রঙ-তুলির যাদুকর (পর্বঃ ১)

নীলকণ্ঠ জয়
Published : 22 Feb 2014, 06:24 PM
Updated : 22 Feb 2014, 06:24 PM

২৯ ডিসেম্বর,২০১৩ তারিখটি ছিলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ৯৯ তম জন্মদিন। পোষ্টটি সেদিনই শিল্পাচার্য্যের জন্মদিনকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ করেছিলাম জলছবি বাতায়নে । আজ বিডি ব্লগে ফিরে এসে প্রিয় পোষ্টটি প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের (বর্তমান কিশোরগঞ্জ) কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিনী।

পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। রং-তুলিও হাতে তুলে নিয়েছিলেন অল্প বয়সেই। প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে সময়ও লাগেনি বেশি। কারণ, তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। তাঁর মা জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। শিল্পাচার্য্যকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানা সময়ে নানা ভাবে। সমন্বয় করে বললে আমি বলবো-

বাংলার রূপ-প্রকৃতি,সংস্কৃতি-জীবনাচার, সৌন্দর্য্য-ঐশ্বর্য, দারিদ্র্য এবং বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা যিনি বিশ্ববাসীর সামনে মূর্ত করে তুলেছিলেন রঙ-তুলি আর ক্যানভাসে,তিনিই আমাদের জয়নুল আবেদিন।

শিল্পাচার্যের জন্মদিনে তার নিজের হাতে আঁকা বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্মের আলোচনা করবো আজ। তুলে ধরার চেষ্টা করবো তখনকার প্রেক্ষাপট।

তেঁতাল্লিশের মন্বন্তরঃ

তেতাল্লিশের মন্বন্তর হয়েছিল ১৯৪৩ সালে এবং এর ফলে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। দুর্ভিক্ষের সময় তৎকালীন ভারতবর্ষে লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যান। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিলো পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে। কিন্তু কেন এই দূর্ভিক্ষ হয়েছিলো আমরা অনেকেই হয়তো জানি না।

সেই সময়ে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিলো এই দূর্ভিক্ষ। আর এর জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। ঐ সময়ে ভারতবর্ষে বাড়তি চাহিদার চাল আমদানি হতো বার্মা থেকে। জাপান যখন বার্মা দখল করে নিলো তখন এই আমদানি বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ভারতবর্ষে কর্মরত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক, সেনা এবং যুদ্ধে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ করেন। কারণ হিসেবে তিনি যুক্তি দেখান জাপান যদি ভারতবর্ষ দখল করে ফেলে তখন শত্রুপক্ষকে খাদ্য সংকটে ফেলতে পারবে। দুই বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান বাহন নৌকা এবং গরুর গাড়িও ধ্বংস করে ফেলা হয় চার্চিলের নির্দেশে।

যার ফলে বেড়ে যায় চালের দাম এবং হয়ে ওঠে দুষ্প্রাপ্য। যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চাল বা খাদ্য বিতরণ-ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় দূর্ভিক্ষ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর।

তেতাল্লিশের মন্বন্তর নিয়ে জয়নুল আবেদিন সারাবিশ্বের কাছে প্রতিবাদ তুলে ধরেন রং-তুলির আঁচড়ে সাদা-কালো ক্যানভাসে। তার চিত্রকর্মগুলো বিশ্ব হৃদয়কে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলো। নিচের চিত্রকর্মটি সেই সময়ের দূর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের দূর্দশারই প্রতিচ্ছবি।

এবার আসুন লক্ষ্য করি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত ফটোগ্রাফার William Vandivert-এর তোলা কোলকাতার দূর্ভিক্ষের ছবিগুলোর একটি ছবি। যে ছবিটি তিনি ১৯৪৩ সালে ভারতবর্ষ ভ্রমণকালে তুলেছিলেন।

দুটি ছবির একটি ক্যামেরায় তোলা আরেকটি হাতে আঁকানো অথচ কত জীবন্ত। চিত্রকর্মে স্পষ্টই তিনি দূর্ভিক্ষে না খেয়ে থাকা হাড় পাজুড়ে মানুষের করুন চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, বিশ্ব বিবেকের কাছে মানবিক প্রশ্ন এঁকে দিতে পেরেছিলেন।

আসুন জয়নুল আবেদিনের আঁকা তেতাল্লিশের দূর্ভিক্ষের আরও একটি চিত্রকর্ম দেখি-

ঠিক একই চিত্র ফুটে উঠেছিলো ফটোগ্রাফার William Vandivert এর ক্যামেরায়। খুব আশ্চর্য্য হলেও সত্য এই মহান দুই ব্যক্তি ছিলেন দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। অথচ দুইজনের ছবিতে ভেসে উঠেছে অসহায় মানুষের করুণ চিত্র। পাশাপাশি ছবি রেখে এই তুলনা করেছি তার আরেকটি কারণ হলো গতকাল ফেইসবুকে জয়নুল আলোচনায় এক বন্ধু জয়নুলের আঁকা এই ছবিগুলো তখনকার ঘটনা পরবর্তি বলে উল্লেখ্য করেন এবং দাবি করেন জয়নুল গ্যালারীর কিছু ছবি অপ্রাসাঙ্গিক এবং সেগুলো নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করেন। আর এটাও দেখাতে চেয়েছি বাস্তবের সাথে তার স্কেচ করা ছবিগুলোর কতখানি মিল !

তেতাল্লিশের দূর্ভিক্ষের সময় তিনি কোলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কোলকাতা শহরের অলিতে-গলিতে অসহায় মানুষের আর্তনাদ, ডাষ্টবিনের হুমড়ি খেয়ে পড়া ক্ষুধার্ত মানুষের করুন দৃশ্য, বেড়ে যাওয়া হাড়পাঁজুড়ে অভুক্ত মানুষের দূর্দশা জয়নুল আবেদিনকে মর্মাহত করে তোলে। নিজের সামান্য আয়ের কারণে এই সব মানুষের জন্য কিছুই করতে না পারার বেদনাও তাকে ভুগিয়েছিলো। সেই দূর্মূল্যের বাজারে তার পক্ষে রং-তুলি কেনার মতো সাধ্য ছিলো না। তাই সাদা কাগজ আর পেন্সিল তুলে নেন হাতে। চিত্রপটে তুলে ধরেন দূর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র। কোলকাতা থেকে ময়মনসিংহ ছুটে বেড়িয়েছিলেন তিনি।

তার পেন্সিলে আঁকা চিত্রকর্ম(স্কেচ) দেখে ভারতের নাইটেঙ্গেল খ্যাত সরজিনি নাইডু বলেছিলেন,

সবচাইতে মর্মস্পর্শী এবং আবেগময় বর্ণনার চাইতেও তার এসব ছবির আবেদন অধিকতর।

বিখ্যাত শিল্প সমালোচক স্যার এরিখ নিউটন বলেন,

তার ছবিগুলোর মধ্যে অসম্ভব ঘটনাটিই ঘটেছে যা বাস্তব।(১৯৫৪)

ডঃ ও সি গাঙ্গুলী বলেন,

তার এসব নির্মম তুলির টানের দুঃসাহসিকতার মধ্যে একাধারে ছিলো স্বতস্ফুর্ততা ও সততা এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো আপোশীন বাস্তবতা, যা কিনা বাংলার আধুনিক শিল্পীদের মাঝে একেবারেই বিরল এক বৈশিষ্ঠ্য। তার এই অসাধারণ কাজের মাধ্যমে তিনি আধুনিক চিত্রকলার এক নতুন অধ্যায় রচনা করলেন। জয়নুলের ড্রয়িংগুলো ১৯৪৩ এর বাংলার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক অমূল্য বিশ্বস্ত দলিল হয়ে থাকলো। মানব জীবনের শোচনীয় পরিণতির মধ্যেও সৌন্দর্য্যের পূজারী হিসেবে এই শিল্পী বাংলার বিদ্যমান সস্তা ভাবপ্রবণ নিম্ন পর্যায়ের চিত্রধারাকে উন্নিত করলেন এক সম্মানজনক স্তরে।(১৯৪৪)

তেতাল্লিশের দূর্ভিক্ষ নিয়ে আরও কয়েকটি চিত্রকর্মঃ

দ্বিতীয় পর্বে থাকবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা 'দুই নারী' এবং 'মনপুরা -৭০' ছবি দুইটি নিয়ে আলোচনা।