আদু ভাই সংক্রান্ত জটিলতা ও একজন আদু ভাইয়ের গল্প (প্রসংগঃ মেডিকেল ভর্তি)

সত্য কথক
Published : 2 Sept 2012, 06:43 AM
Updated : 2 Sept 2012, 06:43 AM

যখন খুব ছোট ছিলাম, পিতা আমাদেরকে পড়াতে বসতেন। মনে পড়ে এইম ইন লাইফ রচনা লিখে দেয়ার সময় পিতা মনের আকাঙ্ক্ষা সব জোড়া লাগিয়ে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিলেন, আমি নাকি ডাক্তার হতে চাই!! এরপরে আরও কত বসন্ত গেল এরই মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। ডাক্তার হওয়ার পরীক্ষা দিলাম। হলো না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলাম। তাও হলো না। না হওয়ার পেছনে কোন কারণ দেখাবো না।

পিতাজির মন ভীষণ খারাপ আমাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আশা ছিল তার প্রথম সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পিতাদের সবার আশাই বোধহয় এক হায়। তাদের মধ্যে ডাক্তার বানাবার আশা ঘুরপাক খায় প্রথমে ১ম সন্তানের মধ্যে অতঃপর এই আশার সংক্রমণ চলে অন্যান্য রক্তবীজের মধ্যে।

একজন কিশোর আমি যখন জীবনে প্রথমবারের মতো বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ফেল করে চরম হতাশার মধ্যে তখন পিতা বললেন, বাবা চলো কোন এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেই। তখন হঠাৎ আমার সরকারী চাকুরীজীবী চরম সৎ পিতার অর্থকষ্টের ছবি মানসপটে ভেসে উঠে। সিদ্ধান্ত নিলাম আরো একবার চেষ্টা করবো। আপনারা কি যেন বলেন আদুভাইই তো তাই না, আদুভাই হবো।

এই হচ্ছে জীবনে প্রথম আদু ভাই হওয়ার গল্প। আমি জানি এরূপ প্রত্যেকটি আদুভাই এর আদুভাই হওয়ার পেছনে একটি করে গল্প আছে।

এবার একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক, মেডিকেল ভর্তি প্রক্রিয়ার আওয়ামীলীগীয় সংস্কারের দিকে। অবশ্য এই সংস্কারের প্রতি অনেকের দৃষ্টিকটু নির্লজ্জ সমর্থন বেশ লক্ষণীয়। বলতে বাধা নেই সুবিধাভোগী বাঙ্গালীর এ এক পরম ধর্ম।

ভর্তি প্রক্রিয়ার এই সংস্কারে বলা হয়েছে, পরম আরাধ্য মেডিকেল ভর্তির জন্য কোন পরীক্ষা নেয়া হবে না। বরং জিপিএ এর ভিত্তিতে মেডিকেল এ ভর্তি করানো হবে। আপাতদৃষ্টিতে এই উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়। না বুঝে অনেকে প্রথমদিকে বেশ হাততালি ও দিয়েছিল। অবশ্য এই অনেকে বলতে আমি সুবিধাভোগী বাদে অন্যদেরকে বুঝিয়েছি।

এবার উদ্যোক্তাদের নিকট কিছু প্রশ্ন করার পালা। প্রথমেই জানতে চাইবো, জনাব শিক্ষামন্ত্রী কি সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে পড়ালেখার সম সুযোগের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, যাতে প্রত্যেকটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সমানভাবে পরীক্ষিত এবং তাতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে টিকে আসতে পারেন? নিশ্চয়ই না। কেননা এটি সর্বজন স্বীকৃত যে স্বচ্ছ জিপিএ ধারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ আসে শহরাঞ্চল থেকে। শিক্ষার অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের সাথে উক্ত পরীক্ষায় এঁটে উঠতে পারে না। এমনকি প্রত্যেকটি শহরের শিক্ষার্থীরাই কি সম সুযোগ পায়? ঢাকা শহরের একজন শিক্ষার্থী এবং সিলেট শহরের একজন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত সুযোগের যোজন যোজন পার্থক্য লক্ষণীয়। তদুপরি বোর্ড ও কিন্তু এখানে একটা অনেক বড় ফ্যাক্টর। প্রায়ই দেখা যায় এক বোর্ডের মূল্যায়নের সাথে অন্য বোর্ডের মূল্যায়নের মধ্যে বিরাট ফাঁরাক রয়েছে। যেখানে আমি দেশের সকল শিক্ষার্থীকে সমভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি না সেখানে কিভাবে ঐ মূল্যায়ন কে সঠিক মূল্যায়ন বলবো প্রশ্ন রইল। নাকি সংশ্লিষ্ট মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কিংবা আওয়ামী সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রাম থেকে পাশ করা কোন ছেলেকে তিনি ডাক্তারি পড়তে দেবেন না। যদিও আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না।

আমি বলছি না যে, যদি পূর্বতন নিয়মে ভর্তিপরীক্ষা নেয়া হয় তবে উক্তরূপ সকল বৈষম্য দূর হবে। তবে এটি আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না যে কোন সংস্কার পূর্বতন বৈষম্যকে কমাবে। যদি বৈষম্য না কমায় তাহলে ঐ সংস্কারের পক্ষে সাফাই গাওয়াটা অকাট মূর্খতা বাদে আর কিছুই নয়।

অনেকেই সন্দেহ করেছেন এই ভর্তি প্রক্রিয়ার সংস্কারের কারণটা অনেকটাই রাজনৈতিক। কেননা মেডিকেল ভর্তি কোচিং এর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শিবিরের হাতে। আমি এর সত্য মিথ্যা নিয়ে তর্কে জড়াতে চাই না । এবং এই তর্কে জড়ানোটা আমার উদ্দেশ্য ও নয়। তবে সরকার একগুঁয়েমি করলে জনমানুষের মনের এই সন্দেহ টা বাস্তবে রূপ নেবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস।

(বি দ্রঃ লেখক মেডিকেল ভর্তির কোন প্রক্রিয়াই কোনভাবে সুবিধাভোগী নয় এবং বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদে অধ্যায়নরত।)