বই আলোচনা: লিটন আব্বাসের ‘তিনটি নাটক’ -ভবতোষ হালদার

কুমারখালি
Published : 28 June 2011, 09:05 AM
Updated : 28 June 2011, 09:05 AM

তিনি কবি ও নাট্যকার। 'উত্তর '৭১ প্রজন্মের রাগী প্রতিভু। এ প্রতিভুগণ অন্যের প্রতি নিজেদের প্রতি নয় রাগ-ক্ষোভ হতাশায় জর্জরিত। তাদের ছিল অনিঃশেষ স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একটি দেশ ও জাতির জন্য ছিল অমূল্য। তাঁরা স্বাধীনতার বিভিষিকাময় সংগ্রাম চিত্রগুলি প্রত্যক্ষ না করলেও খুবই অনুভব করতে পেরেছেন ও চেয়েছেন বাংলাদেশের জনগণ ও সংগ্রামশীল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মহান স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন হলো: সুখী সমৃদ্ধশালী আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ। অথচ দেশব্যাপী হত্যা, ক্যু, অরাজকতায় আচ্ছন্ন একটি বর্বর দেশে পরিণত হলো বলা যায়। যুদ্ধফেরৎ তরুণ যুবকদের মানসপটে উজ্জ্বল স্বপ্নগুলি জন্ম নিয়েছিল একদশকের মাঝেই সে রঙিন সাঁকো সম্পূর্ণ ভেঙে গেল।

একটি জাতির স্বপ্নভঙ্গের বেদনা অনুভূতির স্তরেই শেষ হয়ে যায় না। সেই বেদনার আঁচে একটি দেশ, কাল, পটভূমি। শিক্ষা সংকোচন, সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিল্প কলকারখানার উৎপাদনশীলতা হ্রাস-ফলত রাশি রাশি বেকারের সংখ্যা, ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক জীবনে তৈরী হতে থাকে ক্রমশ দূরত্ব ও সমন্বয়হীনতা।

এ পটভূমিতে রচিত লিটন আব্বাসের 'তিনটি নাটক'। পাক বাহিনীর তাণ্ডব লিটনরা দেখেননি-দেখেননি তাদের দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস ও বদর বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের যেভাবে তারা হত্যা করেছিল গ্রাম-নগরের অবলা নারীদের যেভাবে নষ্ট করেছিল তাও তারা দেখেননি। যাদের বীরাঙ্গনা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল-তাদের কান্নার করুণ সুর ও চোখের জলে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে, নদীজলে মিশে গিয়ে দেখিয়েছে নারী আর শিশুরা যুদ্ধে কি পরিমাণ মূল্য দেয়। তবুও বহুদিন পর পরম আত্মপ্রসাদ এই যে, লিটনরা ৭১' সালের যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ফল কত সুদূরপ্রসারী হয় তা উপলব্ধি করতে পারেন। লিটনের পথ নাটকে তারই স্বাক্ষর।

মাত্র চার বছর যেতে না যেতেই বাংলাদেশের মানুষ যেন একভাবে একটি স্বাধীনতালাভের বিষাদগাঁথা বেমালুম ভুলে গেল-বিস্ময়কর বটে তাই! বুকে যাদের বেদনার নিত্যরণন তারাই আবার লোকে লোকান্তরে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন যে, বাতাসে বাতাসে নাগিনীরা বিষাক্ত ছোবল নিয়ে ধেয়ে আসছে একটি তরুণ দেশের স্বপ্নকে ভুলিয়ে দিতে। ' বর্ণচোরা' 'এই দেশে-এই বেশে' 'ক্ষাপা পাগলার প্যাচাল' 'আরেকটি যুদ্ধ' 'যুদ্ধযুদ্ধ' প্রভৃতি নাটক তারই প্রতিফলন। সামরিক উর্দির আবডালে ও রক্তচক্ষুর সামনেই পথে পথে অভিনীত হল সেই কালজয়ী নাটকগুলো। রেডিও, টিভি সিরিয়ালে সেই সকল রক্তক্ষরণযোগ্য নাটকগুলো আজও পঞ্চাশোর্ধ নারী-পুরুষের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। লিটনের 'আরেকটি যুদ্ধ-আরেকটি শান্তির মিছিল' 'স্ব্ধাীনতা আমার জন্য' দুটি পথনাটক তারই ধারাবাহিকতার অপূর্ব স্বাক্ষর। পূর্বোক্ত যে, লিটন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াল ঘটনাবলী না দেখেও গভীর বোধে অনুভব করেছেন যে, একটি দেশ স্বাধীনের জন্য মানুষের কি অপরিমেয় মূল্য দিতে হয়। তার নাটকের পাত্র শামীম, পলাশ, ফরিদের বাচনিকতায় তার যথাযোগ্য উদাহরন মেলে। আবার স্বাধীনতার শত্র"পক্ষ হেকমত, শওকতদের মতো মানবতার শত্র" রাজাকার-আলশামসদের ভূমিকার নিপুণ চিত্রও বাঙময়।

'স্বাধীনতা আমার জন্য' পথ নাটকের মর্মবাণী তাই-ই। বিপন, রিদ্দি, ফয়জু, কৌশিক, মনাদারা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অহংকারী প্রতিভু। ঝুনুখাঁ, বাঁশে, পাক মেজররা সেই সকল পরজীবী পোদ্দার প্রেমহীন বিশ্বাসঘাতক, নিষ্ঠুর অমানুষ চরিত্রগুলিও পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত।

লিটন একজন মগ্ন কবিও। মানুষের স্মৃতি-সত্ত্বা ও ভবিষ্যতকে নষ্টদের খপ্পর থেকে প্রাণপণে বাঁচাবার জন্য তার এ চর্চা আমাদের মাঝে যে দীপশিখা জ্বালিয়ে যায় তার ব্যপ্তি আবহমানকাল।
একটি ব্যঙ্গ নাটক পাই তার চিন্তামগ্ন জাগ্রতবোধ থেকে। তিনি এ্যারিস্টোফেনিস, মাইকেল মধুসূদন , অমৃতলাল ও ব্রেখটের উত্তরসূরী। তার "খোড়'' নাটকে আমাদের যাপিত জীবনের লোক সাধারণের মধ্যে খুব পাওয়া যায়। সার্থক একটি নাম "খোড়"। কেউ ফেন্সিখোড়, মদখোড়, ঘুষখোড়, কেউ প্রেমখোড় এই আমাদের নানা লোকমানসের চিত্র। প্রচণ্ড হাসির উদ্রেক করে সেই সকল চরিত্রগুলি। যা ব্যঙ্গ নাটকের একটি অন্যতম লক্ষণ। নির্মল হাসির উদ্রেক করে যে ব্যঙ্গ নাটকে, সৃজিত হয় মানুষের নানা কদর্যময়, অসংগতি অভ্যাসের ব্যতিক্রম ব্যবহার যারা যথাযথভাবে রূপায়িত করতে সক্ষম তারাই দর্শক সাধারণের নানা অনুষঙ্গের মাঝে বেঁচে থাকেন।

লিটন আব্বাসের দুঘরানার তিনটি নাটক মঞ্চ সফল হওয়ারই কথা। জনগণের লৌকিক ভাষাগুলি ব্যতিক্রমী চরিত্রগুলি যে কৌশলে পাত্র-পাত্রীদের বচনে প্রোথিত করে দিয়েছেন তা অতুলনীয়। কুমারখালীর মতো ছোট্ট পরিসরে উপজেলা শহরে বাস ও চর্চা করে তিনি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার উদ্রেক করে। আমরা যারা বুঝতে এবং লোককে বোঝাতে চাই তাদের উচিত হবে তার নাটক তিনটির বারবার মঞ্চায়ন। তার দর্শকপ্রিয় ও যথার্থ মঞ্চসফল।

তিনি লিখেছিলেন অতিতরুণ বয়সে। এবং অত্যন্ত পরিপক্ক লেখাই তিনি লিখেছিলেন। এই যৌবনেও তার নাট্যরস নাটক পিপাসুদের রসসিক্ত করবে আমার সে প্রতিতী রয়েছে। তরুণদের প্রতি আমার আহবান যারা সৃজনশীল তারা যেন এরকম প্রতিশ্র"তিশীল নাট্যকার তৈরী হয়। তাতে দেশ ও সমাজের মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণতা দেখা দেবে।