এমন লাইনে দাঁড়ানো সততা ও গর্বের

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 20 Feb 2012, 07:46 AM
Updated : 11 March 2022, 07:16 PM

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অর্থ খাদ্যপণ্যসহ সবকিছুর দামই বেড়ে যাওয়া। ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পৃথিবী জুড়েই যার প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। নিজ দেশের চাহিদা অনুযায়ী জোগান ঠিক রাখতে এখন অনেক দেশ খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপের চিন্তাও করছে। যেটি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে শস্য উৎপাদন, ভোজ্য তেলের জোগান এবং সার রপ্তানি হুমকিতে পড়ে। নিত্যপণ্যের দাম রকেট গতিতে বাড়তে শুরু করে। জ্বালানির বাজারে বিশৃঙ্খলা ওই সংকটকে আরও ঘণীভূত করেছে।

বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার প্রভাব দেশে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কীভাবে তার আঁচ থেকে গরীব ও স্বল্প আয়ের মানুষদের বাঁচানো যায় সেটাই তো সরকারের দায়িত্ব হওয়া উচিৎ। সরকার রাতারাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, এটা সবাই জানেন। কিন্তু এমন ব্যবস্থা সরকার অবশ্যই নিতে পারে, যাতে সহনীয় দাম দিয়ে বাজার থেকে সবাই জিনিস কিনে বাঁচতে পারে। 

আজকের বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের হাল বড় করুণ। দেশে না থাকলেও আমরা বুঝি। অনেকেই চক্ষু লজ্জার খাতিরে বলতে না পারলেও, তাদের জীবনে এখন নাভিশ্বাস উঠছে। সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য তা স্বীকার করেন না। বিলাস আর আরামে থাকা মানুষের মাথায় কতো ধরনের চিন্তার উদয় হতে পারে, তা এদের কথা না শুনলে বোঝা মুশকিল। যেমন আজ জানলাম- কৌশলে নাকি বিএনপি বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে তুলেছে!

এমন কথা শুনলে যেকোন অর্থনীতিবিদের হার্ট ধড়ফড় করার বিকল্প থাকবে না। আর যদি ধরে নেই মহাশক্তিশালী বিএনপি বা তেমন কোনও বিশেষ শক্তি বা দল এমন কাজ করেছে, তো আপনারা কী করছেন? আপনারা তো দেশ শাসনে এক যুগের কাছাকাছি সময়। কাজেই এদের 'ষড়যন্ত্র' ব্যর্থ হয়ে পালাবার পথ পাবে না- তেমন ম্যাজিকই জনগণ আশা করে। সেটা না করে এমন ঢালাও দোষারোপ হাস্যকর হয় না? 

বাংলাদেশ একসময় বিদেশের কাছে হাত পাততো। কথায় কথায় অনুদান আর সাহায্যের জন্য আবেদন জানাতো। কতো ধরনের সাহায্য আর সহযোগিতা যে আসতো তা বলাই বাহুল্য। সেসব বিষয়ের সাথে রাজনীতি জড়িয়ে ছিল আষ্টেপৃষ্টে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য আর ইউরোপের সাহায্য ছিল পরনির্ভরশীলতা তৈরি করে ভূ-রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষত তখনকার লিবিয়া বা গাদ্দাফীর মতো শাসকের কাছ থেকে যা আসতো তার পেছনে ছিল কথিত বিপ্লবের প্ররোচনা। ধারণা করা হয়, সে সময়কালে জামাত-শিবিরের রমরমা অবস্থা আর তাদের বিস্তারের পেছনে এই টাকাপয়সা ব্যাপক অবদান রেখেছিল। আজ তো পরিবেশ ভিন্ন। আজকের বাংলাদেশ অনুদান বা সাহায্য নির্ভর নয়। বরং উপচে পড়া রিজার্ভ থেকে ডাকাতি হলেও তা সামলে নিতে পারে দেশ । শ্রীলংকার মতো দেশকেও ঋণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় আমাদের দেশ। উন্নয়নের একটা ঢেউ যে লেগেছে সেটা দৃশ্যমান। তবে দৃশ্যমানতার বাইরে আরও কিছু অদৃশ্য বিষয় থাকে, যেগুলো আমলে নেওয়া জরুরী। বাজারের উপর জনগণের আস্থা ঠিক এমন একটি বিষয়। 

গত দুই বছর কোভিড সংক্রমণে দুনিয়ার বড় বড় দেশগুলো বিপদের মুখে। জীবন মরণের লড়াই সামাল দিতে দিতে অর্থনীতি চলে যাচ্ছে হাতের বাইরে। এই যেমন ধরুন- আমি যে সিডনিতে থাকি এখানে কোভিড তো রয়েছেই, তার ওপর চলছে বন্যা। এতো বৃষ্টি হয়েছে যে, এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল সিডনির আকাশে একটা ছাদ থাকা দরকার। স্বাভাবিক কারণেই এমন সব বিপর্যয় মানবজীবনকে পর্যুদস্ত করে তোলে। এর ভেতর রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেইন। গ্লোবাল ভিলেজের এ যুগে যুদ্ধ লাগলে সেটি আর দুইটি দেশের ব্যাপার থাকে না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাট্টা ইউরোপের দেশগুলোর জোট, ন্যাটো এবং আমেরিকা বিধিনিষেধ আরোপ করছে একের পর এক। স্বাভাবিকভাবেই তেল গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী। আর এ কথা কে না জানে জ্বালানির সংকট মানেই যাবতীয় বিষয়ে সংকটের দুয়ার খুলে যাওয়া।

বিশ্বের সবদেশের হর্তাকর্তারাই স্বীকার করছে এবং করে যে- তাদের দেশে সমস্যা আছে এবং সরকার চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে। একমাত্র আমাদের দেশেই এসব স্বীকার করার কোনও রেওয়াজ নাই। যখন যারাই ক্ষমতায় যান- তারা স্বীকার করতে চাননা যে তাদের কোনও ভুল আছে বা থাকতে পারে। বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে জিনিসের দাম বাড়তেই পারে- এটা স্বীকার করে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কারণগুলো তুলে ধরলে আওয়ামী লীগ বা দেশের সরকারের কী লোকসান হতো তা ঠিক বুঝি না।

কথা এখন ছবিতেও প্রকাশ্য । কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকের সামনেও বেড়েছে ভিড়। মাঝে মাঝেই এই ভিড় রূপ নিচ্ছে লড়াইয়ের। সেই সঙ্গে ট্রাকের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষার মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। স্বাধীনতার পরপর আমরা ন্যায্য মূল্যের দোকান বা রেশনের দোকান নামে কিছু দোকানের নাম জানতাম। ওইসব দোকানের নামে লাইন লাগিয়ে আটা-ময়দা-চিনি, এমন সব নিত্যপণ্য কিনে আনতাম । বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের আমলে এমন দোকানে লাইন দিয়ে দাঁড়ানোতে সম্মান-অসম্মানের কিছু ছিল না। কারণ তখন দেশের ৯০ ভাগ মানুষই ছিলেন এক কাতারে।

দিনে দিনে আমাদের দেশে 'আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এতো বেড়েছে যে, তাতে সবারই মনে হতে পারে তারাও একেকটি কলাগাছ । কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হলে বোঝা যায় এই ধনী-লুটেরা আর সুবিধাভোগীর সংখ্যা হাতে গোণা। যারা দাম আকাশে উঠলেও বাজারে গিয়ে হাঁক দিতে পারেন 'বড় মাছটি আমাকে দে' বলে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের পর সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনে লেগেছে পরিবর্তনের মন্দ হাওয়া। কারও চাকরি গেছে, কারও গেছে টিউশনি, কারও বা বাড়তি আয়ের পথ গেছে বন্ধ হয়ে। কোথায় যাবেন এরা? কার কাছে হাত পাতবেন?

আমি বলি আপনি ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ আপনার দলে। তাদের তেল আনতে বেগুন ফুরায়। তাদের ভাত আছে, তো ডিম নাই। ডিম আছে তো পেঁয়াজ নাই। যে সব মানুষেরা কথিত ফুটানি দেখিয়ে আড়চোখে তাকায় তাদের পরিচয় জানুন। এদের অধিকাংশ কোন কাজ করে না। এদের ধরাবাঁধা চাকরি বা ব্যবসাও নাই। কী আছে? ফড়িয়াবাজি আর টাউটগিরি। রাজনীতি দল আর মাস্তানতন্ত্র কিংবা নেতিবাচক কাজে লিপ্ত মানুষ আর আমজনতা কি এক? আপনি হয় একজন শিক্ষক বা একজন বাদ্যযন্ত্রী। আপনি হয়তো একজন কেরানি নয়তো অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মচারী। আপনার পরিচয়, আপনার গৌরব। আপনি টিসিবির লাইনে দাঁড়াবেন মাথা উঁচু করে। আপনি বা গৃহকর্মী সে যেই হোক আপনারাই  সৎ ও পরিশ্রমী মানুষের মুখ। আপনারা লাইনে দাঁড়িয়ে ন্যায্য মূল্যে টাকা দিয়ে জিনিস কিনছেন, কারো হক কেড়ে খাচ্ছেন না। চুরি বা ডাকাতি করছেন না। আপনাদের পেছনে পুলিশ বা অন্য কেউ ঘুরঘুর করে না। আপনারা এদেশের অসাধারণ সব সাধারণ মানুষ।

ভয় লজ্জা এসব বাদ দিয়ে লাইনে দাঁড়াবেন এবং নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাবেন। সরকার বা রাজনীতি যাই বলুক- সবার আগে জীবন।