বীথি রহমান: `আবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে’

বীথি রহমান
Published : 12 Sept 2011, 11:18 AM
Updated : 14 June 2022, 10:18 AM


একটি মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায়

সকালে যখন ফ্রিজ থেকে ভাত বের করি
গরম করার সময় থাকে না
পেটে চালান করে অফিসমুখী হই
আর ঘরে পড়ে থাকে গতকালের বাসি রাত
সেই রাতে আমার বিপ্লবী কোনো কবিতা লেখার কথা
তেল, পেয়াজ, নুন, গ্যাসের দাম বেড়েছে বলে
চিৎকার করে ডায়েরি ভরিয়ে ফেলার কথা
পরদিন তা পাঠানোর কথা কোনো জাতীয় দৈনিকে
কিংবা রাতের আঁধারে সাঁটিয়ে দেয়ার কথা রাজপথের দেয়ালে দেয়ালে

গতরাতে সেসব কিছুই হয়নি
অফিসে ফুল স্পিডে এসি ছেড়ে কফিতে চুমুক দিই
আমার কবিতা আর বিপ্লব মাকড়সার জালের মতো মগজে ঝুলতে থাকে

দুপুরে খুব ভাতঘুম পায়
ভরপেট খাবার পর ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে দেখি
বিরোধী দল করার অপরাধে নিরস্ত্র নারীকে
রাস্তায় প্রকাশ্যে পেটাচ্ছে উগ্র দলীয় নেতা
পোশাকের স্বাধীনতা হরনে রেলস্টেশনে ধাওয়া করছে
আরেকদল আপাত-নগ্ন হিংস্র জানোয়ার
আমার হাত নিশপিশ করে
মাথার খুলির ভেতর ধপধপানি বাড়ে
যদিও এশট্রেতে সিগারেট গুঁজে আমি মন দিই কাস্টমার সার্ভিসে
আমার চোখের মনিতে রোদের মতন জ্বলতে থাকে
আহত নারীর মুখ

রাত নামলে অস্থিরতা জ্যামিতিক হারে বাড়ে
যদিও শহরের সবচেয়ে স্থির স্থান পেরিয়ে
আমি ঘরে ফিরি
সেই স্থানে মানুষ আর মানুষ, মানুষের উপরে মানুষ
তবু কোলাহল নেই, ঘরে ফেরার তাড়া নেই
শুধু এককালীন জীবন নিয়ে শুয়ে থাকা
মাঝেমধ্যে মনে হয় আমিও এরকম স্থির হয়ে যাই
চারপাশে এতো ক্ষুধা, এতো অনটন
আমার চোখে গেলাস গেলাস জল জমে
জমে জমে মেঘ হয়
আর আমার গাছ হতে ইচ্ছে করে
এরকম একটি গাছ- যে অনন্তকাল স্থির থাকবে
একটি মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায়….

অপেক্ষা ফেলে আমি ঘরে ফিরি
স্থির বাসিন্দাদের চৌকাঠ পেরিয়ে
ফিরতে ফিরতে বেশি দর দিয়ে চাল-সব্জি কিনি
ক্ষুধা পেটে আমার ঘুম ভালো হয় না

আমি যে অনেকদিন সূর্য দেখি না
রোদের তাপ পাই না, ঘামে ভিজি না
এইসব খবর তারবিহীন তোমার কাছে পৌঁছে যায় নিশ্চয়ই
নিশ্চয়ই শুনতে পাও রোজ রাতে একটা করে বিপ্লবের মৃত্যু হয়
একটা করে কবিতার বিষয়বস্তু কমতে থাকে
আমি কড়কড়া ভাত খাই
আমি এশট্রেতে সিগারেট গুঁজি
আমি কফিতে চুমুক দিই
আর আমার চোখের ভেতর গেলাস গেলাস মেঘ জমে
প্রিয় মাননীয়, আমার এইসব অন্তর্জ্বালা যদি বুঝে থাকো
যদি মেঘের ডাক শুনতে পাও
তবে এ রাষ্ট্রের দায় নিজের হাতে নাও
রাষ্ট্র এখনো পচেনি
স্বপ্নের পদ্মাসেতু আর মেট্রোরেল ঝকমক করছে
শুধু একজন মানবিক নেতার প্রয়োজন
বিরোধী দল করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে
সেই মহাজন কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করবে
তাঁর শব্দের দাপটে দ্রব্যমূল্যের দাম হ্রাস পাবে
ক্ষুধা, দারিদ্রের কোলাহল কমে তাল-পাকা রৌদ্রে বৃষ্টি নামবে
তাঁর শব্দের মুহুর্মুহু আয়োজনে

তুমি আমার কবি হও হে মহামান্য
আমার ঘুমিয়ে পড়া রাত্রিগুলোতে তুমি মহাকবি হয়ে
আমাকে লিখে দাও মানবিকতার মহাকাব্য
একমাত্র কবিতাই পারে সকল সর্বনাশ ঠেকাতে।

আবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে

সংসারে এমন কেউ আছে যে দীর্ঘদিন না ভালোবেসে পারে?
আমি তো দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘকাল না বেসে আছি
প্রেমে না পড়ে আছি
একটা করে দিন যাচ্ছে আর বুকের পালকে জং ধরছে
প্রেমে না পড়লে এরকমই হয়
চোখ কথা বলে না, ঠোঁটে সুঘ্রাণ থাকে না
বুকে শত শত ছত্রাক জমে পলিমাটি ঢাকা পড়ে
হ্যাঁ, একথা আজ জনসম্মুখে বলছি
একরকম মাইকিং করেই বলছি যে, আবার ভীষণ প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে
আবার ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করে
পরস্পরের চোখে ভেসে ভেসে, ঠোঁটে ভেসে ভেসে
ভীষণ রকম তলাতে ইচ্ছে করে অতলান্ত সমুদ্রে

আমাকে কেউ তুলে নেবে লোমকৃষ্ণ বুকে
অসুখী চোখে ভেড়াবে প্রেমের সাম্পান
এরকম লোভাতুর ডাক কেউ দিলে-
ফেরাবো না আর
আর কতো শূন্যতাময় দীঘল রাত্রি কাটাবো?
সংসারে এমন কে আছে যে দীর্ঘদিন না ভালোবেসে পারে!

রূপগঞ্জ, আমার দুঃখ নিরাময় কেন্দ্র

রূপগঞ্জকে ভালোবেসেছি
শহর যখনই গলা চেপে ধরেছে
রূপগঞ্জে হৃদয়ের ভেলা ভাসিয়ে
আকণ্ঠ পান করেছি তার চিরায়ত যৌবন
রূপগঞ্জের বুকে শাপলার ঢেউ খেলে
সবুজের চাদর মোড়ানো তন্বী শরীরে
ছোট ছোট নকশা আঁকা টিনের ঘর
কোথাও কোলাহল নেই, ব্যতিব্যস্ততা নেই
স্থির চিত্রের মতন একইরকম সারল্যে মানুষের হাসি হাসি মুখ
এ ছবির ব্রমাইড হাজার বছরেও জ্বলবে না

দুঃখের উদ্যান ভেঙ্গে তোমার বুকে ঢুকে পড়ি রূপগঞ্জ
একদিন, তোমার বুকেই করবো বেলাশেষের তীর্থযাত্রা
রূপগঞ্জ, তুমি আমার দুঃখ নিরাময় কেন্দ্র।

রাতে এতো অচেনা হলে কেন

সারাদিন কতো কথা বললে-
কী করছি, কী খাচ্ছি, আজ কী পরেছি
কাজের খুব চাপ কিনা
সারাদিন খুব খেয়াল-টেয়াল রাখলে
আর আমি দেখলাম ভালোবাসা, মনে আমার সবুজ ঢেউ উঠলো
ব্যস্ততা যে প্রজাপতির ডানায় উড়তে জানে
আজ প্রথম জানলাম
আজ কাজ করলাম হাওয়ার বেগে, শরীরে ক্লান্তি নেই
মনে ক্লেদ নেই, বুকে একটুও পাথর চাপলো না
অফিসটাকে মনে হল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
উদ্যানের খোলা মাঠে ক্রিকেট খেলছে দুরন্ত বালকেরা
আর আমরা গা বাঁচিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি
আমার হাতে তোমার দেয়া একটি জারবেরা
মাঝেমধ্যে আমাদের হাত পরস্পরের হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে
আমরা তবু কেউ কারো হাত ধরছি না
প্রথম দেখার সংকোচ এখনো কাটিয়ে উঠিনি
সসংকোচে আমরা মন্দিরের পুকুরঘাটে বসলাম
জংলা থেকে অচেনা আরেকটা ফুল তুলে এনে বললে-
এটাও হারাবে না তো?
ততোক্ষণে আমার হাতে জারবেরাটি নেই
হাঁটতে গিয়ে আনমনে খুঁইয়ে ফেলেছি
লজ্জা আর কষ্টে আমার তখন পালাতে ইচ্ছে করছে
ঘাসের ডগার মতোন মিইয়ে রইলাম পদ্ম জলের পাশে
যদিও কাঁধে ছিল তোমার উষ্ণ শ্বাসের স্পর্শ…

ভালোবাসা বড় কাতর করে
সারাদিন এতো যে খোঁজ নিলে
রাতে এমন অচেনা হলে কেন?
দিনের আলোয় আমি বেঁচেই থাকি, রাতের নিবিড় আঁধারে যে আধমরা
এটুকু না জানলে, এই জলজ্যান্ত মানুষটিকে কী করে বাঁচাবে?