মঙ্গল শোভাযাত্রার আলো যেন তিমিরে হারিয়ে না যায়

মাধুরী শিকদার
Published : 16 April 2015, 08:27 PM
Updated : 16 April 2015, 08:27 PM

নতুন বছর মানে নতুন আশার আলো। সব কিছু নতুন করে গুছানো, নতুন করে সব কিছু শুরু করা। অন্য আর সব বাঙালীর মতো আমিও আশা করেছি নতুন বছরে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু পবিত্র, যা কিছু আলোকিত করে আমাদের অন্তরকে সে সব কিছু দিয়েই শুরু হবে আমাদের ১৪২২ নতুন বঙ্গাব্দ। আর এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে আগামী ৩৬৫ দিন, নতুন ১৪২৩ আবার আসবে একই প্রত্যাশা নিয়ে। ছোট বেলা থেকেই চৈত্র সংক্রান্তি মানেই সীমাহীন আনন্দ, নতুন বছর আসছে। নানারকম আচার বিধি পালন শুরু হতো চৈত্র সংক্রান্তিতেই, আর পহেলা বৈশাখ সেটা আরো নতুন মাত্রা বয়ে নিয়ে আসতো, চলতো প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। এসময় নানারকম ধর্মীয় বিধি পালন করতে হতো আমাদের। বছরের শুরুর দিনটাতে অনেক বড়দের দেখতাম সারাদিন কথা না বলে উপবাস থাকতে। খুব ছোটবেলায় যখন এর মানে বুঝতামনা তখন একবার আমি আমার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে নববর্ষের এমন আনন্দের দিনে অনেকেই কথা বলেনা কেন? মা বলেছিল সারাবছর যেন সুন্দর আর সংযমের সাথে কাটাতে পারে তার জন্য এই সাধনা। আমি অবাক হয়ে ছিলাম সেদিন, একটা বছর সুন্দর আর ভালো মানুষ হয়ে কাটানোর জন্য মানুষের কত প্রচেষ্টা।

আর আজ আবার অবাক হচ্ছি, তবে আজ আর সুন্দর আর আলোকিত কিছু দেখে নয়। আজ আমি অবাক হচ্ছি আমাদের মানবিক বিপর্যয় দেখে। নতুন বছরের প্রভাতে আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রা করি। যার উদ্দেশ্যই হচ্ছে কিছু মঙ্গল প্রার্থনার। আর সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার দিন সূর্যাস্ত হতে না হতেই ঘটে যায় সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক কিছু ঘটনা। নারী জাতির উপর হামলা, তাদেরকে হাজারো জনতার ভীরে বিবস্ত্র করে দেয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে আমাদের প্রগতীশীল যুবসমাজ!!! এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি হতে পারে? খুবই আশ্চর্যের সাথে খেয়াল করলাম, এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটার পরও কিছু কিছু পুরুষ (মানুষ) খুব বেশি গলাবাজি করছে মেয়েদের পোশাক নিয়ে। পহেলা বৈশাখের মত অনুষ্ঠানে অধিকাংশ নারীই শাড়ী পরে। যে গুটি কতক শাড়ী না পরে আর যাই হোক তাদের কাউকে অন্তত এমন পোশাক পরতে আমি দেখিনি যেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় বা কটাক্ষ করা যায়। আর ধরেই নিলাম যে,  কেউ এমন পোশাক পরেছে যেটা উগ্র আধুনিকতার বহিঃপ্রকাশ করেছে। তাই বলে সেই নারীর উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পরাটা কোন সভ্যতা বহন করে? আমি ভেবে অবাক হই যে, নারীদেহ নিয়ে কতটা বাজে ভাবনা থাকলে বা চিন্তা চেতনায় কতটা বিকৃতি থাকলে এমন জনারণ্যেও নারীকে ভোগের সামগ্রী ভেবে তার উপর হামলে পরা যায়। এটা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রমাণ বহন করে। আর সমাজের ক্ষুদ্র অংশ পরিবার। পরিবার থেকে যতক্ষণ কোন সঠিক শিক্ষা না আসবে ততক্ষণ এইসব মানুষরূপী হায়নাদের কোন শিক্ষাই হবেনা। এরা এমনটাই চালাতে থাকবে। নারীর প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ তার নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকেই শিখে আসতে হবে। এটা বই পড়িয়ে বা এদেরকে কোনো রকম দিকনির্দেশনা দিয়ে কোন লাভ হবেনা। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ যাদের হৃদয়ে নেই তাদেরকে হয়তো শাস্তির ভয় দেখিয়ে কিছুটা হলেও এমন অপকর্ম থেকে দূরে রাখা সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা আরো খারাপ। কথায় আছে আইন নাকি অন্ধ। আর আমাদের দেশের আইনতো আরো বেশি অন্ধ। কারণ, এখানে আইনের হাতে যাওয়ার আগেই অপরাধী উধাও হয়ে যায়। আমাদের দেশের জনগনের টাকায় েযে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গঠিত, সেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বারবার এমন অপকর্মগুলো ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। বারবার কোন ঘটনা ঘটার পর তারা শুধু তদন্ত কমিটি গঠন করে কিছু দিন হয়তো নিরীহ সাধারন জনগনের হয়রানি করে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ আসল অপরাধী থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এমনটা ঘটতে থাকে বলেই বারবার ঘটে যাচ্ছে এমন অপ্রিতীকর ঘটনা। জীবন দিতে হচ্ছে দেশের অনেক প্রগতিশীলদের। আজ শাহবাগের ঘটনার জন্য হােইকোর্ট রুল জারি করল পুলিশ আর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু, এসব করে লাভ কী? এটা তো শুধু লোক দেখানো।

আদালতের নির্দেশ পালন করতে যে প্রতিবেদন আদালতে পেশ করা হবে সেটাতে কি আসল অপরাধীদের তালিকা থাকবে? নাকি আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে? যদি সেটা্ হতো তাহলে ঘটনার সময় প্রতিবাদকারী লিটন নন্দী সহ কয়েকজন যাদেরকে ধরে পুলিশে দিয়েছিল পুলিশ কেন তাদেরকে ছেড়ে দিলো? কেন তাদেরেকে এ বিষয়ে সুরহা না হওয়া পর্যন্ত পুলিশী তত্বাবধানে রাখা হলোনা? তাদেরকে ঐসময় ছেড়ে না দিলে কিছুটা হলেও পুলিশের আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যেতো। হয়তো মূল অপরাধীরাও সহজেই চিহ্নিত হতো। ঘটনার সময় কর্তব্যরত পুলিশের থেকেও কোনরকম সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে শাহাবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি শুধু আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলেন। কতটা হাস্যকর ব্যাপার তাইনা? শুধু দুঃখ প্রকাশ করলেই হলো? তখন ঘটনাস্থলে যেসব পুলিশ কর্তব্যরত ছিলো কিন্তু সঠিক ভাবে কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে তাদেরকি কোন রকম শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে? এমনটা তো শুনিনি। কাউকে কোন দ্বায়িত্ব দিলে সে যদি সেই দ্বায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না েকরে, উল্টা তার উপস্থিতিতে যদি সেখানে কোনো বিপত্তি ঘটে তাহলে তো সেই কর্তব্যরতর এজন্য শাস্তি হওয়া উচিত।আসলে আমাদের সরষের মাঝেই ভূত থাকায় আমরা সাধারণ জনতা যেন জিম্মি হয়ে আছি। পুলিশ প্রশাসন যতদিন না তাদের মানবিক গুনাবলীগুলোকে শানিত না করবে, যতদিন না তারা জনগনকে নিজের মনে না করবে ততদিন তাদের দ্বায়িত্বে কোন আন্তরিকতা আসবে বলে মনে হয়না।যদি কোন পুলিশ প্রশাসনের পরিবারের কারো সাথে সেদিন এই দুর্ঘটনা ঘটতো তাহলে তাদের টনক নড়ত। আর তাই এমন ঘটনা তাদের নিজেদের কারো সাথে ঘটার আগেই এই সব ঘটনাগুলোকে যদি নিজেদের মনে না করে তাহলে অবস্থার পরিবর্তনের কোনা আশা নেই।আর এসব কিছু প্রতিরোধের জন্য দরকার কঠোর আইন আর সেটার সঠিক প্রয়োগ। আর তার সাথে সাথে পারিবারিক শিক্ষাটা খুব বেশী জরুরী। নইলে হয়তো এমন দিন খুব দূরে নয় যেদিন মানবিক মূল্যবোধ বলে কিছু আর খুঁজেই পাওয়া যাবেনা। আর আইনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষ নিজেই আইন হাতে তুলে নিবে। আর এমনটা হলে আমাদের সকল মঙ্গল শোভাযাত্রই পর্যবসিত হবে তিমিরে। যা আমরা কখনোই চাইনা।