কালীগঙ্গা তীরের সাঁইজী

Published : 17 Oct 2012, 05:05 AM
Updated : 17 Oct 2012, 05:05 AM

কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম ছেঁউড়িয়া। এক পাশে শান্ত নদী গড়াই, অন্য পাশে কালিগঙ্গা নদী। এখানেই বাউল সম্রাট লালন শাহের সমাধি। এই সমাধিকে ঘিরে প্রতি বছর বসছে লালন মেলা। প্রতি বছর দুটি অনুষ্ঠানে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও আসেন লালন ভক্তরা। বাউল ফকিরদের কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা তৈরি করে লালনের গান। লাখো ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয় লালন আখড়া।

উনিশ শতকের মহাজাগরনের কর্মকান্ড ছিল মহানগর কেন্দ্রিক। অপর দিকে লালন ছিলেন গ্রামের মানুষ। আলোকিত হওয়ার মত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। তারপরও লালনের সাধনা, সঙ্গীত, দর্শন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ময়কর জাগরণের জোয়ার তুলেছিল। জাত ধর্ম নির্বিশেষে দলে দলে তখনকার সমাজের অনেক শিক্ষিত মানুষও লালনের মানবতত্বের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সমকালীন চিন্তায় তাই লালন বাঙ্গালীর মানসপটে এক ব্যতিক্রমী আবির্ভাব।

ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম লালন। তিনি একাধারে বাউল সাধক, গীতিকার, সুরকার, ও গায়ক। তাকে "বাউল সম্রাট" হিসেবেও অভিহিত করা হয়। প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী। তাই অসাম্প্রদায়িক। প্রচলিত সব ধর্মের অন্তর্নিহিত বানী হচ্ছে- শান্তি, মঙ্গল কামনা। তাই লালনের দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে মানুষ। আর এই দর্শন প্রচারের জন্য শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন। লালন সব সময় প্রমান করেছেন তার গানে- সবার উপরে মানুষ সত্য। অনেকেই লালনকে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে। কেউ তাকে হিন্দু, আবার কেউবা তাকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন। আর লালন তাঁর সারা জীবন এই জাত পাতের বিরুদ্ধে নিজের গানকে অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন এই সমাজে।

মৃত্যুর প্রায় এক মাস আগে তাঁর পেটের ব্যারাম হয়, হাত-পায়ের গ্রন্থিতে পানি জমে। পীড়িতকালেও তিনি পরমেশ্বরের নাম সাধন করতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হতেন। দুপুরে সাধন ঘরের সামনে সামিয়ানা টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকেল থেকে শুরু করে সারা রাত লালন তার শিষ্যদের শাশ্বত বাণী শোনা, মাঝে মাঝে গাওয়া হয় তার গান। রাতে আলোচনা শেষ করে লালন সাধন ঘরে ফিরে গেলেন বিশ্রাম নিতে। শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম। লালন চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাদর সরিয়ে বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাব। লালন গান ধরলেন, গভীর অপরূপ সুন্দর গান 'পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে/ক্ষম হে অপরাধ আমার/এই ভব কারাগারে।' গান শেষ হলো, চাদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি। তিনি ১ কার্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর। সে হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে।

আগে লালনের গানের সুর ও কথা বিভিন্ন বাউলের একতারা কিংবা দোতারাতে, কন্ঠে গ্রাম বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা এখন ধীরে ধীরে আমাদের বাংলাদেশের নগর সভ্যতায় বেশ পাকা পোক্ত স্থান করে নিয়েছে। অপসংস্কৃতির জোয়ারে বাংলার লোক সংস্কৃতিকে গ্রাস করার উপক্রম হলেও লালনগীতি আজো উজ্জল হয়ে আছে বাঙ্গালীর মনন ও মানসে। তাই লালন আমাদের বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতির একটি অংশ, একটি বড় উপাদান ও ঐতিহ্য। তার ধারক বাহক বাউলরা।

মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলী সাধু, মুক্তিযোদ্ধা নুহীর সাধু, আব্দুল করিম সাধু, কুদ্দুস সাধু, ফরিদা পারভীন, টুন টুন সাধু, মাওলা পাগলা, বজলু সাধু, হুমায়ুন সাধু, রব সাধু, লতিফ সাধু, আকলিমাদি সহ আরও অনেক নাম না জানা সাধুগণ যারা অপরিসীম সাধনার, অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সারা বিশ্বে সাইজির দর্শন ও অমর বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছেন: যারা অকুতোভয় ও সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ করে চলেছেন অন্যায়, অত্যাচার আর মৌলবাদীদের উপর্যপুরি হামলা; জানাই তাঁদের অকৃত্রিম গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

http://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=TqL9_p0Mwatch?feature=player_embedded&v=TqL9_p0M-SQ-SQ

*ছবি সংগ্রহ নেট থেকে
*রেফারেন্স: "লালন-জীবনী" (দুদ্দু শাহ), "লালন শাহ জীবন ও গান" (এস.এম.লুৎফর রহমান)