নাগরিক জীবনের কথা উঠলেই অবিচ্ছেদ্যভাবে চলে আসে বিদ্যুতের কথা, গ্যাসের কথা। এখন শুধু নাগরিক জীবন কেন গ্রামীন জীবনেও বিদ্যুৎ একটি অপরিহার্য উপাদান রুপে প্রতীয়মান। বিদ্যুতহীন নাগরিক জীবন কিভাবে অচল তা নগরের অধিবাসী মাত্রই জানেন। গ্রামীন প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎহীনতা তো আরো ভয়ংকর।
নগরে বিদ্যুৎহীনতা সাময়িক সমস্যা মাত্র কিন্তু গ্রামে বিদ্যুতহীনতা আমাদের জাতীয় সমস্যায় রুপান্তরিত হয়। কিভাবে? চলুন একটি হিসেব দেই, আপনারা কি জানেন বর্তমানে গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে কয়টি নদী ও খালে পানি থাকে? ছোটবড সব মিলে ২০০ টি। এই নদীগুলো'র অধিকাংশই আবার শিল্প কারখানার বর্জ্য, রাসায়ানিক পদার্থ, কীটনাশক ইত্যাদি দ্বারা চরমভাবে দূষিত এবং বিষাক্তও বটে। সুতরাং এই গুটিকয় পানির উৎস যে আমাদের উৎপাদন ব্যাবস্থায় তেমন কোন প্রভাব রাখতে পারছে না তা সহজেই অনুমেয়। (সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, কয়েক হাজার নদী নালাকে বাচানো'র দায় কি সরকারের নয়? এই সম্পর্কিত আলাদা মন্ত্রণালয় আছে বলেও জানি। একটা নয় দুই দুইটা। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়)তাই উৎপাদন ব্যাবস্থার জন্য আমাদের কৃষক কূল কে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয়, ভূগর্ভস্থ পানির উপর। বর্তমান তেলের উর্ধ্বমুল্যের বাজারে একজন কৃষকের তেলের পাম্প চালিয়ে ভুগর্ভস্থ পানি তোলা কতটা অলৌকিক ব্যাপার তা সবাই জানেন। তাই কৃষকের পানি পাওয়ার একমাত্র উপায় ঐ বিদ্যুতই।
বিদ্যুৎ না পেলে কৃষক পানি পাবে না, পানি না হলে উৎপাদন হবে না, আর উৎপাদন না হলে আধপেটা কৃষকের সাথে সাথে সমগ্র জাতিকেও অভুক্ত থাকতে হবে। তবে আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী জাতিকে ফুলপেটা!! করার নতুন কোন ফর্মুলা বের করেছেন কিনা জানা নেই।
প্রায়ই পত্রিকায় দেখি, আমাদের নেত্রী দেশের আনাচে কানাচে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করে চলেছেন। কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন বেডেছে সত্য। কিন্তু এই বিদ্যুৎ কোথায় যায় তাও পর্যালোচনার বিষয়। জনাব আন্দালিব পার্থ তার সর্বশেষ সংসদীয় বক্তব্যে এই অতিরিক্ত আডাই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি হিসেব দেখিয়েছেন। ১৯ মার্চ দেয়া ঐ বক্তব্যে জনাব পার্থ অভিযোগ করেছেন সরকার আডাই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব দিয়েছে, যথাক্রমে সামিট গ্রুপ(১২০০ মেগাওয়াট) ও অরিয়ন গ্রুপকে(১২০০ মেগাওয়াট)।
কিন্তু তারা এই উৎপাদনের মূলা ঝুলিয়ে রেখে উৎপাদনে যাচ্ছে না। সরকারের সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনার আডাই হাজারের যদি এই অবস্থা হয় বাকি গুলোর অবস্থা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।
সরকার দাবী করে থাকে তারা ইতিমধ্যে অতিরিক্ত সাডে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। বাস্তবে কি করেছে? বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, আমাদের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় পাচ হাজার মেগাওয়াট যা বিগত আমলে ছিল সাডে তিন হাজার মেগাওয়াট। তাহলে অতিরিক্ত সাডে তিনহাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবী কি মিথ্যা নয়? আসলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি'র সাথে মিথ্যা এমনভাবে জডিয়ে গেছে, তারা সত্য বললেও আমাদের কাছে তা মিথ্যা বলে মনে হয়।
তার উপর জনসাধারণের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিভাবে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাবসায়ী মহলের কাছে যায়, প্রশ্ন রইল। বলতে পারেন, এই পুজিপতিরা তো বিদ্যুৎ দেশের উন্নয়নেই কাজে লাগাচ্ছেন। সবিনয় বলতে চাই, তারা নিজেরাই তো নিজেদের জন্য বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারেন। মাশাল্লাহ,দরিদ্র বাংলাদেশে এরুপ ব্যাবসায়ীর অভাব নেই বলেই জানি। তারা যদি সত্যিকার দেশপ্রেমিক হন তাহলে সরকারের ভর্তুকি কৃত বিদ্যুৎ জনগণের জন্য ছেডে দিয়ে স্ব উদ্দ্যোগে নিজেদের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেন। এতে নিশ্চয় তারা দেওলিয়া হয়ে যাবেন না।
আর সরকারের নির্লজ্জ ভূমিকা দেখে তো প্রতিনিয়ত অবাক হচ্ছি। তাদের আক্কেল কত কম হলে এই চাষের এই ভরা কৃষক কে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করে শিল্প গোষ্ঠীকে সরবরাহ করে তাও জানার বিষয়। বিদ্যুৎ নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী'র উক্তি তো আরো আতঙ্কজনক। বিদ্যুতের হিসেব মনে হয় তিনি নিজেই মেলাতে পারছেন না। তা না হলে তিনি বিদ্যুৎ নিয়ে একের পর এক প্রশ্নবোধক দায়িত্ব জ্ঞানহীন বক্তব্য প্রদান করতে পারতেন না। নেত্রীকে অনুরোধ করব, তিনি যেন জনাব পার্থের বক্তব্যের সত্যতা একটু পরীক্ষা করে নেন। তাহলেই মনে হয় অতিরিক্ত বিদ্যুতের হিসেব তিনি মেলাতে পারবেন। এর ফাঁকে ডিজিটাল বাংলাদেশের জননীকে একটু প্রশ্ন করতে নিতে চাই, বিদ্যুৎ ছাডা কি ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্ভব?
জাতির একজন হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, তিনি যেন আবেগ স্বর্বস্ব বক্তব্য পরিহার করে দেশের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করে কথাবার্তা বলেন। স্মর্তব্য, ১৯৭৩ সালে ভারত বঙ্গবন্ধু সরকারকে দুইটা ড্রেজার প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করেন তিনি এই দুইটা ড্রেজার দিয়েই বাংলাদেশের কয়েক হাজার নদী ড্রেজিং করে কৃষকদের পানির অভাব পূর্ণ করবেন। জাতি কিন্তু বিশ্বস করেছিল। কেননা তারা ধরে নিয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু সুপারম্যান জাতীয় একজন। আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি এই আবেগস্বর্বস্ব কথাগুলোই তাকে ডুবিয়েছে। তিনি যদি একজন বাস্তবতা বাদী হিসেবে পরিস্থিতি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতেন তাহলে পিতা প্রকৃত অর্থেই দেশ গঠনে জনকের ভূমিকা পালন করতে পারতেন।