স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ

কামরুল আহসান খান
Published : 31 August 2011, 03:59 PM
Updated : 27 March 2016, 02:07 AM

একাত্তর! মুক্তিযুদ্ধ! স্মৃতিতে চিরউজ্জ্বল। স্মৃতির মণিকোঠায় যে অনির্বাণ শিখা সব সময় নিজেকে আলো দেখায় তার নাম একাত্তর। আলোর মিছিলের যাত্রাশেষে যে অকৃত্রিম উত্তাপে নিজেকে বারবার শুদ্ধ করে তুলি তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। সে চিরনবীন। সতত দৃশ্যমান। তবে হয়তো সময়, স্থান, ব্যক্তি এসব খুঁটিনাটি এত আর মনে নেই আজকাল।

পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কথা। আমি তখন সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। স্কুল থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। একাত্তর সালে আমি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সে সঙ্গে বেশ কয়েকজন বন্ধুসহ সত্যেনদার (সাহিত্যিক সত্যেন সেন) সঙ্গে উদীচীর কাজ করছি। আমি ছিলাম উদীচীর প্রথম আহ্বায়ক।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের কিছু কথা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকাতে হয়। অনেকটা ঠিক সেই রকম, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই আমরা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী, কী হতে পারে, আমাদের কর্তব্য কী ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে অবগত করতাম এবং তাদেরকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করতাম। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তখন ছাত্র ইউনিয়ন খুব ভালোভাবেই করছিল।

একাত্তরের শুরু থেকে এই কাজ আরও বেগবান হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমরা মানুষকে সরাসরি যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করতে শুরু করি। আমাদের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে যুদ্ধের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকি।

সত্তরের নির্বাচনের পর রাজপথের প্রবল আন্দোলন আরও বেগবান হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। এরই মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ট্রেনিং দেওয়া শুরু করে। শত শত ছেলেমেয়ে এতে অংশ নেয়। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ আমাদের নিয়মিত কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করত। এই ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করতেন ডা. আবুল কাসেমসহ আরও কজন। আমি নিজে যেহেতু আগে স্কাউটিং করতাম সেহেতু আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের লেফট-রাইট ও মার্চপাস্ট করানোর।

সে সময় ছাত্র ইউনিয়নের এই ট্রেনিং ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এক পর্যায়ে ডামি রাইফেল নিয়ে বিশাল একটি র্র‌্যালি বের হয় ঢাকা শহরে। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বুঝানো যে, আমাদের সামনে একটি বড় যুদ্ধ অপেক্ষা করছে। আমরা সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এখনও ছাত্র ইউনিয়নের সেই দুর্লভ প্রশিক্ষণের ঐতিহাসিক ছবিটি বিভিন্ন জায়গায় দেখি আর উদ্বেলিত, গৌরবান্বিত হই। বিশেষ করে ছাত্রীদের কাঁধে ডামি রাইফেলসহ মার্চপাস্টের ছবিটি দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই ছবিটির প্রথম কাতারে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী রোকেয়া কবীর, তাজিম সুলতানা, ডা. নেলি, কামরুন নাহার হেলেন, কাজী রোকেয়া, নাজনীন সুলতানা নিনা প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে যারা ট্রেনিং নিয়েছিল তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত চৌকষ কয়েকজনকে লাইভ শুটিং শেখানোর জন্য ডেমরায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গুলি ছোড়াসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যদি পাকিস্তানিরা আক্রমণ করে সে জন্য প্রাথমিক প্রতিরোধের প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হবে তারই অংশ ছিল এরূপ প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। ২৫ মার্চের রাতের আগেই হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে ব্যারিকেড তৈরি করে। যেন সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি আর্মি শহরে ঢুকতে না পারে। ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা সেখানে জনগণের সাথে থেকে প্রতিরোধে অবদান রাখে।

এই অবস্থার মধ্যেই ২৫ মার্চের কালরাত্রি আসে। শুরু হয় ব্যাপক গণহত্যা। এসময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ছিলাম। আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ আক্রমণ প্রথমভাগেই ভেঙে পড়ে। আমি তারপর আমাদের শান্তিনগরের বাসায় চলে আসি। আমাদের বাসার পাশেই ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। পুলিশ লাইনে আক্রমণ শুরু হলে শত শত পুলিশ তাদের অস্ত্র নিয়ে আশেপাশের পাড়া-মহল্লায় এসে আশ্রয় নেয়। আমাদের বাসায়ও প্রায় বেশ কিছু পুলিশ এসে আশ্রয় নেয় এবং তারা ঐ রাতে আত্মগোপন করে থাকে। যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাও যে সে রাতে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল তা তাদের হাতের অস্ত্র দেখেই বুঝা যায়। সেই অস্ত্র তারা আমাদের বাসার বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখে। তাদের কাছ থেকেই পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগে যে নারকীয় হত্যা চালিয়েছে তার বিস্তারিত খবর পাই।

সাতাশ তারিখ সকালে কিছু সময়ের জন্য কারফিউ ওঠার পর পরই ঢাকা শহরে লোকজন বেরুতে শুরু করে। এবং প্রাণভয়ে ঢাকা ছাড়তে শুরু করে। আমাদের বাসা থেকে পুলিশরা চলে যায়। তবে অস্ত্রগুলো রেখে যায়। আমরা সেই অস্ত্রগুলো কাপড়-চোপড় দিয়ে পেঁচিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। আশ্চর‌্যরে বিষয় হচ্ছে, যে পুলিশ লাইনে আগের রাত্রে বিরাট ধ্বংসলীলা হয়ে গেছে তার কোয়ার্টারের পাশ দিয়েই অস্ত্র নিয়ে অতিক্রম করি। যাওয়ার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে মৃত্যু উপত্যকা মনে হল। এদিক-সেদিক লাশ পড়ে আছে।

প্রথমে গেলাম শহীদবাগে। সেখান থেকে চলে গেলাম ত্রিমোহনী। এই ত্রিমোহনী ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের ঘাঁটি। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ছিল। আমরা ন্যাপের ব্যানারে কাজ করতাম। গিয়ে দেখলাম পার্টির আরও নেতা সেখানে পৌঁছেছেন। সেখান থেকে নরসিংদির রায়পুরায় চলে গেলাম।

তবে ঢাকা শহরের বাসাবোতে সে সময় আমাদের একটি ঘাঁটি ছিল। আমি রায়পুরা থেকে একদিন সেখানে আসি। সেখানে আমার সহপাঠী এক বন্ধু অনুরোধ করল আওয়ামী লীগ নেতা ফকির শাহাবুদ্দিনকে সাথে নিয়ে যেতে। আমি আর ডা. শাহাদাত হোসেন, এডভোকেট ফকির শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে ভারতের পথে রওনা হই। ফকির শাহাবুদ্দিন পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। আমরা গিয়ে পৌঁছি ভারতের বড়দিয়ালী ক্যাম্পের ক্রাফট হোস্টেলে। এটিই তখন পার্টির ক্যাম্প। ক্যাম্পে তখনো ট্রেনিং শুরু হয়নি।

ক্যাম্পে দু'একদিন অবস্থান করার পরই আমাদের আবার ঢাকায় আসার জন্য বলা হল। ঢাকা থেকে লোক নিয়ে যেতে হবে। চিঠিপত্র নিয়ে ঢাকায় গেলাম। পার্টি থেকে বলা হল, উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক সত্যেন সেনকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে হবে। সত্যেনদার সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্যতার কারণে আমাকে এই গুরুদায়িত্ব দেওয়া হল। সত্যেনদা তখন মুন্সিগঞ্জের একটি গ্রামে আত্মগোপন করে আছেন। সেখান থেকে আমি আর ডা. শাহাদাত সত্যেনদাকে নিয়ে আবার ভারতের পথে রওনা হই। সেখানে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নূহ-উল- আলম লেনিন ও গাজী ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা হল।

সত্যেন দা তখন বেশ অসুস্থ। তাকে গাড়িতে তোলা যাবে না। যদি শত্রুপক্ষ ধরে ফেলে। ফলে হাঁটা পথই একমাত্র সম্বল। অনেক কষ্ট করে প্রথমে কুমিল্লায় স্কুলের সহপাঠী এক বন্ধুর বাড়িতে পাঁচ-ছয় দিন অবস্থান করে তারপর আবার ভারতের দিকে রওনা দেই। সত্যেন দার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। এক পর্যায়ে রক্ত আমাশয় হয়ে যায় তাঁর। তবু তিনি অবিচল। হেঁটেই তিনি ভারত যাবেন। এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এবং দেশপ্রেমই তাঁকে মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রাতে ভারতে পার্টির ক্যাম্পে পৌঁছলাম। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন জ্ঞান চক্রবর্তী, মোহাম্মদ ফরহাদসহ আরো অনেকে।

ক্যাম্পে দুএকদিন অবস্থান করার পরই আমাদেরকে ট্রেনিংএর জন্য ডাকা হল। সেখানে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সেলিম ভাই আমাকে বললেন, ''তুমি কি জান, এখানে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং নেবে তাদের কেউ যদি পালিয়ে যায় বা শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে এবং সেটা হবে মৃত্যুদণ্ড?''

এই কথা শুনে প্রথমে আমি একটু ধাক্কা খেলাম এবং চোখে পানি এসে গেল। কারণ, প্রশ্নটি ছিল আমার বিশ্বাস নিয়ে। ফরহাদ ভাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, কামরুল আমাদের অনেক পরীক্ষিত কর্মী। এরপর আমি প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হই এবং ট্রেনিংএ যোগ দিই।

আজকে ভাবতে ভালো লাগে, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসাবেই সেলিম ভাই আমাকে সেদিন এই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছিলেন। আমরা সবাই তখন সত্যি সত্যিই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েই দেশকে স্বাধীন করার পণ করেছিলাম। সেখানে আমাদের বিশ্বাস, দৃঢ়তা এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ঘাটতির সুযোগ ছিল না। আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা ছিল, হয় মৃত্যু নয় স্বাধীনতা।

ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর আমরা ছিলাম প্রথম ব্যাচ। ওসমান গনি ছিলেন আমাদের কমান্ডার, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার। আসামের তেজপুরে আমাদের ট্রেনিং শুরু হল। প্রায় আড়াইশ-তিনশ জন আমরা। ট্রেনিং দিতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। ট্রেনিংয়ে চূড়ান্ত শৃঙ্খলা মেনে চলতে হত। প্রতিদিন ভোরবেলা উঠা, সারাদিনই ট্রেনিং, প্র্যাকটিক্যাল ও থিয়োরিটিক্যাল দুটোই। প্রথম ট্রেনিং ছিল খোলনা ও জোড়না। অর্থাৎ কীভাবে আগ্নেয়াস্ত্র খুলতে হয় এবং কীভাবে জোড়া লাগাতে হয়। রাত্রে ফিরে শুরু হতো গান গাওয়া। গানগুলো দেশপ্রেমমূলক জাগরণের গান। জনপ্রিয় গান গেরিলা, আমরা গেরিলাই গানটি সে সময়ে তৈরি। এভাবেই আমাদের এক মাস ট্রেনিং চলল।

প্রাথমিক ট্রেনিং শেষে অপেক্ষাকৃত চৌকসদের নির্বাচন করা হল উচ্চতর ট্রেনিংএর জন্য। সেখানে আমরা প্রায় ৫০ জন। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ভারত-চীন সীমান্তবর্তী নেফা নামক স্থানে। পাহাড়ি এলাকা। মাচা করে আমাদের থাকতে হয়। সাত দিনের ট্রেনিংয়ে বিশেষ অস্ত্র চালনাসহ আমরা গ্রেনেড ছোঁড়া, অ্যামবুশ করা এ সমস্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হই। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসি ত্রিপুরার বাইখোড়া বেজ ক্যাম্পে। দ্বিতীয় ব্যাচ আসার পরই আমরা অস্ত্র, গোলাবারুদসহ বাংলাদেশের পথে রওনা হই। ক্যাম্পে প্রথম ব্যাচ গান গেয়ে দ্বিতীয় ব্যাচকে বরণ করে। দ্বিতীয় ব্যাচ গান গেয়ে প্রথম ব্যাচকে বিদায় দেয়।

দ্বিতীয় ব্যাচের কমান্ডার ছিলেন আমার অগ্রজ, মনজু ভাই (মনজুরুল আহসান খান)। সহকারী কমান্ডার ছিলেন স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। বিদায় বেলায় মনজু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য খোঁজাখুঁজি করলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। আমার ধারণা, মনজু ভাই ইচ্ছে করেই আমাকে এড়িয়ে গেলেন। যদি আমার মন খারাপ হয়। কিন্তু বিদায় বেলায় ভাইকে কাছে না পেয়েও মন খুব খারাপ হল; চোখের পানি আড়াল করতে পারিনি।

ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত সারাপথ আমরা গান গাইলাম। বিশেষ করে সত্যেন সেনের সেই বিখ্যাত গানগুলি– 'মানুষেরই ভালোবাসি সে কি মোর অপরাধ? মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী, তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব, মানুষেরি দেয়া প্রাণ'/ 'রাইফেল চেপে ধর সৈনিক, শত্রুর সঙ্গিন তীক্ষ্ণ, তবু তাতে ঘটবে না বিঘ্ন'।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধারা প্রথম দিকে যে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল তা ছিল দীর্ঘকালীন যুদ্ধকে মোকাবেলা করার জন্য। কারণ, আমাদের সামনে তখন জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল ভিয়েতনাম। যারা দিনের পর দিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এসে নানা কারণে এই কৌশল পরিবর্তন করা হয় এবং দ্রুততার সঙ্গে গেরিলারা দেশে প্রবেশ করতে থাকে।

আমাদের ২৫ জনের টিম সন্ধ্যার পর পর সীমান্ত অতিক্রম করে। রাতে আমরা একটা গ্রামে এসে আমাদের ঘাঁটি গাড়ি। জনশূন্য গ্রাম। সঙ্গের চিড়া-মুড়ি দিয়েই সবাই রাতের খাবার সারি। এখানেই আমরা অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করি। আমাকে একটি এলএমজি দিয়ে অবজারভেশন পোস্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, অবজারভেশন পোষ্ট ছিল একটি গোয়াল ঘর। সারা রাত জেগে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করি।

পরদিন বেলা একটার দিকে আমরা দেখলাম পাশের নদী দিয়ে বেশ কয়েকটা নৌকা আমাদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা তাদের অনুসরণ করি। আমাদের ধারনা ছিলো পাকিস্তানি আর্মিরা বোধ হয় আমাদের অবস্থান জেনে গিয়েছে, সে কারণেই বোধ হয় আক্রমণ করতে আসছে। আমরা নিজেদের দিক থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। পরে কাছাকাছি আসলে বোঝা গেল, এগুলি সাধারণ বাঙালিদের নৌকা। তারাও ভারতে ট্রেনিং নেয়ার জন্য যাচ্ছে। আশংকা মিলিয়ে গিয়ে আনন্দে মন ভরে উঠল আমাদের।

তখন চারদিকে বন্যা। আমরা সেই স্থান থেকে সরে পড়ি এবং রওনা হই মনোহরদীর পথে। নদীতে নৌকাযোগে যাওয়ার সময় আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে বহনকারী একটা লঞ্চের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। দুএক রাউন্ড গুলি ছোড়া হলো। তারপর আমরা নৌকা থেকে নেমে দ্রুত অন্যত্র সরে যাই অন্য একটি গ্রামে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য। সে এলাকাটি ছিল কৃষকনেতা সামসুল হক ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন এলাকা। সেখানে দেখা হয় শ্রমিক নেতা শহীদুল্লাহ চৌধুরীর সাথে। তিনি সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড হিসাবে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে মনোহরদী চলে আসি।

এখানে থাকা অবস্থাতেই আমরা বেতিয়ারা যুদ্ধের খবর পাই। যেখানে নিজামউদ্দিন আজাদ, সিরাজুম মনির, দুদু মিয়াসহ আমাদের নয়জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল। জোয়ান কৃষক দুদু মিয়া পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তাকে বলল,'বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।' দুদু মিয়া উচ্চস্বরে বলল 'জয় বাংলা'। সাঙ্গে সঙ্গে ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বুক।

বেতিয়ারার আরেক শহীদ, নিজামুদ্দিন আজাদ ছিল আমাদের সময়ের একজন আইকন ছাত্রনেতা। অসাধারণ স্লোগান দিত আজাদ। স্লোগান দিতে দিতে একদিন ওর মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু হল। চে গুয়েভারার মতো শ্বাসকষ্ট নিয়েও অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে করতে মাতৃভূমির কোলে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন এই মহান মুক্তিযোদ্ধা।

১৬ ডিসেম্বর আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের খবর পাই। তখন আমরা ঢাকার দিকে মুভ করি। ডেমরা ঘাটে এসে আমাদের সাথে গেরিলা বাহিনীর আরেকটি দলের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে মনজু ভাই এবং তার টিমের সদস্যদের সাথেও দেখা হয়। আমাদের দল নিয়ে আমরা শহীদ মিনারে এসে উপস্থিত হই। সেখানে তখন একে একে আমাদের অন্য টিমগুলোও আসতে শুরু করেছে। বিজয়ীর বেশে স্বাধীন দেশে সবার সাথে দেখা হয়।

এর মাঝখানে অনেক দিন আমি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। আমার কোনো খবর পরিবার পায়নি। ফলে বাসায় এক ধরনের উত্তেজনা ও উদ্বেগ ছিল। আমি যখন বাসায় ফিরে গেলাম তখন আব্বা-আম্মা আমার জন্য কাঁদছেন। আমি আসার সাথে সাথেই উনারা আমাকে জড়িয়ে ধরেন।

স্বাধীনতার পর আমরা গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা যথারীতি অস্ত্র সমর্পণ করি। কিন্তু অন্যান্য দলের অনেকেই তা করেনি। ফলে স্বাধীনতার পর পর কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। যা স্বাধীন দেশের ভাবমূর্তি তখন ক্ষুণ্ন করেছিল এবং মানুষকে আশাহত করেছিল।

বাঙালির জন্য, একটি স্বাধীন শোষণমুক্ত দেশের জন্য আমরা সংগ্রাম করেছিলাম। শুধু একটি পতাকা বা একটি রাষ্ট্রের জন্যই আমরা যুদ্ধ করিনি। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষকে সমস্ত শোষণ নির্যাতন-অপমান-অবহেলা থেকে মুক্ত করা। একটি শোষণহীন-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। যার মূলভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের ও ভাষা আন্দোলনের চেতনা। সেই কাঙ্খিত কাজ আমরা এখনো শেষ করতে পারিনি। স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের এদেশকে রাজনৈতিকভাবে বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে এবং তা আজো অব্যাহত আছে। সেই স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকরাই আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব দেখে আমরা ক্ষুব্ধ হই। তাদের বিরুদ্ধে আজ সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় রাজনীতির মধ্যে কুক্ষিগত করে ফেলার চেষ্টাও চলে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলীয় উপাখ্যান নয়, বরং এ ভূখন্ডের মানুষের হাজার বছরের মিলিত সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতে আমরা ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ভূখন্ড পেয়েছি। তাই দলীয় সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নিরূপণ করত হবে।

স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষের অসীম আত্মত্যাগের পরও সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল পায়নি। কিন্তু আমরা তো শুধু একটি ভূখন্ডের জন্যই নয়, বরং আর্থ-সামাজিক মুক্তির জন্যও লড়েছিলাম। সমাজ বদলের রাজনীতির সক্রিয় কর্মী হিসেবে এটা খুব ভালভাবেই জানতাম যে, যুদ্ধ জয়ই শেষ কথা নয়। স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে না পৌঁছালে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যাবে না। আর তাই, ১৯৭২ সাল থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আমরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লাম বয়স্ক শিক্ষা ও গণশিক্ষার কাজে। পাড়ায় পাড়ায় বয়স্ক স্কুল, বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুললাম। যুদ্ধপরিস্থিতির পর চাষাবাদের জন্য কৃষক যাতে বীজের সংকটে না পড়ে তাই সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের মাঠে আমরা বীজতলা তৈরি করলাম। স্যার এ এফ রহমান হলটি করার পেছনে আমরা ছাত্ররাই কায়িক শ্রমের মাধ্যমে যুক্ত ছিলাম।

১৯৭৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আমি ছিলাম ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা সরকারি উদ্যোগের জন্য অপেক্ষা করিনি। ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেসময় সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল।

আমি মনে করি, যে স্বপ্ন নিয়ে একদিন এদেশের মানুষ প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিল, তারা একদিন তাদের সেই শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবেই। যে যুদ্ধ একাত্তর সালে অস্ত্রের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল তা চেতনার জায়গা থেকে আজো অব্যাহত রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রাষ্ট্রের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে অবিরাম। সময়ের সাহসী তরূণদেরকেই সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।