বিনা ভোটে জয়ী আর সহিংসতার ইউপি নির্বাচন

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 Feb 2012, 05:44 AM
Updated : 31 Dec 2021, 12:50 PM

দেশে বিভিন্ন নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার এক নতুন ধারা চালু হয়েছে। এর আগে এমপি, মেয়র পদে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার হিড়িক পড়েছে। চার ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে মোট এক হাজার ৩৫৯ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন৷ যারা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বলতে গেলে সবাই সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী৷

আগামী ৫ জানুয়ারি শুধু পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচন৷ সেখানেও ৫২ জন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন৷ তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাদের বিপক্ষে কেউ মনোনয়নও জমা দেননি। তার মানে তারাও বিনা ভোটেই জয়ী হবেন। নির্বাচনের আগেই জয় পাওয়ার এই ধারা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত দুঃসংবাদ।

বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা স্থানীয় প্রভাব, ভয়ভীতিসহ নানা কৌশল অবলম্বন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা ছাড়াও প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে মারধর, ভোটকেন্দ্র দখল ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করছে না। তারপরও সহিংসতা থেমে নেই। সবাই যেকোনো উপায়ে ভোটে জয়ী হতে মরিয়া৷ কারণ নির্বাচিত হলে আয়, বাণিজ্য হবে৷ সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা তাদের লক্ষ্য নয়৷ ফলে বিএনপি না থাকলেও নিজেরাই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে৷

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভালো দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করার রীতি খুব একটা দেখা যায় না। নেতিবাচক বিষয়গুলোই বেশি বেশি চর্চা করা হয়। ফলে রাজনীতির গুণগত মান বাড়ে না। একটু একটু করে রাজনীতি বরং অধঃপতনের দিকেই এগিয়ে যায়। মানুষ রাজনীতির প্রতি আস্থা হারায়। দুর্বল হয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ নিয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো বিকার আছে বলে মনে হয় না। এমনিতেই আমাদের দেশে নির্বাচন, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মনে প্রবল অবিশ্বাস ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মনে রয়েছে প্রবল সংশয়। বিভিন্ন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের ক্রমাগত হস্তক্ষেপের ফলে বিরোধী পক্ষ নির্বাচনে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। এর ফলে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির এই সিদ্ধান্ত এমনিতেই নির্বাচনী গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিয়েছে। কেননা সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচন আসলে সফল হয় না।

এখন এই দুর্বল ব্যবস্থাটাও আরও দুর্বল করার একটা চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাচনের মাঠে থাকা দলগুলোও ভোটের বদলে নতুন কারসাজিমূলক একটা ব্যবস্থা চালু করতে চলেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে 'সমঝোতা'। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজনকে নির্বাচিত হওয়ার পথ তৈরি করে দিতে এই সমঝোতার খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন গোপনে। এর আগে জাতীয় সংসদের কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) ও ঢাকা-১৪ আসনের উপনির্বাচনে এই 'সমঝোতা' লক্ষ্য করা গিয়েছিল। 'আর্থিক সুবিধা' নিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে। জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে, লক্ষ্মীপুর-২ আসনে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে জাপার প্রার্থী ছিলেন দশম সংসদের এমপি ও জাপা নেতা মোহাম্মদ নোমান। জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে এই আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে ভোটের কয়েক দিন আগে হঠাৎ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাপার নোমান। এতে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম হয় 'আপেল' প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের। '১২ কোটি টাকার খেলা'য় নোমানের সে সময় ভোটের মাঠ থেকে সরে যাওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। পরে অর্থ ও মানব পাচারের অপরাধে কুয়েতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পাপুল। কুয়েতের আদালতে সাজা হওয়ায় এমপি পদ হারান তিনি।

কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, স্থানীয় সরকারের পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও বিভিন্ন সময়ে জাপার প্রার্থীরা সমঝোতা করে ভোট থেকে সরে গেছেন বলে অভিযোগ আছে। এটা সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি যে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে, তার নগ্ন রূপ হচ্ছে মনোনয়ন বিক্রি করে দেওয়া। এর ফলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের পথ আরও সুগম হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুস্থধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা। বহু বছর ধরেই দেশে এক ধরনের ভোটাধিকারহীন পরিস্থিতি চলছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। কমিশন মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে নাগরিক সমাজ অভিযোগ করে আসছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে এক ধরনের জবরদস্তি ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের অপসংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌর ও সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা নিয়ে সংঘর্ষ ও মারামারি করে নির্বাচন করার প্রবণতাও এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য়ণীয়।

নির্বাচন নিয়ে সমালোচনাকে সরকার ও নির্বাচন কমিশন খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। বরং নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের সন্তুষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের এই মনোভাব দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকারকে কোন প্রান্তে নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলা। আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভোটাধিকারকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক অবস্থায় ফিরে আসবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন যতই বলুক, নির্বাচন সুষ্ঠ হচ্ছে, তা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য হলেও তারা ভালো করেই জানে এটা কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা নয়।

কোনো দেশের সরকারই চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না। কোনো না কোনো সময় বিদায় নিতে হয়। যে সরকার গণতন্ত্রমনস্ক এবং জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়, সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে তার পরাজয় হলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়াটাই রীতি। আর যারা যেনতেন নির্বাচন করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তাদের বিদায় সুখকর হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনার মাধ্যমে তৃতীয় শক্তির দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়, না হলে গণ-আন্দোলনের মুখে নাস্তানাবুদ হয়ে তাদের বিদায় নিতে হয়। আমাদের দেশে এমন নজির রয়েছে। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারী সরকার ৯ বছর ক্ষমতায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার বিদায় সুখকর হয়নি। আবার গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে ওয়ান-ইলেভেনের মতো সরকারও দেশে গঠিত হয়েছে।

দেশে প্রায় এক দশক ধরে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। বরং একে কারসাজি ও জবরদস্তিমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা বলা যায়। এ ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থার অবসান কবে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা কবে ফিরে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবহ না করে এবং তাতে হস্তক্ষেপ না করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। কিন্তু এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানোর ব্যাপারে ভূমিকা পালন করা, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে ভোটারদের সচেতন ও সংঘবদ্ধ করা, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনসহ স্থানীয় প্রশাসনকে বাধ্য করা, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে ক্ষমতাসীনদের নানামুখী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং প্রয়োজনে গণআন্দোলন গড়ে তোলা। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজগুলো করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। এর পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করা, টাকার বিনিময়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা কিংবা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে 'ওয়াক ওভার' দিয়ে দেওয়ার মতো নীতিহীন প্রবণতার দিকেই ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনসহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুস্থ, সবল, কার্যকর করার মধ্য দিয়েই একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকশিত হতে পারে। স্বাভাবিক ও সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই পারে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে। সুবিধাবাদিতা, অর্থের কাছে বিক্রি হওয়ার প্রবণতা যদি সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের আচ্ছন্ন করে রাখে তাহলে দেশে সুস্থ রাজনৈতিকচর্চা কীভাবে বিকশিত হবে? আর রাজনৈতিক সুস্থতা ছাড়া সুস্থ দেশ, সুস্থ সমাজ গঠন কীভাবে সম্ভব? বিবেকহীনতা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেশবাসী কী আর কিছুই পাবে না?