একটা স্লোগান বেশ শুনা যায়, "ধর্ম যার যার – উৎসব সবার"। যারা বলে তারা অাসলেই কি মনে প্রানে বিশ্বাস থেকে বলে কি না জানি না। অাজকাল সবই প্রচার-সর্বস্ব অার স্লোগান-সর্বস্ব হয়ে গেছে! অামরাও কি পশ্চিমাদের মতো দিন দিন স্লোগানবাজ হয়ে যাচ্ছি?!
আমরা ছোটোবেলায় এই স্লোগান কখনো শুনিনি! তবে ছোটোবেলায় ঈদে পূজা পার্বনে কি করতাম তা আজ খুব মনে পড়ে! ঈদ এলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বন্ধুরা মিলে সকালবেলা সবার বাড়ি বাড়ি যেয়ে মুরুব্বীদেরকে সালাম করতাম অার মিষ্টি খেতাম। তার অাগে ঈদের নামাজের সময় মসজিদের বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকতো অামাদের বন্ধুদের কয়েকজন – বলাই বাহুল্য – ওরা হিন্দু! কখনো ভাবিনি – এটা মুসলমানদের দিন!
এখানে একটা মজার কথা না বললেই নয়, এক বন্ধু, নাম তার বিশ্বজিত, (ছদ্মনাম) তত্ত্ব বের করলো, কিভাবে ঈদের দিনে সর্বোচ্চ পরিমানে মিষ্টান্ন গ্রাস করা যায় – সে বলতো, পানি খাওয়া চলবে না, শুধু মিষ্টান্ন খাবি! আর তরল মিষ্টান্ন (পায়েশ, সেমাই ইত্যাদি) প্রথমে খাবি – তারপর শক্ত মিষ্টিগুলো খাবি – তাহলে বেশী খেতে পারবি!
যাই হোক, অপরদিকে যখন পূজা অাসতো অামরা সদলবলে মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে বেড়াতাম। হিন্দু বন্ধুরা প্রতিমায় পূজা দিতো – অামরা পাশে দাড়িয়ে থাকতাম। ঠাকুরের প্রসাদও নিতাম কখনো কখনো! ঠাকুরও জানতেন যে অামরা হিন্দু নই – কিন্তু তবুও অামাদেরকে বঞ্চিত করতেন না!
অতীতের প্রচলন – আজ স্রেফ 'প্রবচেন' পর্যবসিত হয়েছে! মানুষ অাজ কথা বলে বেশী – কাজ করে কম! মানুষ আজ কূটীল, জটিল হয়ে গেছে – চারিদিকে ধারিবাজ, ঝাড়িবাজ, স্লোগানবাজ ছেয়ে গেছে! তাই সমাজে সৌহার্দমূলক সহাবস্থান বিপন্ন!
অতীতের সৌহার্দমূলক সহাবস্থানের একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না।
আমার নানা খুবই পরহেজগার মৌলভী মানুষ। তিনি একটি ঐহিত্যবাহী জেলার তবলীগের আমীর। তাঁর হাব-ভাব চালচলন বেশ রাশভারী! আমরা তঁাকে খুবই ভয় পেতাম। তাঁর বাড়ির টিনের বেড়ার একেবারেই ঠিক পিছনে হিন্দুবাড়ির উঠান। ওরা সম্ভবত ব্রাহ্মণ হবেন – রোজই দু'বেলা তাদের উঠানে ঢোল-ডাগর বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে পূজা করা হতো। আমার নানা আবার ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতেন। প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজের পর ও দুপুরের অাহারের পর রুটিন মাফিক ঘুমাতেন। অামরা একটু শব্দ করলেই তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যেতো – আমাদেরকে কড়া ঝাড়ি দিতেন। অথচ, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, হিন্দুবাড়ির ঢোলের বাদ্য তাঁর ঘুমে কোনোই ব্যাঘাত ঘটাতো না! এমনকি কোনো দিন তাঁকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করতেও দেখিনি! আজকাল কি এমন নজীর আছে?