অন্যরকম একুশ ও প্রজন্ম চত্বরের চ্যালেঞ্জ

মহামানব মিল্টন বিশ্বাস
Published : 20 Feb 2013, 06:15 PM
Updated : 20 Feb 2013, 06:15 PM

১৪১৯ সালের ৯ ফাল্গুন একুশে ফেব্রুয়ারি। এবারের একুশ অন্যরকম। কারণ ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি নিয়ে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের প্রতিবাদী সমাবেশ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। শাহবাগ এখন পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর অপকর্মের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যারা দেশভাগের পরে আমাদের সাংস্কৃতিক অধিকারকে লুণ্ঠন করে নিতে চেয়েছিল। যারা আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। সেই পাকিস্তান হিন্দু জনগোষ্ঠীকে তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করেছিল। তাদের দোসর হিসেবে জামাত-ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিল। ভাষা-আন্দোলনের পরই পাকিস্তানি সরকারের সব কাজের সহযোগী ও বিশ্বস্ত অনুগামী হিসেবে তখনকার ইসলামী দলগুলোর কার্যক্রম বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে চলতে থাকে। প্রজন্ম চত্বর থেকে জামাতের প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক কর্মকা-কে বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ তারা মৌলবাদী শক্তি হিসেবে দেশ-বিদেশে তাদের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করেছে। ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, শিল্প, মিডিয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। কেবল ইসলামী ব্যাংকই বৃহৎ পরিসরে দেশের মধ্যে পুঁজির দাপট দেখিয়েছে। সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের মাধ্যমে জামাত-ইসলামকে নিষিদ্ধ করার যে প্রাথমিক কাজ প্রজন্ম চত্বর তৈরি করে দিয়েছে তা এবারের একুশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। জামাত ও জামাতি প্রতিষ্ঠানসমূহ বর্জন করার আহবান ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে দেশের মানুষ। অনেকেই বয়কট করতে শুরু করেছে জামাতি ব্যাংক-বীমা-কোচিং সেন্টার। একই ধরনের ঘটনা ছিল একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন। সেদিনকার মতো আজও বয়কটের দাবি জনগণের কাছে পৌঁছেছে। একাত্তরের মতো বর্তমানেও একুশের চেতনা সকলকে উদ্দীপ্ত করছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল ঠিক তেমনি এখনো প্রজন্ম চত্বরের প্রতিবাদী তরুণদের নিয়ে অপকথার বিস্তার হয়েছে যা আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এটা ঠিক ধর্ম নিয়ে তরুণ প্রজন্মের কোনো মাথা ব্যথা নেই। যার যার ধর্ম তার তার। অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে উজ্জ্বল হয়ে মূর্তিমান। বিরোধী দল বিএনপি ইতোমধ্যে বলা শুরু করেছে প্রজন্ম চত্বর গণতন্ত্র রক্ষায় স্লোগান দিক অথবা বলছে ইসলামী ব্যাংক কেন সোনালী ব্যাংক বর্জনেরও ডাক দিক। তাহলে তারাও শাহবাগে উপস্থিত হয়ে একাত্ম হবে। কিন্তু আমরা বলতে চাই, কেউ যদি বলে থাকেন ইসলামী জঙ্গিবাদ আর বর্তমান মহাজোট সরকারের আচরণ একইরকমের তাহলে ভুল করবেন। কিন্তু এ ধরনের অপপ্রচারই চলছে। কেউ যদি বলেন বর্তমান সরকারের আমলের দুর্নীতি আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তরুণ প্রজন্মের অনাস্থা একই তাহলেও ভুল করবেন। কারণ বর্তমান সরকার সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তারেক-কোকোর অর্থপাচারের বিষয়টি এখন পরিষ্কার। জোট আমলে বিদেশে অর্থপাচারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। পক্ষান্তরে অর্থপাচারে বর্তমান সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই।

শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম জঙ্গিবাদে অর্থায়ন থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন পর্যায়ে জামাতের নাশকতামূলক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের মিডিয়া নয়াদিগন্ত, আমার দেশ, সংগ্রাম, দিনকাল, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামী টিভি বর্জনের ডাক দিয়েছে। দেশের কয়েকটি জায়গায় এসব টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের মিডিয়া দেশের মধ্যে সম্প্রচার চালিয়ে যাবার বিপক্ষে আমরা। গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই এই প্রতিবাদী সমাবেশ কারণ মানুষের মধ্যে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৌল অনুষঙ্গগুলো আবারও জেগে উঠেছে। ভিন্ন মতাবলম্বীকে অবশ্যই আমরা সম্মান জানাই কিন্তু রাজাকার-আলবদর-আলশামসকে নয়। মিডিয়া যদিও রাজনৈতিক অঙ্গনকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিতে সক্ষম তবু শেষ বিচারে জনগণের ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বর্তমান সরকার নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল। সেই অঙ্গীকার পূরণে কাজ চলছে। অথচ জামাত নিষিদ্ধ হলে কারা উপকৃত হবে এই প্রশ্ন তুলেছে অপপ্রচারকারীরা। বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট উপকৃত হবে বেশি। গত নির্বাচনে জামাত সাড়ে তিন লাখ ভোট পেয়ে মাত্র ২টি আসনে জয়ী হয়। জাতীয় সংসদে তাদের গুরুত্ব নেই। জাতীয় জীবনেও গুরুত্বহীন। সাধারণ মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। প্রতিদিনের রুটিরুজির চিন্তার পরেও শাহবাগের আন্দোলনে সমর্থন জানানোর সময় এসেছে এখন তাদের। শাহবাগের চেতনাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে তা শোষিত মানুষের পক্ষে যাচ্ছে। আর সাধারণ দরিদ্র মানুষ দেশকে যে কতভাবে অনুভব করে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ছোট ছোট ঘটনার বিবরণ থেকে। শাহবাগই তৈরি করেছে স্বাধীনতা, সাম্য আর সার্বভৌমত্বের প্লাটফর্ম।

এই একুশে(২০১৩) শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের জমায়েতই জাতীয় পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। সেখানকার মহাসমাবেশগুলো জাতীয় সংগীতকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব দরবারে। একসময় বাংলা ভাষার দাবি মেনে নেবার পরেও পাকিস্তানি সরকার পুনরায় আমাদের রাষ্ট্রভাষা পরিমার্জনা করার পদক্ষেপ নিতে গিয়ে যেসব অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল ভাষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তেমনি বর্তমান পরিস্থিতিতে জামাত-শিবির অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। সে সময় পাকিস্তানি শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। বর্তমান জামাত-শিবির একইভাবে রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য মহাজোট সরকার ও প্রজন্ম চত্বরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। ষাটের দশকে পাকিস্তানিরা রবীন্দ্র-সংগীতকে বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকরা একইভাবে জয়বাংলা স্লোগানকে বিশেষ দলের বলে প্রচার করেছিল। যা নস্যাৎ করেছে তরুণ প্রজন্ম। বর্তমান সরকার জাতির পিতার হত্যাকারীদের মধ্যে ৫জনকে বিচারের রায় অনুসারে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি। সে বছরই মার্চে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে আওয়ামী লীগের শত্রু পক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। বাকশাল এবং রক্ষীবাহিনী নিয়ে পাকিস্তানপন্থীরা যেমন অপকথার কাব্য রচনা করেছিল এবং ব্যর্থ হয়েছিল তেমনি একইভাবে প্রজন্ম চত্বরের বিরুদ্ধে অপকথা ছড়িয়ে লাভবান হতে ব্যর্থ হবে জামাত-শিবির এটা বলাবাহুল্য।

জামাত-শিবির ও বিরোধী দলের হঠকারী রাজনীতির মধ্যেও দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী পত্রিকায় বর্তমান সরকার ও প্রজন্ম চত্বরের প্রশংসা যেমন বিএনপি নেতৃত্বধীন ১৮ দলের মাথা ব্যথার কারণ তেমনি বিদেশের অনেক মহলেরও। 'পেইড লবিস্ট'রা মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে যেমন তেমনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করছে কোন কোন বিদেশি গণমাধ্যম। বিএনপি বিভিন্ন সময়ে আটক জামায়াত ও তাদের নেতার মুক্তি দাবি করেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সরকারের 'বিচারের নামে' বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছেÑ এমন অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধেরও দাবি জানিয়েছে। তাদের সেইসব বক্তব্যের সাথে জামাত-শিবিরের কর্মকাণ্ডের সাদৃশ্য রয়েছে। এজন্য এবারের অন্যরকম একুশে প্রজন্ম চত্বরের সমাবেশের চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা তাদের জন্য কিছুই নয়। কারণ জনগণ তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে।