হোলি আর্টিজানঃ কোন সময়ের দিকে যাচ্ছি আমরা?

এস.এম.আখিউজ্জামান মেনন
Published : 4 July 2016, 11:12 AM
Updated : 4 July 2016, 11:12 AM

হোলি আর্টিজানের রক্তাক্ত ঘটনা কি রক্তের বন্যায় বাধ দিলো নাকি নতুন প্রবাহমুখ খুলে দিলো? সেটা ভাববার সময় এসেছে আমাদের সকলের। গুলশানের ঘটনায় স্তব্ধ সমগ্র দেশ, তবে গত দুই বছরে দেশে ঘটে যাওয়া একের পর এক হত্যাকান্ড এবং হত্যাকান্ডের ধরণ যে এমনটা এক নারকীয় ঘটনার জন্ম দিবে তা হয়তো অনেকেই ভেবেছিল। ভাবনাটা আবার চেপে বসছে আরো দ্বিগুণ হয়ে অনেক থেকে অনেক অনেকের মাঝে। মানুষের মাঝে কাজ করছে চরম আতঙ্ক- আবার নাকি কী হয়ে যায়! আবার নাকি গলা কাটা লাশ সামনে এসে পড়ে অথবা নিজেই নাকি হয়ে যাই রক্তাক্ত?

গত দুই বছরের বাংলাদেশে ক্রমিক হত্যাকান্ডগুলো ছিল বড়ই মর্মান্তিক, নিঃসন্দেহে সকল হত্যাকান্ডই মর্মান্তিক, তবে বিশেষ মতাদর্শী মানুষদের হত্যার আদর্শে বিশ্বাসীরা যে নিষ্ঠুর উপায়ে খুন করেছে তার মর্মান্তিকতা বড়ই করুণ। হলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া ঘটনার পিছনে অবশ্যই বিগত দিনগুলোতে লেখক,প্রকাশক,ব্লগার,সমকামী আন্দোলনের নেতা,পুরোহিত,মতের অমিল জাগানিয়া ইমাম হত্যাকান্ডগুলোতে সরকার সহ দেশের উচ্চবিত্ত, সুবিধাভোগী নিম্নবিত্ত,ভোলা-ভালা দিনমজুর এবং আরো অনেকের নীরব ভূমিকা বড় ধরণের সাহয়ক হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষকরে ধর্মের আওতাহীন ট্যাগ খাওয়া মানুষেরা যখন ঘাড়ের উপর পৌনঃপুনিক কামারশালার শ্রেষ্ঠ যন্ত্রের আঘাত খেয়ে খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল তখন বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে উচ্চবিত্ত মৃদু আওয়াজে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে হয়তো খুন করা এবং খুন হওয়া উভয় মানুষদের মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্টের অধিকারী ভেবে হাতে থাকা ইংরেজি ম্যাগাজিনে মনযোগ দিয়েছে। মধ্যবিত্ত কেরুর বোতল হাতে হয়তো বলে উঠেছে – কত্ত বড় কথা ধর্ম অবাধ্যকারী! দিন-আনে-দিন-খায় মানুষেরাও খুশিতে হয়তো তালি দিয়েছে একজন নাফরমানের দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার খবরে।

অন্যদিকে সরকার রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া এবং এরই সাথে নিজেদের দূর্বল গণতান্ত্রিক অবস্থানের দরুণ প্রায় সসবগুলো হত্যাকান্ডে চুপ থাকার পাশাপাশি কিছুটা শাসিয়ে গিয়েছে ভিন্ন মতবাদের লেখার ধরণকে। হয়তো রক্তগরম, সময়ের বর্তমানতায় বোকা কিছু লোকজন খুনগুলোর বিরুদ্ধ্বে অনেককিছু বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাদের প্রতিবাদ শব্দ হারিয়ে অসহায় আর্তনাদে পরিণত হয়েছে, তাদের প্রতিবাদের মেলা দূর দিয়ে হেটেছে এমনকি তত্ত্ববাজ-প্রগতিশীল সুশীলরা, প্রতিবাদ আর্তনাদে পরিণত হবে সেটাই স্বভাবিক। হত্যাকান্ডগুলোতে সরকারসহ অধিকাংশ জনগণের এরুপ নীরব অবস্থান সাথে বহুলাংশে সমর্থন আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে আর্টিজানের রক্তাক্ত ফ্লোর, লাশেদের দল।

হত্যাকারীদের উদ্দ্যেশ্য কী এটা জানা আমাদের খুব প্রয়োজন। যদিও এই বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য সুশীলিয় উপাত্তভিত্তিক জ্ঞানের অভাব লেখকের যথেষ্ট, তথাপি বক্তব্যের নিজস্ব উপাস্থাপনে চেষ্টার আশ্রয় নেওয়া যেতেই পারে-
হত্যাকারীরা নিজদের এক বিশেষ ধরণের আদর্শের বাহক বলে মনে করে, সেই আদর্শের চূড়ান্ত লক্ষ্য দেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে বলে তারা প্রচার করে। খেলাফত প্রতিষ্ঠায় দেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থাকে বাধা হিসেবে ধরে তারা এই বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত হানতে চায়, এরই অংশ হিসেবে তারা নির্মম সকল হত্যাকান্ড ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়।

খেলাফতের বক্তব্য সরকারকর্তৃক নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরী বহু বছর ধরেই ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো কমলা-কালো পোস্টারে বলে আসছে। গত ৪-৫ বছর ধরে সরকারের নিরাপত্তাবাহিনীর লোকেরাও এই দলের অসংখ্য সমার্থককে জেলে ঢুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমূলে উৎপাটন সম্ভব হয়ে উঠেনি।

হত্যাকারীদের পরিচয় আসলে এতোটা সহজ কিংবা খেলাফত ভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরির উদ্দ্যেশ্য নিয়েই শুধুমাত্র হত্যাকান্ডগুলো করে যাচ্ছে তারা বিষয়টাকে এমনটা সরলরৈখিক ভাবার কোন কারণ নেই। আন্তর্জাতিক 'বাজারে' আইএস জংগী দলটির আগমনে বহু দেশের ভূ- রাজনৈতিক অনেক বিষয় পালটে গিয়েছে। আই এস কোন দেশের সৃষ্টি আর কোন দেশের এবং কাদের উপকারে আসছে সেটি ভিন্ন আলোচনা, তবে দূর্বল গণতান্ত্রিক দেশে জংগী হামলা হওয়া এবং সেই হামলার দায় আই এসের মত আন্তর্জাতিক ভয়ানক জংগী দলগুলো নিয়ে নিলে সেই সকল দূর্বল গণতান্ত্রিক দেশে পশ্চিমা মোড়লেরা যে দেশসমূহের রাজনৈতিক পরিবর্তনে সরাসরি চাপ দেওয়া থেকে শুরু করে প্রয়োজনে দেশগুলোতে নির্বিচার আক্রমণ করতে পারে তা নিকট ইতিহাসেই আছে।

দেশের বর্তমান সরকারের উপর যেহেতু দূর্বল গণতন্ত্র কিংবা অগণতান্ত্রিকতার অভিযোগ আছে তাই পশ্চিমা মোড়লদের এই দেশে নাক গলানোর হেতু খোজার যথেষ্ট উপকরণ সৃষ্টির উদ্দ্যেগকে ফেলে দেওয়া যায়না, মোড়লেরা হয়তো ক্ষমতার পালা বদলে তাদের আজ্ঞবহতায় আরো অধিক কাউকে বসাতে চায়। মোড়লেদের যুদ্ধভারে নূহ্য ঘাড় হয়তো নতুন দেশ আক্রমণের চিন্তা বাদ দিবে।

পশ্চিমা মোড়লের নব্য সঙ্গী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আমাদের দেশের ক্ষমতা নির্ধারণে কী অসীম পরিমাণ ভূমিকা থাকে সেকথা আমাদের সকলেরই জানা। যদিও বর্তমান সরকার বহু বড় বড় ঝড় সামলিয়ে আসছেন এই রাষ্ট্রটির কৃপা দৃষ্টির কল্যাণে, তাই এই দেশটি আমাদের দেশের তাদের পছন্দের লোকদের ক্ষমতা থেকে সরানোর খেলায় নাম লেখাবে সেটা ভাবা অযৌক্তিক আর হয়ে উঠেনা যখন ভূ-রাজনীতিতে নতুন ক্ষমতাবানের কাছ থেকে পূর্ববতীর তুলনায় অধিক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিংবা ক্ষমতায় থাকা পছন্দের লোকদের আরো চাপে ফেলে তারপর সাহায্যর নামান্তরে অধিক কিছু আদায়ের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়।

বিষয়টা এমনটা নয় যে গুলশানের ঘটনাটির উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিকল্পনার সম্ভাব্যতার আলোচনা হচ্ছে। আর্টিজানের ঘটনা পৃথক কোন ঘটনা নয় বরং এটি দেশে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক জংগী সংগঠনের শাখার সৃষ্টি এবং এরপর সংগঠনগুলোর পর্যায়ক্রমিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার ফল হচ্ছে গুলশানের ঘটনা।

তাই দেশে সৃষ্ট এই সকল সংগঠন তৈরিতে আন্তর্জাতিক বহুমুখী পরিকল্পনাকে বাদ দেওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নাই।

সরকার প্রথম দিকে রাজনৈতিক সুবিধা লাভে আই এসের উপস্থিতি দেশে স্বীকার করে পরবর্তীতে ভোল পালটিয়ে টানা দেশে আইএসের অনুপস্থিতি জোড় গলায় বলে যাচ্ছে। আর্টিজানে হামলাকারীদের পরিচয় টুকটাক পাওয়ার সাথে সাথে হামলাকারীদের প্রচ্ছন্ন হলেও আইএসের অন্তত মতাদর্শের সহিত যে যোগাযোগ ছিল এটা নিশ্চয়তার ডানার নীচে স্থান পাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক আই এস আমাদের দেশে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে সেটা আবশ্যক ভাবনার বিষয়।

এককালীন বর্তমান সরকারের বিরুধিদল পালাক্রমিক-সরকার-পতন আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক সকল কর্মকান্ডে জনগণের আস্থা হারিয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ে দেশ অচলের জংগী কর্মকান্ডে অথবা সৃষ্টিতে আধা বা পূর্ণাঙ্গ সাহায্য কিংবা সমর্থন দিতে পারে এটা বেশ ভালো মাত্রার একটি সম্ভাবনা।

সরকার পতন, রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন, দলীয় ক্ষোভের প্রতিশোধ গ্রহণ এই ত্রি-মাত্রিক ইচ্ছার সমাবেশ ঘটেছে জামায়াতে ইসলামীদের মাঝে। জামায়াতী নেতাদের ফাঁসি তাদের দলের নেতা-কর্মীদের করে তুলেছে খ্যাপাটে। আর রাষ্ট্র পরিবর্তনের বুলি সাথে সরকার বিরুধিতা তাদের বহু পুরানো বৈশিষ্ট্য।

সরকার গঠনা করা মন্ত্রী হওয়া জামায়াতীরা হয়তো কখনো ভাবতে পারেনি তাদের নেতাদের ক্রমান্বয়ে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। বহু জামায়াত-শিবিরের facebook প্রোফাইলে ঝুলে আছে ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া জামায়াতী নেতাদের ছবি। যদিও সরকারও এই ইস্যুতে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করেছে সর্বোচ্চ।

তাই জংগী সৃষ্টি কিংবা সৃষ্টিপ্রাপ্ত জংগীদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে জামায়াত অথবা তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের ভূমিকা বড় রকমের আলোচনার দাবীদার। অন্যদিকে জংগী সংগঠনগুলা, যদি নিজেরা শুধুমাত্র খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরির স্বপ্ন নিয়ে সৃষ্টি হয়ে থাকে, নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের স্বপ্নে সহমতের বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা সু-শৃংখল ক্যাডার ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের সাহায্য চাইতে পারে- এই সম্ভাবনাকে পাশ কাটানোর কোন অবকাশ নাই।

সরকারের নিজস্ব সৃষ্টি এই সকল জংগী দল, এই ভাবনা কন্সপাইরেসি থিওরির গন্ডির ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে মনে হয় অন্তত আর্টিজানের ঘটনার ব্যাপ্তিতা চিন্তা করে। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জংগী তৎপরতাকে সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ সরকার মনে হয়না কোনভাবেই এড়াতে পারবে। সময়ের ধারাবাহিকতায় হয়তো সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ আজ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। এরই সাথে জংগী দমনের নামে সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর গণগ্রেফতার, এনাকাউন্টার কার্যক্রমে জঙ্গি দমনে সরকারের আন্তরিকতাক হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। সর্বোপরি এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দল সহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহলের একে অন্যর প্রতি চালিয়ে যাওয়া ব্লেইম গেইম জঙ্গিদের উত্থানকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে।
খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন থেকে হউক বা দেশী-বিদেশি চক্রান্তের ফলে হউক জঙ্গি হিসেবে যারা বেড়ে উঠছে,যারা দিনের পর দিন নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে,যারা এসকল হত্যাকান্ডে নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও অত্যাধুনিক সব অস্ত্র নিয়ে হামলা করছে এরা সবাই কিন্তু আমাদের সমাজেরই মানুষেরা। আর্টিজান সহ গত ২-৩ বছরে ঘটে যাওয়া সকল জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারীদের অন্তত ৯০ শতাংশ ছিল তরুণেরা, বয়স ২০-৩০ বছরের মধ্যে। জঙ্গি হিসেবে আমরা যাদের দেখতে পাচ্ছি তাদের ব্যাপারে একটা সময় ধারণা করা হচ্ছিল গরীব ছেলেরা টাকার জন্য এসকল হত্যাকান্ড করে যাচ্ছে। কিন্তু আর্টিজানের ঘটনায় হত্যাকারীদের মধ্যে যখন অসম্ভব পর্যায়ের টাকা-পয়সার মালিকদের সন্তানদের দেখা গেল তখন এই ধারণায় চিড় ধরেছে। যদিও আর্টিজান এর ঘটনার বহু বছর আগে থেকেই বহু জঙ্গি দলে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত ছেলেদের দেখা গিয়েছে। এখন সকলের ভাষ্য বড়লোকের ছেলেরা পারিবারিক সংকট, বাবা-মায়ের অনৈক্য ব্যাক্তিগত হতাশা থেকে জঙ্গিবাদের আসক্ত হচ্ছে। পূর্বের গরীব বা মাদ্রাসার অথবা এখন বড়লোকের ছেলেদের জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়াকে আসলে দেখা হচ্ছে টানেল আই ভিশনের মধ্য দিয়ে। অনেকেই বলছে আর্থিক কষ্টে ভোগা কিংবা বিলাসিতায় গা-ভাসিয়ে বড় হওয়া মানুষেদের সহজেই ব্রেইন ওয়াশ করা যায়। ব্রেইন ওয়াশ করা কিংবা হওয়া দুটোই সময়সাপেক্ষ কাজ এটা তেমন কারো আলোচনায় আসছেনা। আর্টিজানের ঘটনার পর সকলে বলছে বিলাসী অনিয়ন্ত্রিত জীবনে হতাশা তরুণেরা ব্রেইন ওয়াশ হয়ে এই হত্যাকান্ড ঘটালো। বিষয়টা এমন না যে, বিলাসী অনিয়ন্ত্রিত জীবনে অভ্যস্ত কোন এক হত্যাকারী গুলশান লেকের পাড়ে বসে ছিল হতাশ হয়ে আর তখন কোন জঙ্গি নেতা এসে তাকে মন্ত্র পড়ে ব্রেইন ওয়াশ করে দিলো আর অমনি সে অস্ত্র হাতে মানুষ খুন করতে নেমে গেল।

ক্যাডার ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলা তাদের এই কর্মী বাহিনী তৈরি করতে, ব্রেইন ওয়াশড তরুণেদের খুন করার মত গড়ে তুলতে বহু সময় ব্যায় করে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তবে মা-বাবার বিচ্ছেদে অথবা বাবার বহুগামিতা এবং মায়ের ভোগাসক্ত জীবন বা আরো অজস্র কারণ দেখে হতাশ স্নেহহীন মাম্মি/ড্যাডির ছেলের কাধে কোন জঙ্গি হাত রাখলে, কোমল আচরণ করলে সেই ছেলেটা কিংবা অর্থকষ্টে ভোগা কোন এক ছেলেকে বাবার চিকিৎসায় কোন ক্যাডার ভিত্তিক দলের ভূমিকা তাদের এই সকল জঙ্গি বা ক্যাডার ভিত্তিক দলে ভিড়তে প্রাথমিক আগ্রহ সৃষ্টি করবে এটা সত্য। কিন্তু এরপর এসকল তরুণ যুবকদের নিজেদের দলে ভিড়াতে জঙ্গি দলের নেতা-কর্মীরা খেটে গিয়েছে দিনের পর দিন। দলে ভেড়াতে কোন আলালের ঘরের দুলাল বা মধ্যবিত্ত ঘরের মোহগ্রস্ত সন্তান বা প্রান্তিক দুঃসাহসী ছেলেগুলোর সাথে তারা সময় কাটিয়েছে, একসাথে খাবার খেয়েছে, দুঃখের সময় মাথায় হাত বুলিয়েছে, মোদ্দাকথা নিজেদের প্রতি ছেলেগুলোর অন্ধভক্তি গড়ে তুলতে যা যা প্রয়োজন তারা করে গিয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো মানুষের সহানুভূতি এবং ভালোবাসার আকাঙ্খা ভীষণ, তাই জঙ্গিরা তাদের দলে লোকজন ভেড়াতে এই দুইয়ের আশ্রয় নিয়ে থাকে, এমনকি হলি আর্টিজানের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কাউকে পরবর্তীতে জঙ্গিবাদ সমার্থন করতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।স্টকহোম বা ক্যাপচার-বন্ডিং সিন্ড্রোম কিন্তু তাই বলে, শোনা যাচ্ছে হলি আর্টিজানের হামলাকারীরা আটককৃত অনেককে ভালো ব্যবহারের সহিত খাওয়া-দাওয়া করিয়েছে, এই সামান্য কৃত্রিম সহানুভূতি তাদের ভুলিয়ে দিতে পারে তাদের পাশে পড়ে থাকা নিথর রক্তাক্ত দেহের উপর দিয়ে হয়ে যাওয়া নৃশংস আক্রমণকে।

অন্ধভক্তি গড়ে তুলে তারপর জঙ্গিরা ছেলেগুলোকে হত্যার উপযোগী করে তুলতে আশ্রয় নিয়েছে ধর্মীয় টেক্সটের, ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ খুন এবং ভিন্ন মতের সরকার পতনে অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিদেশী নাগরিক হত্যার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে ধর্মীয় টেক্সট সমার্থনসূচক অগণিত আলোচনায়।

ধর্মীয় টেক্সটের আলোচনায় যেই বিষয়টি অনেকই বলে থাকেন, টেক্সটের বক্তব্য জঙ্গিরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে ছেলেদের ব্রেইন ওয়াশের কাজটি সারে। টেক্সটের বক্তব্যর ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা যে এই প্রথম তা নয় বরং এখনকার তুলনায় আরো বহুগুন ব্যাপক পরিসরে ৬৫৬ সাল থেকে অন্তত ১২০০ সাল পর্যন্ত অজস্র আলোচনা হয়ে গিয়েছে, ইতিহাসের দিকে তাকালেই যেকারো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। প্রায় সাড়ে তেরশ বছরের ক্রমিক আলোচনা-পর্যালোচনায় পরও যেহেতু টেক্সটের একমাত্র ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি সেহেতু বিষয়টা নিয়ে সমাধানের পথ যে খুব একটা সহজ না সেটা সহজেই অনুমেয়। তাই আমার আপনার ভাসা ভাসা আলোচনায় জঙ্গিরা তাদের উন্মাদনায় লাগাম টানবে সেটা আশা করা বোকামি হয়ে যাবে। লাখো এলেমদারের স্বাক্ষর যে কোন কাজে আসেনি সেটাতো আমরা দেখলামই। যদিও স্বাক্ষর কর্মসূচী কতটা পরিশুদ্ধ মানুষিকতা আর কতোটা রাজনৈতিক স্ট্যান্ড ছিল সেটা আলোচনাসাপেক্ষ বিষয়। এখন কথা হচ্ছে হলো টেক্সটের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারাই হোক কিংবা সঠিক ব্যাখ্যা দ্বারা সংগঠিত হত্যাকান্ডগুলোকে সরকার কি মেনে নিবে?

নিজেদের গায়ে ধর্ম নিরপেক্ষ ট্যাগ লাগিয়ে স্থানভেদে ধর্মপ্রযুক্ত বিভিন্ন মতবাদ প্রতিষ্টার ঘোষণা সরকারের সুবিধাবাদীতা হিসেবে অনায়াসেই চিহ্নিত হয়ে পড়ে। এরই সাথে নির্দিষ্ট মতাদর্শের লেখনীর উপর নিষিদ্ধতা জ্ঞাপন যৌক্তিকতার স্পর্শ পায় কিনা সেটা ভাবনার বিষয়। তবে লেখনশৈলীর সমগ্রটাজুড়ে যদি ব্যাঙ্গ, অর্বাচীন আক্রমণ থাকে তবে সেই লেখনী মতাদর্শিক চ্যালেঞ্জে কোন কাজ দেয় কিনা নাকি শুধু ক্ষোভকে খাবার জোগানো হয় সেটা চিন্তার বিষয়। কিন্তু কেউ যদি ব্যাঙ্গের আশ্রয় নিয়েই থাকে তাকে হত্যা করার লাইসেন্স দেওয়ার অন্তত কোন নৈতিক ব্যাখ্যা নাই অন্য যেকোন ব্যাখ্যা থাকার সম্ভবনা বহু।

জঙ্গিদের নিজেদের দলে লোক ভেড়ানোর মেহনতের পরিমাণ উল্ল্যেখ করার কারণ- যারা বলছেন জঙ্গিত্ববাদে ঝুকে পড়া মূলত চরম মাত্রায় ব্রেইন ওয়াশ হওয়ার ফল, যেহেতু জঙ্গিত্ববাদে আগ্রহীদের আগ্রহ তৈরিতে বছরের পর বছর জঙ্গিকর্মীরা নিরলস মেহনত করে যাচ্ছে তাই আমাদের জঙ্গিত্ববাদে অগ্রসরকারীদের বলা,তোমরা ব্রেইনওয়াশ হচ্ছো টাইপের কথাবার্তা শুনেই তারা তাদের পথ থেকে ফিরে আসবে এটা ভাবা আমাদের অজ্ঞতার পরিচয় দিবে বেশ স্বভাবিকভাবেই।

জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদের ভিতর জ্ঞানগত, সংস্কৃতিগত চিন্তা ভাবনার উদয় ঘটাতে হবে। মুক্তচিন্তার চর্চায় ব্যাপকতা আনতে হবে, এ ব্যাপারে সরকারকে তার সুবিধাবাদী জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধে আদর্শিক মোকাবেলায় নিরলস কাজ করে যাওয়া মানুষেদের সামনে আসতে হবে। এ কাজে আমাদের যাদের উপর ভরসা ছিল সেই প্রগতিশীল দলের লোকেরা বর্তমানে তাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্ক, নিজেদের ভালোবাসার বস্তু ঘাস-পানি-কাম এ এবং সর্বোপরি নিজের আখের গোছাতে এতটাই ব্যাস্ত যে তাদের এ বিষয়ে লক্ষ্য করার সময় নাই। খেলার ঘরের মতো সংগঠনকে আজ মাইক্রোস্কোপে খুঁজে না পাওয়া গেলেও জঙ্গিবাদের পূজারী ম্যাগাজিন,পোস্টার ঢাকার আনাচে-কানাচে দেখতে পাওয়া যায়।

বর্তমান সময়ে পরিণত হওয়া ফ্যাশন-টেররিজম বা মুভি-সিরিয়ালে দেখানো গৌরবময় হত্যাকাণ্ড অনুপ্রাণিত জঙ্গিবাদে ঝুকে পড়া তরুণের সংখ্যা ও কম নয়। অন্যদিকে এই উপমহাদেশের মহান প্রেমে ব্যর্থ তরুণেরা প্রথমে misogynust ততঃপর হয়ে ওঠে misanthropist । মানুষবিরোধি হয়ে ওঠা এই তরুণেদের দ্বারা একের পর এক নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটানো কঠিন কোন বিষয় নয়।

অল্প কিছু দিন আগে অর্থহীন ব্যান্ডের রিলিজ হওয়া ক্যান্সারের নিশিকাব্য এ্যালবামের নিকৃষ্ট ৩ গানে ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকার উদ্দ্যেশ্যে একটি বাক্য আছে এমন,'দাঁড়িয়ে থাকবো কবরের পাশে,যেদিন রাতে জোছনা উঠবে ঘৃণায় ভিজবে তুমি মুত্র দিয়ে' । ছেঁড়ে যাওয়া প্রেমিকার প্রতি যদি এতটা জঘন্য ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোকে যদি এভাবে উসকে দেওয়া হয় তবে দেশের ক্রমিক misogynist থেকে হয়ে ওঠা misanthropist তরুণদের দ্বারা যেকোন প্রকার হত্যাকান্ড ঘটানো সম্ভব হয়ে ওঠে, এরই সাথে যদি হত্যাকান্ডের ন-ইহকালীন পুরষ্কারের বিষয় সামনে আনা যায় তবে হত্যাকান্ডের সহজতা আরো বৃদ্ধি পায়।

আলোচনা শুরু হয়েছিল আর্টিজানের ঘটনা কি রক্তাক্ত হত্যাকান্ডের শেষ নাকি আরো বড় বড় ঘটনা জন্ম দেওয়ার শুরু মাত্র সেই প্রশ্ন নিয়ে। শুরু ধরে নেওয়াই হয়তো প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হবে। এতদিন ন-আস্তিক এবং অন্য মতাদর্শের লোকের হত্যাকান্ডে যারা নিশ্চুপ থেকে হত্যাকান্ডগুলতে নীরব বা স্থানবিশেষ সরব সমার্থনের ভূমিকা রেখেছিলেন এবার তাদের আমাদের সকলের উপরই আঘাত এসে পড়েছে। এই আঘাত মোকাবেলায় সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সংকীর্ণতার গণ্ডি ভেদ করে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে । বিগত বছরগুলোতে সকল ছোট-বড় রাজনঈতিক বিরুধিদলকে সরকার যেভাবে কোন্ঠাসা করে রেখেছে তাতে সরকার মুলত অরাজকতার পথকে জায়গা করে দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞানগত আন্দোলনের হারিয়ে যাওয়া চর্চার পুনঃপ্রতিষ্টা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।