ব্যাংকিং খাতে লোকসানঃ দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ অশনি শংকেত

মাহি জামান
Published : 22 Nov 2012, 05:52 AM
Updated : 22 Nov 2012, 05:52 AM

আধুনিক অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাত একটি দেশের হৃৎপিন্ড সমতুল্য। হৃৎপিন্ড যেমন মানব দেহের প্রতিটি কোষে পরিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে তেমনি ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশের ব্যাবসা-বানিজ্য ও বিনিয়োগের অর্থ সরবারহ নিশ্চিত করে। ব্যাংক ছাড়া বর্তমানে একটি দেশের পুরো অর্থিক কার্যক্রম অচল। সুতরাং ব্যাংকিং খাতের সামান্য সমস্যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উপর বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কোন কোন সময় এর প্রভাব হতে পারে অত্যন্ত সুদূর প্রসারী। যার প্রমান আমরা কিছু দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি। বাংলাদেশেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে কি-না সেই শংকা আমার মনে উঁকি মারছে। কারন আবাসন খাত ও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পসহ হলমার্ক জাতীয় বিভিন্ন খাতের প্রচুর অনাদায়ী ব্যাংক ঋণ বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। শেয়ারবাজার এবং ইউনিপে-টু মার্কা এমএলএম কোম্পানীগুলো মানুষকে অবাস্তব প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো লুট করে নিয়ে গেছে। ফলে ব্যাংকে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক তারল্য সংকট। এই সংকট কাটাতে আমানত সংগ্রহে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সুদের হার বাড়িয়ে সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে।

গত ২১ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত " ব্যাংকিং খাতের মুনাফা কমেছে, লোকসানও হচ্ছে" শীর্ষক প্রতিবেদন পড়ে আরো উদ্বিগ্ন হয়েছি। কারন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর এমন কাল ছায়া আর পড়েনি। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল বাংলাদেশী বেসরকারী ব্যাংকগুলো চমৎকার পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে বিগত দিনগুলোতে দেশের অর্থনীতিতে সত্যিকার হৃৎপিন্ডের ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের অতি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব এখন ব্যাংকিং খাতের উপর পড়ছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-

"বছরের তৃতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এসে হঠাৎ করেই ব্যাংকগুলোর মুনাফা থমকে গেছে। এ সময় লোকসানও গুনেছে অনেক ব্যাংক। আগের দুই প্রান্তিকে যে মুনাফা হয়েছিল, তা দিয়েই কোনো রকমে নয় মাসের মুনাফার হিসাব করেছে ব্যাংকগুলো।

আগের বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে মাত্র সাতটি ব্যাংক আগের বছরের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। সাতটি ব্যাংক বড় অঙ্কের নিট লোকসান দিয়েছে। এ চিত্র সাম্প্রতিক বছরগুলোর সঙ্গে বেমানান। কেননা, কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকগুলো বড় ধরনের মুনাফা করছিল।

সময়মতো ঋণ আদায় করতে না পারায় তার বিপরীতে বড় অঙ্কের নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) সংরক্ষণ, শেয়ারবাজারে মূল্যপতনের কারণে নতুন করে প্রভিশনিং, নিত্যপণ্য আমদানি অর্থায়নে টাকা আটকে পড়া, কিছু শিল্প ও ব্যবসা খাতের মন্দা, আমানত সংগ্রহে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং নতুন বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে বলে ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির প্রভাব।

ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন বিধান কার্যকর হবে। ফলে নতুনভাবে ঋণ শ্রেণীকরণ ও ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এতে ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা আরও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। ———— অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি খাত নিয়ে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান ব্যাংকাররা। এর মধ্যে রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাতের বেচাবিক্রি কমে গেছে। বেশ কিছু ঋণগ্রহীতা ভিন্ন খাতের জন্য ঋণ নিয়ে বড় মুনাফার আশায় এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। এখন বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের টাকা ফেরত আসছে না। —————— আবাসন খাতে কিছু ঋণ আটকে আছে। যে কারণে প্রভিশনিং করতে নিট মুনাফা কমে গেছে কারও কারও।

জাহাজভাঙা শিল্প: কয়েকটি ব্যাংক জাহাজভাঙা শিল্পেও বিনিয়োগ করেছিল। এখন এ খাতে বড় অঙ্কের ঋণ আটকা পড়েছে। কিছু নতুন ঋণ জাহাজভাঙা শিল্পে মূল্যপতনের কারণে আটকে পড়েছে। ফলে তাঁদের বড় অঙ্কের প্রভিশন করতে হয়েছে।

নিত্যপণ্য আমদানি অর্থায়ন: একদল ব্যবসায়ী আমদানি করা নিত্যপণ্য বাজারজাত করতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ করায় হাজার হাজার কোটি টাকা এখন মেয়াদি ঋণ হয়ে আটকে গেছে। আর ব্যাংকগুলোও যাচাই-বাছাই বা ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ ছাড়াই এই বিপুল অর্থায়ন করে এখন ফেঁসে গেছে। এসব অর্থায়নই সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর নগদ সংকটের অন্যতম কারণ।

সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা তাঁদের এই অর্থায়নগুলো ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মেয়াদের জন্য পুনঃ তফসিল করে নিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে এখনো এর কাজ চলছে। ফলে স্বল্প মেয়াদে ৯০ দিন কিংবা ১২০ দিনে যে অর্থ ব্যাংকের কাছে ফিরে আসার কথা ছিল, তা এখন মেয়াদের ভিন্নতায় পাঁচ বছর অথবা তারও বেশি সময় ধরে ব্যাংকে আসবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এর সুদ মওকুফসহ নানা ধরনের মুনাফা ছাড় ও কিছু ক্ষেত্রে খেলাপি হয়ে পড়ায় নতুন প্রভিশনিংয়েরও প্রয়োজন হয়েছে। যাতে নিট মুনাফা কমে গেছে।

শেয়ারের মূল্যপতন: শেয়ারবাজারে নানাভাবে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো ব্যাংক। তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ আছে, তেমনি গ্রাহককেও ঋণ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক ঋণ (মার্জিন লোন) সীমা অনুসরণও হয়নি। আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বহুবার এই সীমা পরিবর্তন করেছে। এখন শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় মার্ক টু মার্কেট (বাজারদরে সমন্বয়) রাখতে গিয়ে নতুন করে প্রভিশন করায় নিট মুনাফায় প্রভাব পড়েছে।

সূত্রঃ প্রথমআলো,২১/১১/২০১২।