শত কোটি স্যালুট তোমায় হে বীর-শহীদ-বীরশ্রেষ্ঠ

Published : 29 Oct 2011, 09:12 PM
Updated : 29 Oct 2011, 09:12 PM

মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমান ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। সিপাহী হামিদুর রহমান নিজের সততা এবং একান্ত কর্তব্যনিষ্ঠা থেকেই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে৷ তিনি তখন সেনাবাহিনীর সিপাহী এবং মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টরের একজন যোদ্ধা ছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭০ সাল৷ দেশ তখন স্বাধিকারের আন্দোলনে মুখরিত৷ ঠিক সেই সময় হামিদুর যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে৷ তিনি নিজেও কি তখন জানতেন, এক মাহেন্দ্রলগ্ন তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করে বসে আছে? তাঁর প্রথম ও শেষ ইউনিট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট৷ সেনাবাহিনীতে ভর্তির পরই প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে পাঠানো হলো চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে৷ ২৫ মার্চের রাতে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ওখানকার আরও কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়৷

১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর ইউনিয়নের ধলই সীমান্ত এলাকা। শ্রীমঙ্গল হতে দশ মাইল দক্ষিণে ধলই সীমান্ত ঘাঁটি৷ এরই মধ্যে চা বাগানের মাঝে আস্তানা গেড়েছে পাকহানাদার বাহিনী৷ মাত্র চারশো গজ দূরে ভারতীয় সীমান্ত৷ চা বাগানেই বাঙ্কার করে এক শক্ত অবস্থান নিয়ে বসে আছে পাকিস্তানি হানাদাররা৷

২৮ অক্টোবরের ভোররাত৷ চারদিকে সুনসান নীরবতা৷ সারা রাত চলেছে আক্রমণের প্রস্তুতি৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোর রাতেই আক্রমণ করা হবে ঘাঁটিটি৷ রাতভর পথ চলে ভোর ৪টার দিকে মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌছে অবস্থান নেয়। এই দলেরই তরুণ যোদ্ধা হামিদুর রহমান৷ সামনে দুই প্লাটুন সৈন্য এবং এক প্লাটুন সৈন্য পেছনে৷ প্রথম দুই প্লাটুন ডান ও বাঁদিক থেকে ঘাঁটি আক্রমণ করবে৷ আর পেছনের প্লাটুনটি পেছন থেকে ঘাঁটিটি আক্রমণ করবে৷ শত্রু অবস্থানের খুব কাছাকাছি চলে এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। হানাদার বাহিনী আগেই মাইন পেতে রেখেছিল৷ মাইন ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার দেহ৷ আহত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লাগলেন৷ রক্তে রক্তে লাল হয়ে গেল মাটি৷ কিন্তু এত মৃত্যুর পরও পেছনে হটার কোনো সুযোগ নেই৷ ঘাঁটি দখল করতেই হবে৷ মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিন-পশ্চিম প্রান্ত হতে হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের জন্য আর অগ্রসর হতে পারছিল না। মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে।

সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে গেলেন সিপাহী হামিদুর রহমান৷ টগবগ করে উঠল শরীরের রক্ত৷ আদেশ পালনের জন্য তিনি মরিয়া হয়ে ওঠলেন৷ এখন তাঁর একটাই লক্ষ্য, ওই এলএমজিটা থামাতেই হবে৷ আঠারো বছরের এক উদ্দীপ্ত তরুণ শপথ করলেন জীবনবাজি রেখে৷ তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমন শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই জন পাক সেনার সাথে হাতহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে আক্রমনের মাধ্যমে তিনি একসময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান এবং ঝড়ের গতিতে ঢুকে গেলেন ধলই সীমান্ত ঘাঁটিতে এবং শত্রু বাহিনীকে পরাস্ত করে সীমান্ত ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন নি। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি পোস্টের কাছে দৌড়ে এসে পেলেন শহীদ হামিদুর রহমানের মৃতদেহ৷ ধলাই বর্ডার আউটপোস্ট দখল হলো কেবল সিপাহী হামিদুর রহমানের মহান আত্মত্যাগের কারণেই৷ সহযোদ্ধারা এই শহীদের শবদেহ বয়ে নিয়ে সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের নামে মৌলভীবাজারের ধলই ফাঁড়িতে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে৷ এক নিভৃত অঞ্চলে অবস্থিত বলে স্মৃতিসৌধটি পড়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। অবশেষে স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর ১০ ডিসেম্বর ২০০৭ ভারত থেকে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেহাবশেষ দেশে নিয়ে আসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ টিম৷ তাঁরা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেহাবশেষ দেশে এনে তা মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করেন৷ স্বাধীন দেশের এক স্থপতিকে স্বাধীন মাটিতে দাফন করে বাংলাদেশের মাটি হয়েছে ধন্য৷ বাঙালির হৃদয়ে তিনি অমর, অক্ষয় ও জাগ্রত৷ তিনি আমাদের পতাকা ও মানচিত্রের ঐশ্বর্য৷