার পর উপলব্ধি করেছি।আমার বাবা বুঝেও ভাইদের মুখের দিকে চেয়ে চুপ থাকতেন। অথবা নিজের অক্ষমতার জন্য হয়ত নীরবেই চোখ মুছতেন।

সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছি এমন সময়ের একটা ঘটনার কথা মায়ের মুখে শুনেছি।পাশের বাড়ির জ্ঞাতিদের সাথে আমাদের যে কোন কারণে ঝগড়া ছিলো।এমনকি মুখ দেখাদেখি বন্ধ পর্যন্ত।আমি হামাগুড়ি দিতে দিতে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম বলে আমার মাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছিলো দিনভর। আমার মা বিনিময়ে কোন বাক্যব্যয় করেন নি।যা ক্ষোভ ছিলো কাঁচা কঞ্চি দিয়ে আমার উপরেই পুষিয়ে দিলেন। সেই ক্ষতগুলোর কয়েকটা আমার শরীরে এখনো আছে।আসলেই তো দোষটা আমারই ছিলো।

স্কুলে ভর্তি হয়েছি যখন তখন বয়স ছিলো পাঁচ/ছয়। ক্লাসের সবাই বেশ তাগড়া তাগড়া ছিলো।তাই ভয়ে ভয়ে ক্লাশ করতাম সবসময়।ভাঙ্গা স্কুল ঘরে সবার স্থান সংকুলান হতোনা তাই ছোটদের অর্থাৎ আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিলো স্কুল মাঠের একটি অংশ।কাঠের শ্লেট,চক আর তালপাতার চাটাই নিয়ে সবাই হাজির হতাম সকাল সকাল।একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দুই বন্ধু আমাকে ধরে উত্তম-মধ্যম কিল-ঘুষি দিলো গোটা বিশেক।কারণ ছিলো আমি কেন চারের ঘরের নামতা পেরেছিলাম।আমার জন্য ক্লাশ শুদ্ধ সবাই মার খেলো !!!!!

ঘরে মায়ের হাতে,স্কুলে বন্ধুদের হাতে আর বিবিধ কারণে অন্য পাড়ার ছেলেদের হাতে। নিজেকে খুব অসহায় লাগতো,অচ্ছুত মনে হতো।এভাবে মার খেতে খেতেই কেটেছে বছর খানিক।ঘুড়ি বানানোটা ইতিমধ্যে বেশ রপ্ত করে ফেলেছি।মাঠে চরিয়ে বেড়ানো আমার নেশা ছিলো।এই অপরাধে বাড়ির গরুটার ভার পড়েছিলো আমার উপর।খারাপ ছিলো না দায়িত্বটা।বেশ উপভোগ করতাম।শুধু দুই বেলা খড় কাটাটা মোটেও পছন্দের ছিলো না।ভুতের ভয়ে ভরদুপুরে মাঠে যেতাম না।তাই অপেক্ষায় থাকতাম দুপুর গড়িয়ে কখন বিকাল হবে।একদিন সর্দারের ছেলে সেলিমের ঘুড়ির সুতা আমার ঘুড়ির সুতায় লেগে কেটে গেলো। ব্যাস আর যাবি কোথায়?ফলাফলে গোটা বিশেক কিলঘুষি আর ঘুড়ি-লাটাই হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরা।

সুযোগ খুঁজতাম প্রতিশোধ নেওয়ার কিন্তু সাহসে কুলাতো না।একদিন……(চলবে…)