বন্দিবিনিময় চুক্তি : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে মাইল ফলক

মহামানব মিল্টন বিশ্বাস
Published : 17 March 2014, 07:48 AM
Updated : 17 March 2014, 07:48 AM

চলতি বছর(২০১৩) ২৮ জানুয়ারি ঢাকায় উন্মোচিত হলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন দিগন্ত। ঐদিন বন্দিবিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির অপরাধী হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে এবং এ-অঞ্চলের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে নতুন যুগের সূচনা হলো। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশ তাদের নাগরিকদের নিজ দেশের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ জানাতে পারবে। বাংলাদেশের কারাগারে আটক ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়া বা ভারত থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম দুই খুনি ক্যাপ্টেন(অব.) মাজেদ ও রিসালদার(অব.) মোসলেম উদ্দিনকে ফেরত পাঠানো বা ফেরত আনা যাবে এই চুক্তির আওতায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পাওয়া গেলে দিল্লি হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। তবে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিনিময় চুক্তি হয়েছিল। এ পর্যন্ত সেই চুক্তির আলোকে একজনও বন্দি বিনিময় না হলেও ২৮ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত চুক্তি ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা মনে করি। কারণ এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে অপরাধী হস্তান্তরে আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে। এর আগে আইন না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে অপরাধী হস্তান্তরে বাংলাদেশের সহযোগিতার কথা বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। ভারত এজন্য বাংলাদেশের প্রশংসাও করেছে। তবে সার্কের(দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) পারস্পরিক আইনি সহায়তাবিষয়ক সনদের আওতায়ও অপরাধী হস্তান্তরের সুযোগ ছিল। অর্থাৎ পূর্বে বিভিন্ন সময়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে অপরাধী হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্কের কারণে। উভয় দেশ নিজের ভূখ- অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হতে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। আর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অপরাধী প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করারও সুযোগ রয়েছে। অপরাধীর গুরুত্ব হিসেবে প্রতিটি অনুরোধ আলাদাভাবে বিবেচনা করা হবে।

এই চুক্তির আওতায় যে কোনো দেশের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং কোনো ধরনের অপরাধ বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি উভয় দেশে ফৌজদারি দ-বিধির আওতায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে প্রত্যর্পণ করা যাবে। আর এর ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে মহাজোট সরকারের আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী মোকাবিলায় বাংলাদেশের সহযোগিতার বিষয়টি ২৮ জানুয়ারি যৌথ বিবৃতিতে স্থান পেয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অতীতে বিভিন্ন সময় ভারতের আদালতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে আটক হয়েছে। এরপর তাদের ভারতের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো স্বীকার করেনি। তবে সুসম্পর্কের সুবাদে দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক সহযোগিতা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী মোকাবিলায় সহযোগিতা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। মূলত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বন্দিবিনিময় চুক্তিটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত।

বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন এমন পূর্বাভাস পেয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শঙ্কিত বলে গত বছর(২০১২) ২৯ আগস্ট জানিয়েছে সর্বাধিক প্রচারিত ভারতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর সন্ত্রাসী ও নাশকতামুলক কর্মকা- আবার মাথা চাড়া দিতে পারে বলে ভারতীয় গোয়েন্দাদের আশঙ্কা। অন্যদিকে ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপি এখন মরিয়া হয়ে ভারতের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়েছে। খালেদা জিয়া সেদেশ সফর করেও এসেছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আমাদের দেশ সফর করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সূত্রপাত। ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ও যুদ্ধের সময় সহযোগিতার ঋণ এদেশের মানুষ কখনও ভুলতে পারবে না। এজন্য মনমোহন সিংয়ের আগমন ঐতিহাসিক সফর হিসেবে গণ্য হয়েছিল। ভারতের মন্ত্রীরাও বলছেন তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গভীর আবেগ ও আস্থার সম্পর্ক। সে দেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো মনমোহনের সফরের মধ্য দিয়ে মীমাংসা হয়েছে; আরও হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বলা হচ্ছে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পানি বণ্টন চুক্তি হবে। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে হত্যাকা- ঘটাচ্ছে ভারত- এ ভাষ্য সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। তবে আমরা কেউ ফেলানির মতো হতভাগ্য কিশোরীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্য ভুলতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরে একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। অবকাঠামোগত চুক্তিসহ স্বাক্ষরিত হয়েছে- ১. নবায়নযোগ্য জ্বালানি চুক্তি ২. ফিশারিজ কো-অপারেশন ৩. বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ভারতের দূরদর্শন ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ৫. সুন্দরবন সংরক্ষণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার সংরক্ষণ ৬. ভারত ও বাংলাদেশের রেলওয়ে সমঝোতা স্মারক ৭. অনিষ্পন্ন ও অপদখলীয় জমির নিষ্পন্ন, ছিটমহল বিষয়ক সীমানা প্রটোকল স্মারক। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বিনিয়োগ সুবিধার জন্য ইতোমধ্যে দেশের মধ্য দিয়ে ভুটানের ট্রাক চলাচলের চুক্তি বহাল রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর থেকে। গত বছর সেপ্টেম্বরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টার দিল্লি­ সফরে অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে 'ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষর ছিল একটি মাইলস্টোন। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ সেই চুক্তির বিষয় ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক অখ-তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। ১৯৯৭ সালের ১৮ মার্চ সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৯৯৬ সালে ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ত্রিশ বছর মেয়াদী 'গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। ১ জানুয়ারি ১৯৯৭ থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। উল্লেখ্য, ১৯৬১ থেকে শুরু হয়ে ১৯৭৪ সালে শেষ হয় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ কাজ। ১৯৭৫ থেকে বাঁধ চালু হয়। ১৯৭৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৫ বছর মেয়াদী 'গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি' স্বাক্ষর হয়েছিল। ১৯৮২ সালে তার মেয়াদও শেষ হয়। গঙ্গার পানি প্রবাহ ইস্যুটি ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘে উত্থাপন করা হয়। ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক কল্যাণে। বন্যা ব্যবস্থাপনা, সেচ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন ও পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই অঞ্চলের পানি সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে এই চুক্তি সম্পন্ন করা হয়। সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান খুঁজে বের করার যে প্রচেষ্টা সেই চুক্তিতে প্রকাশিত হয় তা ভবিষ্যতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর মাধ্যমে কোনো পক্ষের স্বার্থ বা অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে না অথচ সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছে; দেশ এগিয়ে চলছে।

ফারাক্কায় বাঁধ দেবার ফলে কুষ্টিয়া-যশোরে স্থাপিত দেশের প্রথম সেচ প্রকল্প 'গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প' বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পরও দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতি মোচন হয়নি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা শুকিয়ে গেছে। গড়াই নদী বিপন্ন হয়েছে। একইভাবে বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৩৫টি থানা নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প 'তিস্তা সেচ প্রকল্প' হুমকির সম্মুখীন হয় ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় মহানন্দা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করায়। ১৯৮৩ সালের ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি অনুসারে ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ সংরক্ষিত হলেও বাংলাদেশের ১৮ লক্ষ একর জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই বাঁধ ও সেচ-খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় বাংলাদেশে সেচ প্রকল্প শুষ্ক মৌসুমে অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহ ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। মঙ্গা কবলিত উত্তরাঞ্চলে দারিদ্র্য দূর করার একমাত্র উপায় তিস্তার পানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে। এর ভেতর ২৩টি পঞ্চগড় দিয়ে প্রবেশ করেছে। এসব নদীতে বছরের পর বছর পানিপ্রবাহ কমেছে। নদী বাঁচাতে পানি দরকার। পানির ভাগাভাগি নয় দৃষ্টি দিতে হবে অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার ওপর। পানিবণ্টন করে সমস্যার সমাধান হবে না। অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা মানে সমুদ্র পর্যন্ত নদীর গতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা। পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো নদীর পানি ভাগাভাগি করে না, করে নদীর অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ও সমন্বিত ব্যবহার, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ। ফলে নদীর অববাহিকার সব দেশের পক্ষে সমভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব, পরিবেশ ও নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব। বহু বছর ধরে তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গের সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তুলনামূলকভাবে ভারত সুবিধা বেশি পাচ্ছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। কারণ পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবার পয়েন্টে অবস্থিত পানির ভাগ দিতে চায় না সেখানকার জনগোষ্ঠী। আমরা মনে করি সেখানকার পানি ভাগাভাগি নয় বরং শুকনো মৌসুমে ভারতের উদারতা ও সহমর্মিতা এবং তিস্তার গতিপথে পানি প্রত্যাহারের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আনা দরকার। ইতোমধ্যে দিল্লির সঙ্গে মমতার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

এসব ক্ষেত্রে সমঝোতার চাবি ভারতের হাতে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব বাংলা ও ভারতের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষত পাকিস্তানি শাসকদের কারণে সে সব সমস্যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত বহাল থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এবং বর্তমান সরকারের সময় সে সব সমস্যা দূর হয়েছে। অনেকদিন পরে সীমান্ত মানচিত্র তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ছিটমহল ও অবৈধ দখলিকৃত জমি মুক্ত করা, তিন বিঘা করিডোরে যাতায়াত সমস্যার সমাধান, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এসব ইস্যুতে দীর্ঘ মেয়াদী বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে; আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য যা খুব প্রয়োজন ছিল। আমরা খুশি যে ট্রানজিট, পোর্ট ব্যবহার, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, রেল যোগাযোগ(তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন বাদে), সীমান্ত সমস্যা মীমাংসা হওয়ায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে সামগ্রিক সহযোগিতার প্রসঙ্গটি বারবার সামনে আসছে। সেটির জন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বান্যার্জি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে দ্বিধা-বিভক্ত হয়েছেন এটিও বিবেচনায় আসছে আমাদের কাছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও যাতায়াত বেশি। সেখানকার বাঙালিরা বাংলাদেশীদের আপন মনে করে থাকেন। এদিক থেকে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে মমতা ব্যানার্জির দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অনেক বিষয়ে কেন্দ্রকে প্রভাবান্বিত করে আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণও করতে পারেন; এটাও বিবেচনায় আনা দরকার। চিকিৎসার জন্য যে বিপুল সংখ্যক রুগী কলকাতায় যান তাদের ভিসামুক্ত অনুপ্রবেশের সুযোগ দেবার বিষয়টি কেন্দ্রের কাছে তুলে ধরার সময় এখনই। অবশ্য সার্কভুক্ত দেশের জন্য ভিসামুক্ত অনুপ্রবেশের দাবি অনেকদিনের। ২৮ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত অপর এক চুক্তিতে ভারতীয় ভিসা সহজ করার ঘোষণা রয়েছে।

সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল করতে হবে। এজন্য ট্রানজিট প্রসঙ্গটি সামনে আসছে। ১৯৭৬ সালে নেপাল-বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বজুড়ে বহুস্তর বিশিষ্ট যোগাযোগ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তবে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে যেসব রুট প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর বদলে নতুন ১৫টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ এ সংক্রান্ত কোরগ্রুপের ১৭টি রুটের প্রস্তাব বহাল থাকছে না। ১২টি সড়ক ও তিনটি রেল রুট অর্থাৎ এই ১৫টি রুটের সবই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর কেন্দ্রিক। রেল রুটের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বা মংলা-রাজশাহীর বিরল-রাধিকাপুর(ভারত), চট্টগ্রাম বা মংলা-রাজশাহীর রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ(ভারত) এবং চট্টগ্রাম বা মংলা-দর্শনা-গেদে(ভারত)। দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রানজিটের রেল, সড়ক ও নৌ পথের যোগাযোগকে সকলেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ একদিকে নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দ্রুত ও সহজে যোগাযোগব্যবস্থা পাবে, অন্যদিকে বাংলাদেশও ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল ও ভুটানে সড়ক-রেল যোগাযোগ বাড়াতে সক্ষম হবে। আর সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করবে দ্রুততার সঙ্গে। বাংলাদেশ রাজস্ব পাবে বন্দর ব্যবহারের বিনিময়ে। কিন্তু ট্রানজিট ব্যবহার করে কেবল ভারতীয় পণ্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যে কম খরচে সরবরাহ করা শুরু হলে বাংলাদেশি পণ্য তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে এটাও মনে রাখতে হবে। এজন্য শুল্ক বাধাগুলো দূর করে বাংলাদেশি পণ্য ভারতীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাছাড়া ট্রানজিট অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহের জন্য পূর্ব থেকে ব্যবস্থা থাকা দরকার। নির্ধারিত ফি ধার্য্য করে ট্রানজিট সুবিধার চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের মধ্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করা হয়েছে। কিন্তু ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীর ভয় রয়েছে। আর রয়েছে পাকিস্তানের জঙ্গি নেটওয়ার্কের অপতৎপরতার শঙ্কা। এজন্য বন্দিবিনিময় চুক্তি নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বিরোধী দল বিএনপি সবসময় ভারতের বিরোধিতা করে আসছে। অথচ আমরা বিশ্বাস করি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা পারস্পরিক আস্থা ও মর্যাদার ভিত্তিতে হওয়া দরকার। তিস্তার পানি বণ্টন, সমুদ্রসীমা, সীমান্ত হত্যাসহ দুই দেশের মধ্যকার সমস্যাগুলোর সম্মানজনক সমাধান হবে বলে আশা করছি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে 'গ্যারান্টি ক্লজ'(বাধ্যবাধকতামূলক শর্ত) রাখার দাবি জানিয়েছে কেউ কেউ। তবে দুইদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হলে যে কোন চুক্তি ফলপ্রসূ হবে। কেউ কেউ বলছেন চুক্তি করে বাংলাদেশ কখনও লাভবান হয় নি। পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ফারাক্কা ইস্যুতে ভারতের উদারতার অভাব রয়েছে। সেই বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের ২০টি নদী আজ মৃত। পানিকে ঘিরে টানাপোড়েনের অবসান চান সকলে। আমরা মনে করি 'ভারত প্রতিবেশীকে ছাড় দেয় না'- এটা এই মহাজোট সরকারের আমলে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিক চুক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দুই পক্ষ লাভবান হবে বিভিন্ন চুক্তিতে। শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় দুই দেশের অনেক দিনের সমস্যাগুলো সমাধান হয়েছে এবং আরও হতে যাচ্ছে। সীমান্ত সংকট মীমাংসা হতে চলেছে। ভারত সীমান্ত জুড়ে বাংলাদেশের ২৮ জেলার মানুষ বাস করে। বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে চার হাজার কিলো মিটারের সীমানা। আড়াই হাজার কিমি কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। তবু অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালানি আছে। এজন্য সীমান্ত নিরাপত্তা করতে চুক্তি হয়েছে; গুলি চালানো বন্ধ হয়েছে। সীমান্তের নিরীহ মানুষ হত্যা বন্ধ হবে এবং পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি ঘটবে বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্কের প্রধান প্রত্যাশা এটাই।