দেওয়াল জুড়ে পোস্টারিং- বিবেকহীনের হাতে দৃষ্টিদূষণ

নীলকণ্ঠ জয়
Published : 7 Jan 2015, 08:37 AM
Updated : 7 Jan 2015, 08:37 AM

দবির সাহেবের মনটা আজ ভীষণ ভালো। গত কয়েকদিনের ঘটনা নিয়ে দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে ভাবলেন…

বালুর ব্যবসায় নেমে প্রথম সুযোগেই বড় কাস্টমার পেয়ে গেলেন, কিন্তু ভাগ্যদেবী কী নিষ্ঠুর প্রতারণাই না করলেন। বালুর ট্রাক আটকে গেলো রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে। এইনিয়ে বউয়ের সাথে দিনরাত ঝগড়া ঝাঁটি। কান ধরে কসম কেটেছেন আর কোনদিন বউয়ের কাছে হাত পেতে ব্যবসা তো দূরে থাক একটা পানও কিনে খাবেন না। এই ঝামেলা শেষ হতে না হতেই আরেক নতুন ঝামেলায় পড়লেন তিনি। টানা অবরোধে সবজি বাজারে, মাছ বাজারে আগুন। বাজার না করে বাসায় ফেরার অপরাধে বউ এবার তল্পিতল্পা গুঁটিয়ে বাপের বাড়ি হেঁটেছে। অবশ্য একদিন বাদেই আবার ফিরেছে। সরিটরি বলে আগের ভাব ভালোবাসাও ফিরেছে অভিমানীর ব্যবহারে। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ দবির সাহেব শুধুই ভালো মানুষ নন, সমাজ সচেতন মানুষও।

হঠাৎ গতরাত থেকে শীতের প্রকোপটা আবার বেড়েছে, আজ সূর্যেরও দেখা নেই। মাফলার মাথায় চাপিয়ে মনের সুখেই হাঁটছেন দবির সাহেব। বাসায় আজ পিঠা এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। হাঁটতে চোখ আটকে গেলো একটি পোস্টারে। 'সুলভ মূল্যে ফেনসিডিল বিক্রির বিজ্ঞাপন।' 


'হে আমার সমাজ, এমন অধঃপতন আজ তোর ললাটে?' মনে মনে বিতৃষ্ণা নিয়ে ছিড়ে ফেললেন পোস্টার দু'খানি। প্রতিজ্ঞা করলেন আজ এইজাতীয় যা সামনে পাবেন সব ছিড়ে ফেলবেন, মুছে ফেলবেন। একটুখানি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ত্বক ফর্সা করার বিজ্ঞাপন… দেওয়াল জুড়ে। তাও আবার পুরুষের। এবার আর ছিড়লেন না। নির্মল বিনোদনের স্বার্থে রেখে দিলেন।

চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে চারদিকের পোস্টার আর পোস্টারের বিশ্রী সমারোহ দেখে চোখ ব্যাথা শুরু হলো। বিবেকহীন মানুষের হাতে দৃষ্টিদূষণ আজ ছেলেখেলা একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চৌরাস্তা ছেড়ে পাড়ার গলিতে ঢুকলেন। ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খেতে হবে।

বটতলায় এসে বসলেন ফটিকের ছাবড়া দেওয়া কফির দোকানে। বেশ জনপ্রিয় একটি কফির দোকান। ফটিক এই কফি বেঁচেই সুনাম এবং পয়সা দুইটাই অর্জন করেছে। ভেতরে বাইরে বসার সুব্যবস্থা আছে। বাইরে বসে এককাপ কফির অর্ডার দিয়ে স্মৃতিমন্থন করতে লাগলেন। আহারে এখানে বসে কত রাত বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন, ছোটবেলায় বটতলায় এই শীতেই জারীগান,পালাগানের আসর বসতো। কতো না মধুর স্মৃতির সাক্ষী বটগাছটি। আজ সবকিছুই বদলে গেছে… একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাছটির দিকে তাকালেন। বিস্ময়ের চরমে পৌঁছালেন তিনি… এ কোন অরাজকতা? পোস্টার আর পোস্টার… গাছটির এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে কাগজ আর আঠার যোগসাজেশ ঘটে নি। ভুল বানানের নানাধরণের পণ্যের বিজ্ঞাপনের পোস্টার থেকে শুরু করে অশ্লীল চলচ্চিত্রের পোস্টার …সবকিছুই বুকে পিঠে ধারণ করে রেখেছে অবলা শতবর্ষী বৃদ্ধ গাছটি। আচ্ছা পাবলিক কোনটা রেখে কোনটা পড়বে?

দবির সাহেবের কফি চলে এসেছে ইতোমধ্যে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে নানান কথা ভাবছেন। কী হচ্ছে দেশটার? কেউ কি দেখার নেই? কারো কি মাথাব্যাথা নেই? একলা দবিরের মাথা ব্যাথায় সমাজের কি'বা যায় আসে। কফির বিল দিতে গিয়ে চোখ পড়লো দোকানের নেইমপ্লেটের দিকে। এবার আর অবাক হলেন না… কী হবে আর অবাক হয়ে?

মনে মনে দণ্ড অনুভব করে বাসায় ফেরার পথে মোবাইলে ক্লিক করলেন…

বাসায় ফিরে গত পরশু বড় মেয়ের দেখানো ফেইসবুকের একটি ফটোর কথা মনে পড়ে গেলো। 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি' আমেরিকায় না থেকে বাংলাদেশে থাকলে কী হাল হতো স্টাচুটির-


এই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র, দৃষ্টিদূষণের সত্য গল্প। দবির সাহেবের গল্পটি একটি কাল্পনিক গল্প। ছবিগুলো অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করা। সমাজের এহেন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাধ্যতামূলক আইন প্রয়োগ জরুরী হয়ে পড়েছে; টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত সচেতনতামূলক ফিচার ও অনুষ্ঠান প্রচার করা খুব বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। আইনকে খাতা-কলমের বাইরে এনে প্রশাসনকে সর্বোচ্চ কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।

আমাদের দেশে 'দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২' নামে একটি আইন আছে। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হইয়াছে, 'ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না'। কিন্তু কে শোনে কাহার কথা? এই আইনে দেওয়াল লিখন বলতে বোঝানো হয়েছে যে, অর্থ প্রচার বা ভিন্নরূপ কোন উদ্দেশ্যে, যে কোন রং-এর কালি বা চুন বা কেমিক্যাল দ্বারা, দেওয়াল বা যানবাহনে কোন লিখন, মুদ্রণ, ছাপচিত্র বা চিত্র অংকন করা। আর কাগজ, কাপড়, রেক্সিন বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমসহ যেকোন মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত প্রচারপত্র, প্রচারচিত্র, বিজ্ঞাপনপত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র; এবং যেকোন ধরনের ব্যানার ও বিলবোর্ডও পোস্টারের অন্তর্ভুক্ত। এই আইন অমান্যের জন্য ধারা ৬ অনুযায়ী অন্যূন পাঁচ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ, অনাদায়ে অনধিক পনের দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ডের বিধান আছে। ধারা ৫ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ খরচে দেওয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমতে পোস্টার মুছিয়া ফেলা কিংবা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু অন্য অনেক আইনের ন্যায় এই আইনেরও কোন প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাইতেছে না। বর্তমানে ইহা কাগুজে আইনে পরিণত হওয়ায় কেহ এ ব্যাপারে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করিতেছেন না। সিটি করপোরেশনের আইনেও রাজধানীর যত্রতত্র পোস্টার, ব্যানার প্রভৃতি লাগানো বা টাঙানো বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলিয়া গণ্য। কিন্তু এক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের নজর নাই।

২০১২ সালে প্রণীত আইনটি বাস্তবায়ন করার কথা স্থানীয় সরকার ও জেলা প্রশাসনের। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অভাব আছে, এমন অজুহাত দেখাইয়া ইহা প্রতিপালন করা হয় না বলিয়া অভিযোগ আছে। বস্তুত এই ধরনের প্রবণতা আমাদের উপমহাদেশের সর্বত্র বিরাজমান। [আইন অংশটুকু ' দৈনিক ইত্তেফাক'-এর সম্পাদকীয় থেকে কপি করা]।