দুই বছরের ব্যবধান : আলেন্দে ও বঙ্গবন্ধু ( মহান নেতাদের প্রতি লাল সালাম ও আলেন্দের শুভ জন্মদিনে উৎসর্গ )

Published : 26 July 2011, 04:37 PM
Updated : 26 July 2011, 04:37 PM

গত শতকের সত্তরের দশকের গোঁড়ায় মার্কিন সিআইএর প্রত্যক্ষ মদদ ও সহযোগিতায় পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল | একটি চিলিতে এবং অন্যটি বাংলাদেশে | চিলিতে অভ্যুত্থান ঘটানো হয় ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর | দেশটির নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছিল | তবে সেনাজান্তার নরপশু ঘাতকরা আলেন্দের স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল |

বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাঁদের কাছে এক অনন্য নাম সালভাদর আলেন্দে | তিনি লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে চিলির প্রথম সমাজবাদী, মার্কসবাদী প্রেসিডেন্ট, যিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন | ১৯৭০ সালে তিনি সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী ও দলছুট খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটদের এক কোয়ালিশনের নেতা হিসেবে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব অল্প ব্যবধানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন | সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হবার ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে এক বেতার ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ''আমি নিশ্চিত আমার এই আত্মত্যাগ বিফলে যাবেনা" |

কিন্তু কেন আমেরিকা আলেন্দের পেছেন লেগেছিল ? এর উত্তর দুটি | প্রথমত, নাকের ডগায় অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত আরেকটি কমিউনিস্ট দেশের আবির্ভাব ঠেকানো | কারণ তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধ চলছিল |

দ্বিতীয়ত, চিলিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা | কারণ সমাজবাদে বিশ্বাসী আলেন্দে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি সব তামার খনি এবং বিদেশিদের (বিশেষ করে মার্কিন) মালিকানাধীন অনেক ব্যবসা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বাজেয়াপ্ত করে জাতীয়করণ করেন | উল্লেখ্য, এই তামা শিল্প হলো চিলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত | আর এতে বিনিয়োগ ছিল মার্কিন দুটি কোম্পানির | যাদের হাতে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় তামা খনির নিয়ন্ত্রণ | ফলে স্বাভাবিকভাবেই আলেন্দের সিদ্ধান্তে বড় ধরণের ক্ষতি হয়েছিল মার্কিন কোম্পানিগুলোর | সিআইএ'র প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নির্বাচনে যেন আলেন্দে জিততে না পারে সেজন্য মার্কিন একটি কোম্পানি সিআইএ'র মাধ্যমে আলেন্দের বিরোধী পক্ষকে সাত লক্ষ ডলার দিয়েছিল | এছাড়া আলেন্দের পরাজয় নিশ্চিত করতে ঐ কোম্পানিটি সিআইএ'কে আরও ১০ লক্ষ ডলার দিতে চেয়েছিল |

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য জোটনিরপেক্ষ সন্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন | আমন্ত্রিত অনেক বিশ্ব নেতাদের মাঝে ছিলেন সালভাদর আলেন্দে, ফিদেল কাস্ট্রো প্রমূখেরা | সেখানে ফিদেল বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন " মুজিব, সম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি অনুসরণের জন্য বুকে, পিঠে বুলেট বরাদ্দ হয়ে গেল | তাই সাবধানে থাকবেন " | ঐ সময়কালে আলেন্দে ও বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতির সাদৃশ্যতার কারণে উভয়ই তাঁদের সাক্ষাৎ আশা করেছিলেন | ঠিক ঐ সময়ে পিনচটের উস্কানিতে চিলিতে ডানপন্থীদের বিশৃঙ্খলা চলছিল | নিজের দেশকে এই দুরবস্থায় রেখে তিনি সন্মেলনে যোগ দিতে পারেননি | আর তাই তাঁদের মধ্যে কুশল বিনিময়ও অসমাপ্ত রয়ে গেল | তবে তিনি বঙ্গবন্ধুকে চিঠি মারফত জানিয়ে ছিলেন " পরবর্তীতে কোন এক সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসবেন " | কিন্তু না, তা আর হয়নি | তাঁদের উভয়ই কেউই আজ বেচে নেই |

এর প্রায় দুই বছর পরই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটানো হয় আরও রক্তাক্ত ও ভয়াবহ সামরিক অভ্যুত্থান | এ দেশের সেনাজান্তার ঘাতকরা শুধু দেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার স্ত্রী, পুত্র, নববিবাহিত পুত্রবধূদের ও পরিবারের অন্য সদস্যসহ দশ বছরের এবং ছয় বছরের দুই ছেলে ও মেয়েকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি | চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর নায়ক ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান পিনোচেট | আলেন্দেকে হত্যার পরপরই তিনি ক্ষমতা দখল করেন | অন্যদিকে বাংলাদেশে আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম নেপথ্য নায়ক ছিলেন তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান | তিনি কিছুকাল খুনি মোশতাক, সায়েম প্রমুখ শিখণ্ডীদের রাষ্ট্রপতি পদে থাকার সুযোগ দিয়ে পরে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন |

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জেনারেল জিয়া যে জড়িত ছিলেন এই অভিযোগও এখন সরব হচ্ছে এবং তার আমলে কর্নেল তাহেরকে হত্যা যে অবৈধ হত্যাকাণ্ড, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সে রায়ও দিয়েছেন | বাংলাদেশে এখন অনেকেরই দাবি, কর্নেল তাহেরের মতো জেনারেল খালেদ মোশাররফসহ আরও অনেকের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ এবং তার প্রকৃত হোতা অথবা হোতাদের সম্পর্কেও তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত | চিলিতে আলেন্দে, নেরুদার মৃত্যুর ৩৮ বছর পর যদি সে সম্পর্কে তদন্ত হতে পারে এবং প্রয়াত জেনারেলের মরণোত্তর বিচার ও শাস্তির দাবি উঠতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে একটি নয়, অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের হোতা বলে অভিযুক্ত প্রয়াত জেনারেলের অপরাধ সম্পর্কে তদন্ত ও মরণোত্তর বিচার হতে পারবে না কেন ? বরং জাতীয় ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্যই আমাদের উচিত চিলির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা |