নির্বোধের হাতে টেলিভিশন কেন?

এহেছান লেনিন
Published : 26 June 2012, 12:06 PM
Updated : 26 June 2012, 12:06 PM

আমি হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত। হতাশার কারণ সাংবাদিকতা পেশায় এখন লাঠিয়াল বাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছে। যারা অন্যের অধিকারের কথা বলে, যাদের অবস্থান থাকার কথা শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে, শোষিতের পক্ষে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যাদের সোচ্চার থাকার কথা তাদেরই জনাকয়েককে বিবেক বর্জিত আবেগে শুধু 'প্রভূর' তুষ্টির জন্য যখন দেখি হিস্র হয়ে ওঠেন, তখন হতাশ না হয়ে কি কোনো উপায় আছে?

অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানল এবং সামাজিক যোগাযোগের সাইটের বদৌলতে আপনারা গত কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাহ দেখেছেন। তারপরও দুদিন আগে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে এটিএনের কয়েকজন সংবাদকর্মীর হাতাহাতির ঘটনাকে আমি নিশ্চিন্ত ভাবে চাকরির স্বার্থে 'ঔদ্ধত্য' বলেই মনেকরি। কারণ এটিএনের ওই সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সহকর্মীর খুনের বিচার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।

আপনারা সবাই জানেন গত ৩০ মে এটিএন চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান লন্ডনে সাগর-রুনির হত্যাকা- নিয়ে কী বলেছিলেন। আর তা ঢাকতেই শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেও নিজের কাতারে নামিয়ে এনে বললেন- 'বাচাল'। একটা মানুষ কতোটা ঔদ্ধত্য হলে এ ধরনের কথা বলতে পারেন এর চেয়ে ভালো কোনো উদহারণ হতে পারে না। সঙ্গে নির্বোধও।

সাগর-রুনিকে নিয়ে মাহফুজুর রহমান যা বলেছিলেন সেটিকে 'মিসটেক' বলে ধরে নিলেও প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছেন সেটিকে কী বলবো।

নিজের অপরাধ ঢাকতে সেদিন লন্ডনে ভিন্ন আরেকটি অনুষ্ঠানে মাহফুজ বলেছিলেন, 'আরে, প্রাইম মিনিস্টার কতো না কথা বলেন। প্রাইম মিনিস্টারের বক্তৃতা শুনছেন না, ওইটাও বলছে, আমরা কি ড্রয়িংরুমে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিছি? এইটা হচ্ছে, বেশি কথা বলতে বলতে বাচালের ফট করে একটা মিসটেক হয়ে যায় না, এ রকম একটা মিসটেক হয়ে গেছে।"

বলছিলাম আমি হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত। হতাশার কারণ বলেছি। লজ্জিত হওয়ার কারণ এই ধরনের একজন নির্বোধ, বেপরোয়া মানুষের হাতে টেলিভিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম কীভাবে যায়।

ছোটবেলা বাবা একটা গল্প বলতেন প্রায়ই। এক বিজ্ঞানী তার সহকারীকে একটা লাল বোতাম দেখিয়ে বললো- এই যে লাল বোতামটা দেখছো সেটিতে ভুলেও কখনো চাপ দিও না। তাহলে এই পুরো গবেষণাগার ধ্বংস হয়ে যাবে।

সহকারী তার কথায় মাথা নেড়ে বললেন- জি স্যার। এই ভুল জীবনেও হবে না।

পরদিন ওই বিজ্ঞানী তার গবেষণাগারে এসে দেখেন সহকারী নেই। খোঁজ নেওয়ার জন্য তিনি লোক পাঠালেন। লোক খবর নিয়ে বিজ্ঞানীকে বললেন- সহকারী বাসায় তার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছে।

কিছুক্ষণ পর সহকারী এসে সোজা গবেষণাগারে ঢুকে গেলেন। ঢুকেই বিজ্ঞানীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তার দেখিয়ে দেওয়া লাল বোতামে চাপ দিলেন। তারপর কী ঘটেছে তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।

তো বিজ্ঞানীর যেমন ওই নির্বোধ সহকারীকে লাল বোতাম দেখিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি, তেমনি এই ধরনের নির্বোধদের হাতে টেলিভিশন বা পত্রিকার মতো শক্তিশালী গণমাধ্যম তুলে দেওয়া কতোটা যৌক্তিক হয়েছে সেই প্রশ্ন রাখলাম। প্রতিনিয়ত এ ধরনের টাকাওয়ালা গণমাধ্যম মালিকদের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে পড়ছি। তাদের এতোটাই ক্ষমতা সরকার প্রধানকেও 'বাচাল' বলতে এতটুকু ভয় পান না।

আমি জানি, আমার মতো লোকের হতাশা কিংবা লজ্জিত হওয়ায় কারো কিছু যায় আসে না। চাকরি চলে যাবে তাই ভয় পেয়ে হাজারটা অন্যায় হজম করার মানসিকতা যাদের নেই, তাদের মোটাদাগে অপেশাদার বলা যেতে পারে, অনভিজ্ঞ নয়। আমি সেই দ্বিতীয় দলে থাকতেই পছন্দ করি। তাই যেখানে এ ধরনের প্রাকটিস নেই, সেসব জায়গাই আমার স্বর্গ, আছিও তেমন একটিতে।

নিজের মেরুদণ্ডটাকে সোজা করে যারা দাঁড়াতে শিখেছেন চাকরির কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করাটা আমার কাছে অনেক বড় অপরাধ বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী দুদিন আগে যা করেছেন তাকে আমরা কী বলবো! তাকে যা-ই বলি না কেন, আমার ক্ষোভের কারণ তাদের মেরদণ্ডহীনতা নিয়ে। সাংবাদিকরা এতোটা মেরুদণ্ডহীন হয় কীভাবে? কীভাবে নির্বোধদের জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারে? জাতি তাদের কাছ থেকে কী আশা করবে?

***
ফিচার ছবি: আইরিন সুলতানা (৮ জুন ব্লগারদের প্রতীকী প্রতিবাদ থেকে নেয়া ছবি)