জীবনের পড়ন্ত বেলায়

Published : 30 Sept 2012, 06:46 PM
Updated : 30 Sept 2012, 06:46 PM

আজও ঘুরে ফিরে সাপ্তাহিক ছুটির প্রথম দিন অর্থাৎ শনিবার। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভাল ঠেকছে না, খুব কাহিল লাগছে। যদিও প্রত্যহ নিয়ম করেই ঔষধ সেবন করি। তার সাথে খাবার দাবারের বাছাই করা তালিকা তো আছেই। বয়সকালে আমাদের অধিকাংশ বাঙালিদের যা হয় আর কী। শুক্রবার অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই ভাবছিলাম ছুটির দুটো দিন নো আউট গোইং, নো রান্নাবান্না – অনলি রেস্ট! গত মঙ্গল কী বুধবারে আমার একমাত্র মেয়ে সন্তানের সাথে প্রোগ্রাম করেছিলাম যে আজই পুরো পরিবার অর্থাৎ আমি, আমার স্ত্রী, মেয়ে, মেয়ের জামাই আর ফুটফুটে নাতনিকে নিয়ে শপিং এ বের হবো। প্রোগ্রামটা করা হয়েছিল মেইনলি নাতনিকে ঘিরেই। প্রোগ্রামটা যে গতরাতেই মন থেকে বাতিল করেছি, সেটা আর জানাবো জানাবো করে কাউকে জানানো হয় নি। সম্ভবত ছোট শিশুটির মুখোমূখী হতে, আশা-আকাংখা ভাঙ্গতে পারব না বলে।

সকাল ন'টা নাগাদ ফোন এলো। ওপ্রান্ত থেকে মেয়ের কন্ঠ " বাবা ঘুম থেকে তোমরা উঠেছ"? আমি ভাবলাম এখনি বলবে " জলদি তৈরী হয়ে নাও, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের পিক করে নেব"। না, বলল অন্য কথা "হ্যাপী প্রবীন ডে"। যাচ্ছিতো আজ মার্কেটে? বললাম " নারে, শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। প্রেশারটা একটু বেশিই বেড়েছে। তোর মার যাওয়ার ইচ্ছে আছে, তাঁকে পিক করে নে।" ফোনেই জিজ্ঞেস করলাম " আজ যে প্রবীন দিবস তুই জানলি কোত্থেকে? ও হ্যা, সকালে টিভিতে দেখেছিস বোধহয়। আরও জিজ্ঞেস করলাম " তা আর কি কি বাণী শুনলি, শোনা দেখি আমাদেরকে"। উত্তর এলো " মাকে পিক করে বাজার সদাই পর্ব শেষ করে বাড়ীতে ফিরে ডিটেইলস বলব"। ঠিক আছে অপেক্ষায় থাকলাম তোদের জন্য বিশেষ করে অতি আদরের নাতনির।

ইন্টারকম বেজে উঠলো, আমার স্ত্রী নীচে নেমে গেল। বিছানা থেকে একদম উঠতে মন চাইছে না। চোখ মেলে ভাবছি ওদের ফিরতে বেশ কয়েক ঘন্টার মামলা। এ সময়টুকু কি করে কাটাই। সকালে মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদটি আমাকে মোটেও ভাবিয়ে তোলেনি। বার্ধক্য প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবনের শেষ অধ্যায়। একে অস্বীকার করা যায় না। ভাবতে ভাবতে আধাশোয়া অবস্থায় ল্যাপটপ কোলের ওপর বসিয়ে নিলাম। চিন্তাগুলো সব এলোমেলো হয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শুরু করে দিলাম লিখতে যা আসে মনে আবোল তাবোল।

আবারো ইন্টারকম বেজে ওঠায় একরকম বাধ্য হয়েই বিছানা থেকে উঠতে হলো। বুঝলাম ওরা এসে গেছে। রিসিভার তুলেই রাগস্বরে জিজ্ঞেস করলাম " কী ব্যাপার সাথে চাবি নেই"। পরক্ষনেই নাতনির কন্ঠ শুনে রাগ একেবারেই জল। চার বছরের ঐ টুকু মেয়ে বলছে " আমাদের সকলেরই দু'টি হাত ব্যস্ত"। বুঝলাম ইচ্ছে মত কেনাকাটি হয়েছে আজ। বাটন টিপে নিচের প্রধান ফটক খুলে দিয়ে আর ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রেখে ফিরে গেলাম ল্যাপটপ সহ আধাশোয়া অবস্থায়। হৈ হুল্লা উৎসবের আমেজ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ব্যস শুরু হয়ে গেল কথার খই ফোটা। আক্ষেপ করে বলল কেন আমি গেলাম না তাঁদের সাথে ইত্যাদি। এ সপ্তাহে তাঁর সমস্ত কার্যাবলীর ফিরিস্তি দিতে লাগলো। নিজের কথার ফাঁকে ফাঁকে আমারও দিন দুনিয়ার খোজ খবর নিচ্ছে। ওদিকে মা-মেয়ে শপিং গোছানোর কাজে ব্যস্ত। মেয়ে জামাই নীচে রয়ে গেছে পরিচিতদের সাথে আড্ডা মারতে। কিছুক্ষণ বাদেই উপরে উঠে আসবে।

নাতনির কথা শুনতে শুনতেই হাঁক দিলাম, তোমাদের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই খাবার সাজিয়ে নিয়ে চলে এসো। রান্নাবান্না হবে না জেনেই বাহির থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। সকাল থেকে শুধু এক কাপ চা ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি। ভালই হলো। খেতে খেতে শোনা যাবে সকালের না শোনা কাহিনী। তো বল এখন কী শুনলি অমর বাণী!!

* প্রবীণ শব্দে লুকিয়ে আছে শ্রদ্ধা, মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ, প্রেরণা, আস্থা ইত্যাদি।
* দেশ, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ও সভ্যতার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে প্রবীণদের ভূমিকা।
* আজকে যারা প্রবীণ, কোন না কোন সময় তারা নবীন হয়ে দেশ ও জাতি রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
* প্রবীণ সমাজের এত যে অবদান, ত্যাগ, তার কি যথাযথ মর্যাদা আমরা দিতে পারি না?
* আমাদের প্রবীণ সমাজ যখন বয়সের ভারে হয়ে পড়ে ন্যুব্জ, হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক চলাফেরার শক্তি, তখন কি আমরা তাদের দিকে সেই ভালোবাসা বা নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি না?

ভোজন পর্বের মাঝেই মেয়ে জামাই চলে এলো। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম আমাদের বুড়ো বুড়ি সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কী? উত্তর ইতিবাচক, কখনোই ছুঁড়ে ফেলে দেবে না – যত্ন, পরিচর্যা, খেয়াল রাখার আশ্বাস। আমাদের নাতনির প্রমিজ আরও দীর্ঘ হলো। আমরাও আশ্বস্থ হলাম। মনটা আবারো বিষন্নতায় ভরে যেতে লাগলো।

ওদের যাবার সময় হয়ে এসেছে। ওর পাকা পাকা, মিষ্টি মিষ্টি কথার মাঝে প্রৌঢ়ত্বের বেদনা খানিকটা সময়ের জন্যে হলেও ভুলে ছিলাম। যদিও ওদের সাথে সপ্তাহে কমপক্ষে দু'বার দেখা হয়। তারপরও……….. !!! যাবার প্রাক্কালে ওর মা পাশের ঘরে ওকে ডেকে নিয়ে কী যেন বলল। মিনিট দুয়েক পর আমাদের ঘরে প্রবেশ করলো দু'হাতে কী যেন দু'টো জিনিষ নিয়ে। আমাদের দু'জনকেই একসাথে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর নানীকে আর আমাকে একটি করে প্যাকেট দিয়ে বলল " তোমাদের প্রবীন জীবন সুখময় হউক "। আরও যোগ করলো প্যাকেট দু'টি যেন তাঁরা চলে যাওয়ার পর খুলি। ওদেরকে লিফটে চড়িয়ে বিদায় জানিয়েই ছুটলাম ঘরের দিকে দু'জনেই। তর সইছিলনা। প্যাকেট খুলতেই দেখি স্ত্রীর জন্য একটি কাশ্মীরী শাল আর আমার জন্যে একটি চশমার ফ্রেম। দু'জনেই দু'জনার দিকে তাকিয়ে দেখি চোখের কোনায় আনন্দের অশ্রু।

* লেখাটি পুরোনো