সড়ক দুর্ঘটনাঃ আনন্দ যাত্রাকে শব যাত্রায় পরিণত করবেন না

মাধুরী শিকদার
Published : 9 April 2015, 07:49 PM
Updated : 9 April 2015, 07:49 PM

সকালে ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে একটি খবর আমাকে নিস্তদ্ধ করে দিল। আবারো পাথর চাপা একটা কান্না এসে বুকে ভর করলো। সবকিছু বাদ দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। একটু স্বাভাবিক হতেও বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। কিন্তু, জীবন চলার স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে। আর এটা থাকবে আরো বেশ কিছুদিন। জানি, সেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে আসতে হয়তো আবার ঠিক এমনই একটা ঘটনা ঘটবে। ঘটতেই কি থাকবে এমন?

আসল কথায় আসি, আমি বলছি কাল রাতে ফরিদপুর এ ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটার কথা।যেখানে েএই পোষ্ট লেখা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২৫, আহত ২১। নিশ্চিত এ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। আর যারা আহত, তাদের বেঁচে থাকার জন্য জীবনের যে মানে দরকার সেটাই এ দুর্ঘটনার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। আমি যাত্রা পথে নিজের অনুভূতি দিয়ে বুঝি। হাইওয়ে যাওয়া আসার সময় আমি তো বাস একটু জোড়ে ব্রেক করলে অথবা কোন বাসকে জায়গা দিতে গিয়ে একটু বেশি বামে চলে গেলেই ভয়ে আৎকে উঠি। সবসময় আমি আমার একটা স্বাভাবিক মৃত্যু কামনা করি। আর একটি স্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিটা মানুষেরই অধিকার। একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার প্রিয়জনেরা তাকে শেষ দেখাটাও যদি স্বাভাবিক ভাবে দেখতে না পারে এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে? একবার আমার পাশের বাড়ির এক কাকিমা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আমি তার লাশ দেখতে গেলে আমাকে অনেকেই বলেছিল না দেখতে। তবুও আমি জোড় করে দেখেছিলাম। আর সেদিন যদি ওই কাকিমার লাশ আমি না দেখতাম তাহলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদেহ যে কতটা বিভৎষ্য হতেপারে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার হতোনা। সেদিনের ঘটনার পর আমি বহু রাত ঘুমাতে পারিনি স্বাভাবিকভাবে। কতবার যে আমি ঘুমের মাঝে চিৎকার করে উঠেছি তার কোন হিসেব নেই। আর নিজের এইটুকু অভিজ্ঞতা থেকেই আমি সবসময় প্রার্থনা করি প্রতিটা মানুষের সুস্থ আর স্বাভাবিক মৃত্যুর। আজ যারা প্রাণ হারিয়েছে তারাতো মারা গিয়ে বেঁচে গেছে। আর যারা আহত তারা বেঁচে থেকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত একটু একটু করে মরবে। আর সেই সাথে নিহত আর আহত প্রতিটা পরিবারেই চলতে থাকবে আমৃত্যু কান্না। স্বজন হারানো যে তীব্র কষ্ট, সেটা তাদের কে বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন। আর প্রতি বছর এত এত সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবিতে এত এত করুণ মৃত্যু, এত এত পঙ্গুত্ব বরনের মিছিল, এ যেন আমাদের সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবন ধারনের স্বকীয়তাকেই হারিয়ে ফেলছে। আমরা যারা বাড়ি থেকে দূরে থাকি তাদের বাড়ী যাওয়া মানে যেন একটা উৎসব। যতবার বাড়ীতে যাই যাওয়ার সময় প্রতি ৩০মিনিট পরপর আমার মায়ের ফোন, সাথে বাবা, ভাই-বোন দের ফোন তো আছেই। আমি জানি তারা কেন এতবার ফোন করে। শুধু এটুকুই তাদের চাওয়া যাত্রা পথে তাদের প্রিয়জন নিরাপদে আছে তো!  আর যখন বাড়ি পৌঁছাই, তখন গিয়ে দেখি আমার কতজন প্রিয়জন আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তারা যেন আমার নিরাপদে ঘরে ফেরার আনন্দে তখন কি এক স্বর্গীয় আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে।

আর আমরা প্রতিটা মানুষই যখন প্রিয়জনের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেই তখন এই আনন্দটা তাদের চোখে মুখে দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি। কিন্তু সেই আনন্দের বদলে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু যদি কোন প্রিয়জনকে পেয়ে বসে তখন যে স্বজন হারাদের কি অবস্থা হয় সেটা শুধু যে হারায় সত্যিকারভাবে সে ই উপলদ্ধি করে। কিন্তু, আমাদের একান্ত কাম্য এই উপলদ্ধিটা সড়ক দুর্ঘটায় সংশ্লিষ্টদের ভিতরও আসুক। শুধু একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নিহতদের দাফনের ব্যবস্থা, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা, শোক প্রকাশ আর দুর্ঘটনার কারন খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটি করলেই এমন দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়। আমার তো মনে হয় কোন একজনকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার অন্যান্য শর্তের পাশাপাশি তার মানবিক গুনাবলি, তার মানসিক দক্ষতা, বিপদে কার্যকরী কৌশল খুঁজে বের করা কিংবা বিপদে তার ব্রেইন কতটা চাপ নিতে পারে এমন বিষয়েরর উপর পরীক্ষা নেয়া দরকার। যদি এইসব পরীক্ষায় সে পাশ করে যায় তাহলে বোঝা যাবে যে সে একজন দক্ষ চালক, পাশাপাশি কিছু ভালো গুনাবলী সম্পন্ন একজন মানুষও। আর এমন একজন চালক যখন হাইওয়ে তে গাড়ী চালাবে তখন তার ভিতর সবকিছুর পাশাপাশি তার যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার তাগিদ থাকবে। ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর জন্য যারা দায়ী তাদের উপযুক্ত শাস্তী হওয়াটাও খুবই জরুরী। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, এমন নজির আমাদের দেশে খুব কমই আছে।

তাই এমন মৃত্যুর মিছিল কমিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্টদের সত্যিকারভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি। আমরা সুস্থ আর নিরাপদ জীবন চাই। আমাদের সকলের যাত্রা আশংকার নয় আনন্দের হোক এটা চাই। আমরা সবাই স্বভাবিক মৃত্যু চাই। আমাদের আর কারো প্রিয়জনের কান্নায় আমাদের আকাশ বাতাস ভারী হোক আমরা এটা চাইনা। তাই সংশ্লিষ্টদের প্রতি আকুল আবেদন প্লীজ ঘরে ফেরার আনন্দ যাত্রাকে শবযাত্রায় পরিণত করবেন না।