কিন্তু জ্যামিতিক ত্রিভুজের উপপাদ্যের সঙ্গে এর মিল ঘটানো কষ্টকর। দেশ তিনটির মধ্যে মিল নেই। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী হলে পাকিস্তান তার বৈরি হয়ে দাঁড়ায়। আর বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের দিকে ঝোঁকে, তাহলে বাংলাদেশকেও ভারত জব্দ করার চেষ্টা করে। এটাই ছিল গত প্রায় চার দশকের উপমহাদেশীয় রাজনীতি। মাঝে মাঝে এর হেরফের হয়নি তা নয়; কিন্তু এই হেরফেরটা কোনো স্থায়ী ব্যাপার ছিল না।
সম্প্রতি এই ত্রিভুজ রাজনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা ভারতবিরোধী রাজনীতির যে হাওয়া তার বিস্তার কমেছে এবং ভারতেরও এতকালের যে 'বিগ ব্রাদারসুলভ' মনোভাব বাংলাদেশের প্রতি, তাতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
এই পরিবর্তন ঘটানোর পেছনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবিরাম চেষ্টার যেমন কৃতিত্ব রয়েছে, তেমনি কৃতিত্ব রয়েছে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও। তিনি দিল্লিতে ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশ সম্পর্কে নীতিনির্ধারণে আর রক্ষণশীল ভারতীয় আমলাতন্ত্রের হাতে তামাকু সেবন করেননি। তিনি রাজনৈতিক নেতার দূরদৃষ্টি নিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং এতদিনের বড়ত্বের বাহাদুরি ত্যাগ করে ছোট প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সম্পর্কোন্নয়নে এগিয়েছেন। এটাই তাঁর এবারের ঢাকা সফরের ঐতিহাসিক সাফল্য ও বাস্তবতা।
কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উন্নতি হলেই উপমহাদেশের সব সমস্যার সমাধান হবে এবং উপমহাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে, তা নয়। উপমহাদেশের ত্রিভুজ রাজনীতিতে একটি কোণ জুড়ে বসে আছে পাকিস্তান। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে যদি পাকিস্তানের সম্পর্কের প্রকৃত উন্নতি ঘটে, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যদি বাস্তবেই উন্নত হয় তাহলে উপমহাদেশের রাজনীতির চালচিত্র যে সত্যি বদলে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। তাতে জঙ্গিবাদ ও তার দ্রুত ভয়াবহ বিস্তার থেকে তিনটি দেশই মুক্ত হবে। তিনটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির স্থায়িত্ব দেবে।
কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সম্পর্কোন্নয়ন সহজে হবার নয়। পাকিস্তানে বর্তমানে আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের নাজুক গণতন্ত্র বিরাজ করছে এবং আমেরিকার চাপেই দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিকর 'থ' (thaw) অবস্থা চলছে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় এখনও আর্মির দৃঢ় অবস্থান রয়েছে এবং তাদের বড় অংশ চরমভাবে ভারতবিরোধী। নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে অনেকটাই আগ্রহী। কিন্তু পাকিস্তানের অদৃশ্য অরাজনৈতিক সরকার (Invisible Government) তাতে আন্তরিকভাবে রাজি নয়। তাছাড়া পাকিস্তানে তালেবান ও আল কায়েদার দল যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা পাকিস্তানে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেই তৎপরতার সম্প্রসারণ ঘটাতে চাচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভারতেও।
ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে প্রীতি উপহারও বিনিময় হয়েছে। কিন্তু তা সম্পর্কের বরফ তেমন গলাতে পারেনি।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের প্রধান 'কাঁটা' কাশ্মীর সমস্যা। আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকার পানিবণ্টনের সমস্যাও ছিল। সেটা বহু বছর আগে 'সিন্ধু অববাহিকা চুক্তি' (Indus basin treaty) দ্বারা মীমাংসা করা হয়েছে। দুদেশের মধ্যে আসল সমস্যা কাশ্মীর। এই সমস্যা এখন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এর সমাধান ছাড়া দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কোন্নয়ন সম্ভব নয়। অসম্ভব হবে উপমহাদেশে প্রকৃত আঞ্চলিক মৈত্রী ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা। সার্কের বর্তমান অবস্থা তার প্রমাণ।
ভারতের আগের সরকারগুলোর মতো নরেন্দ্র মোদির সরকারও চান কাশ্মীরের বর্তমান বিভক্তিকরণ রেখা মেনে নিয়ে পাকিস্তান সমস্যাটির সমাধান ঘটাক। কিন্তু পাকিস্তান এই সমাধান মেনে নিলেও (সিমলা চুক্তি অনুসারে যা মেনে নিয়েছিল) তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। কাশ্মীরে এখন তৃতীয় একটি পক্ষ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিলেও তারা সকলেই সন্ত্রাসী নয়। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই কাশ্মীরের মুক্তিকামী।
প্রথমে তারা ছিল সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী, স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড দমননীতির মুখে তারা ক্রমশ পাকিস্তানের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়েছে এবং পাকিস্তান থেকে আগত সন্ত্রাসীরাও তাদের সঙ্গে মিশে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলামি জঙ্গিরাও এসে তাদের সঙ্গে মিশেছে। সব মিলেমিশে একটা সর্বাত্মক ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে কাশ্মীরে।
'এখন পাকিস্তানই কেবল কাশ্মীরে জঙ্গি পাঠাচ্ছে' কিংবা 'হুররিয়াত বা এই জাতীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়', এই ধুয়া তুলে ভারত তার সেনাবাহিনী দ্বারা কাশ্মীরে দমননীতি চালাতে পারবে, কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ঘটাতে পারবে না। সেনাবাহিনীর পাহারায় নির্বাচন অনুষ্ঠান বা অনুগত রাজনীতিকদের দ্বারা সরকার গঠনও সমাধান নয়।
এই চেষ্টা ব্রিটিশ সরকার করেছিলেন আইরিশ সমস্যা সমাধানের জন্য, দুশ' বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু তারা তা পারেননি। আইআরএ বা আইরিশ সন্ত্রাস ব্রিটিশ মূল ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে পড়েছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন পর্যন্ত নিহত হন আইরিশ সন্ত্রাসীদের হাতে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে টনি ব্লেয়ার উপলব্ধি করেন সামরিক শক্তি দ্বারা আইরিশ সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব নয়। ফলে যে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার কোনোদিন আলোচনায় বসবে না বলে গোঁ ধরেছিল, সেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে বসতে টনি ব্লেয়ার রাজি হন এবং আইরিশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ঘটে।
ব্রিটেনের লেবার দলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার পরবর্তীকালে যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিথ্যা অজুহাতে ইরাক যুদ্ধে জড়িত না হতেন তাহলে আইরিশ শান্তি চুক্তির জন্য একজন শান্তিবাদী হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
ব্রিটেনের পার্লামেন্টে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল টনি ব্রেয়ারের। ভারতের বর্তমান পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও রয়েছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের জাদুই চেরাগ এখন তাঁর হাতে। তিনি যে এখন আর গুজরাতের বিতর্কিত মোদি নন, বরং নিজেকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একজন স্টেটসম্যানে রূপান্তরিত করতে চলেছেন, তার প্রমাণ গত এক বছরে দিয়েছেন। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানেও একমাত্র তিনিই পারেন সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে এবং এটাই সে জন্যে সবচাইতে ভালো সময়।
কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিয়ে নয়– বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আস্কারা দিয়ে নয়– 'সন্ত্রাসী' বলে আখ্যায়িত এই সন্ত্রাসীদের দেশপ্রেমিক, কাশ্মীরি অংশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অসম্মতি না জানিয়ে বরং আলোচনায় বসে কাশ্মীরের জনগণের সম্মতি নিয়েই এই সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে পারেন মোদি। আর কাশ্মীর সমস্যার এই সমাধান হলে পাকিস্তানকে তা মেনে নিতে হবে। পাকিস্তানও এই শান্তি বৈঠকে অংশীদার হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হবে এবং সামরিক বাহিনীর আধিপত্য কমবে। গণতান্ত্রিক সরকার তখন জঙ্গিবাদ দমনে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারবে।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিশ্বের তখনকার দুই পরাশক্তির মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল, তা এখন নেই। কিন্তু আমেরিকা চাইছে, এশিয়ার দুই উদীয়মান শক্তি, ভারত ও চীনের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ সৃষ্টি করে বিশ্বে নিজেদের একাধিপত্যের পতনদশা ঠেকাতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন 'স্টেটসম্যান' (শুধু পলিটিসিয়ান হলে চলবে না) হন তাহলে এই সত্য তিনি সহজেই উপলব্ধি করবেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নও তাঁর সরকারের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।
এ ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। নির্বাচনের প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদি চীনের বিরুদ্ধে যতটা কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন, নির্বাচিত হওয়ার পরে তা আর বলেননি। তিনি চীন সফর করেছেন এবং চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের উপরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। ৬ জুন ঢাকা সফরে এসেও সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, "চীনের সঙ্গেও কথাবার্তা শুরু হয়েছে।" তিনি এই বড় প্রতিবেশির সঙ্গেও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আশাবাদী।
এক কথায় ঢাকায় হাসিনা-মোদি বৈঠক এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মীমাংসার চুক্তি সারা দক্ষিণ এশিয়াতেই আশার আলো জ্বেলেছে, নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এই সম্ভাবনা হল, এই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ভারত হয়তো তার ছোট বড় অন্যান্য এশীয় প্রতিবেশি দেশের সঙ্গেও একই আন্তরিকতা ও আগ্রহ নিয়ে সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় এগুবে এবং নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বর্তমান ক্ষমতা ও প্রভাবের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবেন।
ভারতের দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী, জওহরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর স্বপ্ন ছিল ভারত মহাসাগরীয় এলাকাটি 'জোন অব পিস' বা শান্তির এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি পারবেন অথবা চাইবেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিতে?
লন্ডন; ১২ জুন. ২০১৫, শুক্রবার
আবদুল গাফফার চৌধুরী: কলামিস্ট।