ইসলামী লিপিকলায় রুশ মুখাবয়ব

Published : 21 Oct 2012, 07:34 PM
Updated : 21 Oct 2012, 07:34 PM

একটা চিরন্তন সত্য হচ্ছে, মানুষের জীবনটা আয়ুর পরিধিতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার কীর্তি সময়কে অতিক্রম করে অমরত্ব লাভে সক্ষম। আর এ জন্যই সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীয় অমর কীর্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকেন। আমরা অতীত এবং বর্তমান সময়ের পরতে পরতে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, রাজা রাজন্যসহ সমাজপতি সচেতন শিক্ষিত শ্রেণী তাদের কীর্তিকথা বিজয়গাথা, রাজ্যশাসনের নীতিমালা, উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কালের অতল গহ্বরে অনেক কীর্তি হারিয়ে যায় আবার কোন উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় অতীত রহস্য। ভবিষ্যতের জন্য কীর্তির তথ্য জমা রাখার সহজ পন্থা হিসেবে লিপির অবলম্বন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এভাবে লিপির মাধ্যমে অতীত অভিজ্ঞতা চলে আসে বর্তমানের হাতে।

লিপির ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। লিপির আবিস্কার কিভাবে হল, এ নিয়ে ইউরোপীয় বিখ্যাত লিপিতত্ত্ববিদ কানিংহাম বলেন- মানুষ তার চারপাশের দৃশ্যমান বস্তু দর্শন করে সেই সব বস্তুর অনুরূপ আকারে অক্ষর তৈরি করেছে। এছাড়া অন্যমত হচ্ছে- পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থগুলো হচ্ছে ধর্মের। তাই লিপির আবিস্কার ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ প্রায় অধিকাংশ ভাষা লিপির বর্ণগুলো দেব-দেবী বা অলৌকিক কিছুর নামে নামকরণ করা হয়েছে।

আরব সভ্যতার উত্থানের পেছনে যে উপাদানগুলো সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে প্রথমত-কুরআন, দ্বিতয়ত-ইসলাম পূর্ব কবিতা এবং চূড়ান্ত প্রর্যায়ে ক্যালিগ্রাফি ও স্থাপত্য। পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে মূলত ইসলামী ক্যালিগ্রাফির দ্রুত বিকাশ লাভ করা সম্ভব হয়েছে। ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে হাতে লিখে কুরআনের কপি করা হতো। ইসলামে সমাজ, ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র সব কিছুই কুরআন আবর্তিত। সুতরাং মুসলিম সভ্যতা কুরআনকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে। একে যতভাবে পারা যায় সৌন্দর্যমণ্ডিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। সারাবিশ্বে লিপিমালার শিল্পময় স্থান তুলনা করলে, অবধারিতভাবে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি শীর্ষস্থান দখল করবে। ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা, সৌন্দর্যময়তা প্রদানের অত্যাগ্রহ ও পিপাসা, বিশ্বাসের প্রতি অঙ্গীকার, ধর্মীয়ভাবে তীক্ষ্ণ শিল্পবোধ সম্পন্ন ক্যালিগ্রাফারদের কঠোর সাধনা ও আত্মনিয়োগের ফলে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিশ্বখ্যাত মর্যাদায় আসীন হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী মুসলিম এবং ইসলামী সংস্কৃতি আজ এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যেন একটি প্রাচীন বৃক্ষ তার বহুদূর বিস্তৃত ফুলের ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে। ডালপালাগুলোতে বহুবর্ণের ফুলের মতো মুসলিম স্থপতি, শিল্পী, লেখক এবং চিন্তাবিদ-গবেষকগণ তাদের মহান ঐতিহাসিক ঐতিহ্যিক নিদর্শনকে নবরূপে, নতুন সাজে প্রতিনিয়ত প্রস্ফুটিত করে চলেছেন। তাদের এই কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দীপনা ও প্রবাহকে আল হাল্লাজের রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক কবিতার মত তুলনা করা যায়। অথবা প্রাচীন হিব্রু চিত্রকলার ঐতিহ্যিক রং ব্যবহারের মত ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে একাধারে শৈল্পিক বোধ, ঐতিহ্য, রংয়ের বিচিত্রতা এবং প্রতিনিয়ত শিল্পময় আবিষ্কারের ভাবনা নতুন নতুন সৌন্দর্যময় আবহ ও আক্ষরিকভাবেই নতুন দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছে। শিল্পের মহান গবেষকগণ, বিশেষ করে ইসলামিক আর্টের সাথে যারা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছেন। তেমনই একজন রুশ প্রথিতযশা লিপিকার ভ্লাদিমির পাপভ।

ভ্লাদিমির পাপভ মূলত রুশ চিত্রশিল্পী। জন্মগ্রহণ এবং বেড়ে ওঠা তাতারস্থানের রাজধানী কাজানে। ১৮ বছর বয়সে তিনি পিতৃভূমি যুদ্ধে বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। গোয়েন্দা স্কাউট হিসেবে নিয়োগ পান এবং "ব্যাটেল ফর বার্লিন" এর অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ প্রজাতন্ত্রের স্বায়ত্তশাসিত তাতারস্থান ও মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর ইমারত, স্থাপত্য শিল্পে বলা যায় কুফি লিপির মনোপলি ব্যবহার হয়েছে। কুফি লিপি আরবি লিপির সবচেয়ে প্রাচীনতম লিপির অন্যতম।


কুফি লিপি

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে তিনি পুরোদমে চিত্রকলায় নিজেকে মনোনিবেশ করেন। একবার কাজানে তিনি একজন চিত্রশিল্পী, লেখিকার বাড়িতে অতিথি হয়ে বেড়াতে যান। তাঁর লাইব্রেরিতে তিনি বেশ কিছু ক্যালিগ্রাফির ওপর বই দেখতে পান। যার মধ্যে ছিল আরবি কুফি এবং সুলুস [ আরবি ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষনীয় লিপির নাম হচ্ছে সুলুস। সুলুস(ইংরেজি উচ্চারণ থুলুথ) কথাটা আরবিতে এক তৃতীয়াংশ বোঝায়। বর্তমানে তুরস্কে ক্যালিগ্রাফির প্রধান লিপি এটা। সেখানে একে Sülüs(সুলুস) বলে।] লিপিকলার ওপর বই। সেখান থেকেই মূলত আরবি ক্যালিগ্রাফির ওপর তাঁর আগ্রহ জাগে। তারপর তিনি ইরান ও তুরস্কসহ মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলো ভ্রমন করেছেন আরবি ক্যালিগ্রাফির ওপর বিশদ জ্ঞান অন্বেষণে। ১৯৯৪ সালে প্রথম তিনি রুশ-আরবির সংমিশ্রণে চিত্রকলার কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে কাজানের সেন্ট্রাল আর্ট গ্যালারিতে তাঁর প্রথম রুশ-আরবি চিত্রকলা প্রদর্শিত হয়। এরপর শুধু রাশিয়ার ভেতরেই থেমে থাকে নি তাঁর প্রদর্শনী। আরব দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী করে কুড়িয়েছেন অঢেল খ্যাতি। এটি ছিল রাশিয়ার চিত্রকলা জগতের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর চমক!


সুলুস লিপি

মুসলিম-অমুসলিম সব শিল্পবোদ্ধাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে, "মহান ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে মিউজিক বা সঙ্গীতের মত। এটা আয়ত্ত করতে হয় তীক্ষ্ণ মনসংযোগ নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য সাধনা ও নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল বিধি মেনে চলে।" প্রতিদিন গলা সাধার মত ক্যালিগ্রাফির কলম দিয়ে অনুশীলনী চালিয়ে যেতে হয়। হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফির গুপ্ত কৌশলগুলো শিখে নিতে হয়। ওস্তাদ যদি সূক্ষ্ম কৌশল দেখিয়ে না দেন তাহলে আক্ষরিক নিপুণতা বলতে যা বোঝায় সেটা আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য খাগের কলম কাটা এবং সেটা দিয়ে হরফকে স্বাচ্ছন্দ্যে লেখা সম্বন্ধে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক কাজী আহমদ যর্থাথ মন্তব্য করেছেন। তিনি কলমের প্রতীক এভাবে বর্ণনা করেছেন, "মানবের কাছে প্রভুর দেয়া সব জ্ঞানের বাহন হচ্ছে কলম।"

ভ্লাদিমির পাপভের আঁকা রুশ-আরবি সংমিশ্রিত কয়েকটি চিত্রকর্ম:

*ছবি সব অন্তর্জাল থেকে নেয়া
*রেফারেন্স: বাঙালা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস, বর্ণমালার উদ্ভববিকাশ ও লিপিসভ্যতার ইতিবৃত্ত, ভাষা লিপি ও সাহিত্য (নেট থেকে সংগৃহীত)