গণমাধ্যমে নারী ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 10 Oct 2011, 04:23 PM
Updated : 16 Nov 2016, 03:41 AM

আমরা প্রায়ই বলে থাকি নারী সমাজ পিছিয়ে আছে এবং এ কথা বলে কিছু মানুষ একধরনের দায় এড়াবার পথ খোঁজেন। কিন্তু আমরা কি কখনও তলিয়ে দেখি নারী সমাজ কি পিছিয়ে আছে, নাকি তাদের পেছনে ঠেলে রাখা হচ্ছে? এর জন্য দায়ী কে? পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও সমাজপতিদের চিন্তাচেতনার বন্ধ্যত্ব নয় কি? এই সচেতনতা যত দিন না সবার মনে, বিশেষভাবে নারীদের মধ্যে পুরোপুরি আসছে তত দিন যথার্থ অর্থে নারীর মুক্তি বা স্বাধীনতা আসবে না।

তবে সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পেছনের দিকে তাকালে আমাদের কখনও কখনও হতাশই হতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নারীর অবস্থানে বহু পরিবর্তন এসেছে। নারী এগিয়েছে শিক্ষায়, বহু উচ্চপদে নারী দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখছে তারা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে নারীর বন্দিত্ব ঘুচছে কি? এই উপলব্ধি যত গভীর হবে, ততই তার যথার্থ মুক্তির পথ একটু একটু করে উন্মুক্ত হবে।

কেবল অর্থনৈতিক বা সামাজিক সূচক দিয়ে নারীর বন্দিদশা পরিমাপ করা যাবে না, এ জন্য প্রয়োজন সূচক তৈরিতে নীতি নির্ধারক ও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যৌথ ভূমিকা।

নারীর ক্ষমতাহীনতার দুটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র রয়েছে– একটি পরিবার, অন্যটি সমাজ।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি ইউনিসেফের এক তথ্যানুযায়ী পৃথিবীর যেসব দেশে বাল্য বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য যখন সর্বত্র নন্দিত তখন বাল্য বিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন শুধু নয়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সাফল্যও ম্লান করে দিচ্ছে। আরও একটি খবর জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে চলেছে তা হচ্ছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে বিবাহিত নারীর ৮০ জনই পারিবারিকভাবে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন।

এই নির্যাতন শারীরিক, যৌনভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে করা হয়। এই চিত্র নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নারী উন্নয়নের সব সরকারি ও বেসরকারি কর্মসূচি ব্যর্থ করে দিচ্ছে এবং দেবে। প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারব্যবস্থা নারীবান্ধব না হলে এর প্রতিকার হবে না। নারীর জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দুটি কারণ বড় বাধা হয়ে থাকবে।

কাজেই নারীর ক্ষমতায়নের সংগ্রাম সবসময় দ্বিমাত্রিক। দুটি ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতার লড়াই করতে হয়। কারণ, সংসার ও সমাজ যেমন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনই সমাজের মধ্যে অর্থনীতি ও রাজনীতিও বিচ্ছিন্ন নয়; তাই দুটি ক্ষেত্রেই ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি আলাদা বা বিচ্ছিন্নভাবে সমাধান করা হয় না। কাজেই নারীকে সামগ্রিকভাবে ক্ষমতার জন্য লড়াই করতে হবে এবং সে লড়াই হতে হবে একে অপরের পরিপূরক। এর ফলে নারীর অংশগ্রহণে সমান সুযোগ এবং সমান সক্ষমতা আসবে। আর এর মধ্য দিয়েই দৃঢ় হবে তার সমাজ ও রাজনৈতিক উপলব্ধি, নারী গ্রহণ করতে পারবে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের চ্যালেঞ্জ।

আমরা দেখেছি অস্বীকৃত কর্মক্ষেত্রে কিংবা সামাজিক অঙ্গনে নারী কিভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সমাজে অবদান রেখে সমাজপ্রবাহ গতিশীল করে তুলছে। ছোট একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: ইউনিয়ন পরিষদে নারীর জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত রেখে সরাসরি ভোটে তাদের নির্বাচনের বিধান রাখা হল। সংশয় ছিল অনেকের মনে, এত নারী ইউনিয়ন পর্যায়ে পাওয়া যাবে তো? কিন্তু এই সামান্য সুযোগটুকু গ্রহণ করতে, এই নির্বাচনকে অর্থবহ করে তুলতে তারা যেভাবে এগিয়ে এসেছে তা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।

কিন্তু স্রোতধারার মতো তাদের অগ্রযাত্রা আমরা বিকশিত করার কোনো সুযোগ করে দেইনি। নির্বাচন পরবর্তীকালে দায়িত্ব পালন ও সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের সেভাবে দেওয়া হয়নি। এই বিপুলসংখ্যক নির্বাচিত নারীর মেধা ও শ্রম গ্রাম-সমাজের অগ্রগতিতে তেমন বড় ভূমিকা রাখতে পারছে না। ব্যর্থতার ক্ষোভ তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এক মতামত সভায় এ আক্ষেপের কথা আমি শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সংসদে নারী আসন নিয়েও। ভাবতে হবে এ ক্ষেত্রে 'এফারমেটিভ অ্যাকশন'-এর কথা যাতে এ-সংক্রান্ত নীতি জড়তাবদ্ধ হয়ে না থাকে।

নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আইনে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের যে বিধান সংযোজনের কথা ছিল তা পূরণ হয়নি। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির প্রত্যাশা পূরণের দাবি এখন সব নাগরিকের। দেশে প্রথম নারী স্পিকার হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে মন্ত্রী হিসেবে বেশ কয়েকজন নারীও এসেছেন, কিন্তু কোনো নারী এখনও নির্বাচন কমিশনের সদস্য মনোনীত হননি। যাঁরা মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কতটা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারছেন, তা এখনও প্রশ্ন হয়ে আছে।

বিশ্ব মানচিত্রের দক্ষিণাংশের দেশগুলোয় রাজনীতিতে নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। আমাদের নারী নেতৃত্বের অনেকেরই বাস্তব অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিধি, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা অনেক সীমিত হলেও বাংলাদেশের মতো দেশে নারী-নেতৃত্ব গ্রহণ করার যে মানসিক উদারতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ মানুষের রয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ মানসের এই দিকটি কোনোভাবে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।

এ কথাও সত্য যে, নারী নেতৃত্বে থাকলেই নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সবসময় অগ্রাধিকার পাবে তা ভাবা ঠিক নয়। কারণ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি, প্রথা, সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত থাকলেও বাস্তবে তো রাষ্ট্র 'জেন্ডার নিরপেক্ষ' নয়। দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক বা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে নীতি নির্ধারণ বা প্রচলিত প্রথা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন তাই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারী তার প্রাতহ্যিক জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে অংশীদার হতে যাচ্ছেন। এই ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত এবং নির্বিঘ্ন করার জন্য এই সময়ে প্রয়োজন 'পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫'-এর সংশোধন, প্রয়োজন সর্বজনীন পারিবারিক আইনের প্রর্বতন। এ ব্যাপারে নারী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে।

সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নারীর এগিয়ে আসা একটা বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছি। এর ইতিবাচক ও উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ, দায়িত্বশীল পেশায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পিতৃতন্ত্র এখন স্বীকার করছে মানব সভ্যতার উন্নয়ন দ্রুততর করতে হলে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

নীতিগতভাবে এটি মেনে নিলেও চর্চার বিষয়টি সহজ না হওয়ায় এই পেশায় আসতে নারীকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। এই পেশায় আসা নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, বাইরে কাজের ক্ষেত্রে সচরাচর নারীদের যেসব তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় সাংবাদিকতার পেশায় তা আরও বেশি প্রকট। এ ছাড়া বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি নারী সারা দেশে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও পেশার বৈষম্য, অংশগ্রহণে বাধা, মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা ও অবদমনের মাত্রা আশানুরূপ কমেনি।

যদিও আজকাল অনেক সম্পাদকই স্বীকার করেন, নারীরা পেশার ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান, একাগ্র আর সে কারণেই তারা দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য।

বছর দশেক আগে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ঢাকা শহরে কর্মরত দেড় হাজার সাংবাদিকের মধ্যে মাত্র ৬০ জন ছিল নারী। অর্থাৎ মোট সাংবাদিকের চার শতাংশ। তবে টিভি চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকা বৃদ্ধির কারণে এ সংখ্যা বর্তমানে বেড়েছে।

টেলিভিশন চ্যানেল সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিপোর্টিং এবং বার্তা সম্পাদক হিসেবেও তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এ কারণে মুদ্রণ মাধ্যমের তুলনায় ভিস্যুয়াল মাধ্যমে তাদের বেশি মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোতেও তারা কেউ কেউ নির্বাচিত হয়ে আসছে।

আশার কথা হচ্ছে, তৃণমূলে নারী সাংবাদিকরাও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসছে। নারী, শিশু উন্নয়ন, সুশাসন, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, বাল্য বিয়ে, শিশুশ্রম, শিশু পাচার বিভিন্ন বিষয়ে তারা রিপোর্টিং করছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্ব এবং পত্রিকার সম্পাদনাও করছে। স্থানীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে।

একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়া ইটিভির মাধ্যমে নারী সাংবাদিকরা টিভি রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল এবং সেই সুযোগ তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে বলেই বিভিন্ন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে নারীর উল্লেখযোগ্য হারে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পত্রিকার নারী সাংবাদিকরা তাদের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে এখন রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ অনুসন্ধানী রিপোর্ট পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ পরিচালনা ছাড়াও তারা দৈনিকের শিফট-ইন-চার্জ পদও দক্ষতার সঙ্গে সামলাচ্ছে।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নারী রিপোর্টাররা যে পারদর্শিতা দেখাচ্ছে তা শুধু অভিনন্দন যোগ্যই নয়, অনুসরণযোগ্যও বটে। তাদের রিপোর্টিংয়ের দক্ষতা দেখে অনেক নারীর মধ্যে টিভি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে, হচ্ছে।

সার্বিকভাবে বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ সংবাদমাধ্যমে এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ব্যাপক মাত্রায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে গণমাধ্যমে 'জেন্ডার সংবেদনশীল' পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর কর্মউপযোগী বা নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য নীতি সংস্কারের মাধ্যমে তাদের পত্রিকা পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তাহলে পত্রিকার অভ্যন্তরীন পরিবেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।

তবে একই সঙ্গে নারী সংবাদকর্মীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অটুট রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকতা একটা সৃজনশীল পেশা। কাজেই একজন নারী সংবাদকর্মী যদি নীরব বা সরব অবদমনের শিকার হন, তবে তিনি নিজের অস্তিত্ব বা আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সৃজনশীলতা দেখাতে পারবেন না।

আমরা আশা করছি, সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে নারীর অবস্থান ক্রমান্বয়ে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর, বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হবে। আমরা সেদিনের আশায় আছি, যেদিন অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো জাতীয় দৈনিকগুলোতে সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক হিসেবে নারীরা কাজ করছে নির্বিঘ্নে, সাফল্যের সঙ্গে।

সেদিনই নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সত্যিকারের বিজয় আসবে।