যত্রত্ত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছে জিম্মি সাধারণ নাগরিকগণ

এম এ হাশেম
Published : 3 June 2012, 05:04 PM
Updated : 3 June 2012, 05:04 PM

ছাত্র জীবনে পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে যখন দেখতাম তোমার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে একটি রচনা লিখ। তখন আমরা অনায়াশে লিখে ফেলতাম, আমি বড় হয়ে একজন ডাক্তার হব, এলাকায় একটি হাসপাতাল করবো, সেখানে গরীব অসহায় মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেবো, এরকম আরও অনেক নীতিবান বাক্য। আমার মনে হয় বর্তমানে যারা ডাক্তার হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে এরূপ নীতিবাক্য গুলো লিখেছে। কিন্তু এরূপ নীতিবাক্যের ডাক্তার গুলো কিরুপ নীতিহীন কাজ করিতেছে তা দেখতে হলে যত্রত্ত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোতে যেতে হবে।

আমরা গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ, সহজ সরল মানুষরা যখন কোন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হই তখন ছোটে যায় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারদের আমরা দেবতা মনে করি, এই দেবতারা যাই বলেন যাই নির্দেশ দেন তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। মনে হয় সৃষ্টিকর্তার নির্দেশও আমরা এভাবে পালন করি না, কয়টা দিন বেশী বেঁচে থাকার আশায় ডাক্তারদের নির্দেশ যেভাবে পালন করি। এইভাবে যদি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালন করতাম তাহলে দুনিয়াতে এমন অনাচার থাকত না। কিন্তু এই দেবতা তুল্য কিছু অসাধু ডাক্তার আমাদের এই সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের সাথে করে যাচ্ছে মহা প্রতারণা।

গ্রাম অঞ্চলে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোকে কেন্দ্র করে তাদের প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেন। সে সমস্ত ডাক্তারগণ যাদের অনেকে অর্ধ ডিগ্রী বা ডিগ্রীহীন, আবার এই সমস্ত ক্লিনিক থেকে ভুয়া এমবিবিএস আবিস্কার করে গলায় জোতার মালা দিয়ে রাস্তায় হাটাতেও দেখেছি। এই সমস্ত অর্ধ ডিগ্রী বা ডিগ্রীহীন ও ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তারগন মুলত আসন পেতে বসেন এই সমস্ত ক্লিনিকে।

তারা ক্লিনিকের মালিকের সাথে চুক্তি করে ক্লিনিকে বসেন। চুক্তি থাকে যে প্রতিটি রোগীর ব্যবস্থাপত্রে দরকার হউক বা না হউক অবশ্যই পরীক্ষার জন্য লিখতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষাতে ডাক্তারের জন্য ৩০-৪০% কমিশন থাকবে। যদি পরীক্ষার কথা না লিখেন তাহলে ঐ ডাক্তারের স্থান হবে না। এই সমস্ত ডাক্তারগণ মোটা অংকের কমিশন ও একটা স্থান পাওয়ার আশায় গ্রাম অঞ্চলের সহজ সরল মানুষ গুলোকে রোগ নির্ণয়ের নামে অযৌক্তিক কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে করছেন হয়রানি ও অর্থনৈতিক ভাবে করছেন সর্বস্বান্ত।

কথায় আছে, একজন ভাল ডাক্তার যদি রোগীর ক্ষতস্থানে হাত দেয় তখন রোগীর রোগ ৫০% ভাল হয়ে যায়। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলের এই সমস্ত ভুয়া ডাক্তারগণের ব্যবস্থা পত্র দেখে রোগীর রোগ ১০০% বেড়ে যায় এবং সাথে থাকা সুস্থ অভিভাবকও অসুস্থ হয়ে যায় তাতে কোন সন্দেহ নেই।

তাঁর প্রমাণ গত শুক্রবার একজন রোগীর সাথে আমি এমনি একটি ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। যার সাথে গিয়েছিলাম তাঁর পায়ে ব্যথা। আমাকে বলছে আমার সাথে একটু চল, আমিও গেলাম। নির্দিষ্ট ক্লিনিকে ঢোকে জানতে পারলাম ডাক্তার ব্যস্ত আছেন। তাই আমার সাথে যাওয়া রোগীকে বললাম আপনি একটু বসেন আমি আসরের নামাজটা পড়ে আসি, এবং কমান্ডারকে বললাম ডাক্তার ফ্রি হলে আমার রোগীকে সিরিয়াল দিবেন। আমি নামাজ পড়ে এসে দেখি আমার সাথে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা শেষ, হাতে ধরিয়ে দিয়েছে ৪ রকম পরীক্ষা সম্বলিত ব্যবস্থা পত্র এবং পরীক্ষার নির্দিষ্ট ফিও দেওয়া হয়ে গেছে। পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে এক্স-রে, রক্ত, পায়খানা ও প্রস্রাব পরীক্ষা। এক্স-রে টা যৌক্তিক মনে হলেও বাকী তিনটা আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হল। তাই কাউন্টারে জানতে চাইলাম এই পরীক্ষা গুলো কেন এবং পায়ে ব্যথার সাথে পায়খানা প্রস্রাবের সম্পর্ক কি? সে আমাকে জানাল সেটা ডাক্তার জানে, তাই তাঁর সাথে বেশী কথা না বলে ডাক্তারের দিকে ছুটলাম। তখন দেখি প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ ব্যবস্থা পত্র হাতে হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমি ডাক্তারের দিকে না গিয়ে ঐ বৃদ্ধার কাছে গেলাম। জানতে চাইলাম চাচা আপনার সমস্যা কি? আপনি এইভাবে দাঁড়িয়ে রইছেন কেন? তখন ঐ বৃদ্ধার মুখ থেকে যা শুনলাম, তিনি একজন গরীব কৃষক কোন রকমে ৫০০ টাকা জোগাড় করে বুড়িকে নিয়ে আসছেন ডাক্তারের কাছে, তাঁর কোমরে ব্যথা। তাকে দিল ৩টা এক্স-রে সহ ৬/৭ রকম পরীক্ষা, বিল আসল ২৫০০+৩০০=২৮০০ টাকা। এই বিলের কথা শুনে বৃদ্ধ হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন বৃদ্ধকে আর কি বলব, বললাম চাচা আপনি এখানে আসছেন কেন? এখানে আসে তো বড় লোকেরা, আপনাদের মতো গরীব লোকের জন্য তো এই ক্লিনিক নয়। আপনার জন্য তো সরকারী হাসপাতাল। সরকারী হাসপাতালে গিয়েও কি হবে সেখানেও তো কর্তব্যরত ডাক্তারগণ ব্যস্ত থাকে প্রাইভেট চেম্বার নিয়ে তারাও রেপারট করে দেন ক্লিনিকে। অথবা হাসপাতালে কর্মরত কর্মকর্তা চিকিৎসা ব্যতিরেকে কিছু ট্যাবলেট হাতে ধরিয়ে দেয় তাতে চিকিৎসা শেষ।

ডাক্তারদের এমন কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় আল্লাহ্‌ আমাকে অনেক দয়া করেছে আমাকে অন্তত ডাক্তার বানায়নি। যদি আমাকে ডাক্তার বানাত আমিও হয়ত এইসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতাম। তাদের এই সব কর্মকাণ্ড দেখে আমি শপথ করেছি আমার ছেলে-মেয়েদের কখনো ডাক্তার বানাবো না। ডাক্তারদের প্রতি একটা ঘৃণা জন্মে গেছে। তাই বর্তমানে যারা জিপিএ-৫ পেয়ে ডাক্তার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের কাছে অনুরোধ তোমরা মানুষের কল্যাণে ডাক্তার হও বর্তমান ডাক্তারের মতো মানুষ মারার ডাক্তার হইয়ো না।

এই দেবতাতুল্য ভুয়া ডাক্তারদের থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই? আমরা কি পাব না তাদের কালো হাত থেকে নিস্তার। প্রশাসনের দৃষ্টি কি এদিকে পড়ে না? আমরা মুক্তি চাই। আমি বিশ্বাস করি একদিন এই সমস্ত ক্লিনিকের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষ সোচ্চার হবেই।