স্বেচ্ছায় কাজ করতে চাই, যুদ্ধ চাই না

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 16 Nov 2011, 06:22 AM
Updated : 4 August 2017, 05:14 AM

ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের বিশাল মিলনায়তন কানায় কানায় ভরা। কথা বলছেন দেশের উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যানরা, কথা শুনছেন নানা পর্যায়ের নারী উন্নয়নকর্মীরা এবং সভায় যোগ দেওয়া ৬২ জন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান। নানা সংকট ও সমস্যার কথা তুলে বক্তব্য রাখেন ২২ জন। বিস্ময়ের সঙ্গে শুনছিলাম তাদের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা। সবার দুঃখ, হতাশা, না-পাওয়া, কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, বৈষম্যের চিত্র প্রায় একই।

পাবনা উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান জলি রহমান বলেন:

"আমরা অসাধ্য সাধন করে নির্বাচিত হয়েছি। আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল আমার নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে, ভালোবাসা ও সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাব। মানুষের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু বাস্তবতা হল আমাদের জনগণের কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে দেওয়া হচ্ছে না। নিজ উদ্যোগে কাজ করতে চাইলে যাতায়াত খরচ অথবা ন্যূনতম যানবাহন দিয়ে সহযোগিতাটুকুও করা হয় না। গভীর রাত্রে বাল্যবিবাহ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কোনোরকম সহযোগিতা করা হয় না।"

তিনি নিজের উপলব্ধি থেকে বলেন: "ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হিসেবে যে নারীরা নির্বাচিত হয়ে আসেন তাদের কমপক্ষে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানা দরকার। অনেকেই সই করতে এমনকি নিজেদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণাও করতে পারেন না। এদের ক্ষমতাবান করতে না পারলে আমাদের ক্ষমতায়ন হবে না। উপজেলায় নেওয়া সরকারি প্রকল্প বা বরাদ্দে আমাদের অংশীদার করা দরকার। আমাদের জায়গায় পৌঁছুতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে নিজের সঙ্গে, পরিবার ও সমাজের সঙ্গে। তবে অপেক্ষায় আছি কর্মপরিবেশবান্ধব আগামী দিনের।"

কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারি উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ফরিদা পারভীন বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন:

"আমি নারী উন্নয়ন ফোরামের জেলা সভাপতি অথচ মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় এবং জেলার পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত সভায় আমাকে ডাকা হয় না। দশটি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের জন্য গাড়ি আছে, কিন্তু সেই গাড়িতে আমাদের জায়গা হয় না। আমি তিনবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হিসেবে যে কাজ করতে পেরেছি ভাইস-চেয়ারম্যান হয়ে তার ন্যূনতম অংশও করতে পারছি না। সভার রেজুলেশনগুলো আমাদের দেখানো বা সই করানোর প্রয়োজন মনে করেন না। আমি প্রতিজ্ঞা নিয়েছি এরপর চেয়ারম্যান এবং পরে এমপি হয়ে আমার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করব।"

রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান শাহেদা আফরোজ আক্ষেপ করে বলেন:

"কাজের ক্ষেত্রের নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বারবার মঞ্চে বলেছি, কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। সব কাজের সিদ্ধান্ত নেন ইউএনও, চেয়ারম্যান সাহেবরা। উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ২৫% থেকে আমাদের সামান্য অংশও কাজ করার জন্য দেওয়া হয় না। অথচ ৫% বরাদ্দ আমায় দেওয়ার কথা।"

বরিশালের ঝালকাঠি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সোনালী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন:

"দু-দুবার নির্বাচিত ভাইস-চেয়ারম্যান আমি, সেই আমাকে দাবায়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। কোথায় কী প্রকল্প নেওয়া হয়, আমরা জানি না। একটু জানার ও বোঝার সুযোগ দিলে দেখাতে পারতাম আমরা কতদূর যেতে পারি। নারীরা দুর্নীতি করে না বলেই সই করার অধিকার তাদের দেওয়া হয় না। এমনকি নির্ধারিত স্থানে বসার জায়গাটুকুও তাদের নেই।"

কিশোরগঞ্জের সেলিনা সারোয়ার সরকারের উপজেলায় নেওয়া ১৭টি অধিদপ্তরের মধ্যে অন্তত একটি, বিশেষ করে মহিলা ও শিশু অধিদপ্তরটি তাদের জন্য নির্দিষ্ট করার দাবি জানান।

খুলনা বটিয়াঘাটার বুলু রায় হতাশার সঙ্গে বলেন:

"আমরা ভালোভাবে কাজ করতে পারব বলেই পুরুষেরা আমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ সব ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম, কিন্তু ইতিহাসে নেই। তিনটি ওয়ার্ড মিলে আমরা নির্বাচন করি, দক্ষতা অর্জন করি, কিন্তু সেই দক্ষতা কাজে লাগাতে পারি না। মেয়েদের জন্য অন্তত দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।"

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের শেফালী হামিদ বলেন:

"শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে সমতার চেয়ারে বসতে পারছি না। যদিও কাগজে-কলমে আছি, কাজে নেই। এরপরও উন্নয়ন ও ন্যায়ের কথা বলি তাদের জন্য যারা আমাদের ভোট দিয়েছেন।"

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রওশন আরা মন্তব্য করেন: দুর্গম এলাকায় কাজ করার জন্য পুলিশ প্রশাসন যাতে সহযোগিতা করে সে রকম একটি লিখিত নির্দেশনা ওপর থেকে থাকা জরুরি।

সুনামগঞ্জের নিগার সুলতানার বক্তব্য: "আমি যখন নিজ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করি তখন আমাকে পছন্দ করে না বলে সেই কাজের সঙ্গে আমার চেয়ারম্যান সাহেব সম্পৃক্ত হন না।"

বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলার নির্বাচিত নারী ভাইস চেয়ারম্যানরা তাদের এই আক্ষেপ ও ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন মহিলা পরিষদ আয়োজিত নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ বিষয়ে গত ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায়।

এই সভায় সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির চিত্র প্রকটভাবে উঠে আসে। বাজেট ও বরাদ্দ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নারী জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করার প্রয়োজন মনে করে না নারী নেতৃত্ববিমুখ এই সমাজ।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে নারী জনপ্রতিনিধিদের বাজেট বরাদ্দ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। অসম বণ্টনের কারণে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তারা পালন করতে পারেছেন না। সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীর প্রতি নেতিবাচক চিন্তাচেতনার পরিবর্তন একান্ত প্রয়োজন।

কারণ, আমরা জানি, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও সংহত করে। কিন্তু আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী আসনে বিপুলসংখ্যক তৃণমূলের নারী সরাসরি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, অথচ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁরা নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কাজের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা তাদের হতাশ করছে, কিন্তু মনোবল ভেঙে যায়নি।

তাঁরা প্রত্যেকে বলেছেন, আগামীর চেয়ারম্যান এমনকি এমপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাঁরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন। প্রবল বিশ্বাস নিয়ে তাঁরা বলেছেন, অধিকার ও কাজের সুযোগ তেমন পাইনি, কিন্তু জনগণের কাছ থেকে ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি; সেই গ্রহণযোগ্যতা তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও নির্দেশনা দেবে।

আমরা জানি, ১৯৯৭ সালে বর্তমান সরকারের সময়েই ইউনিয়ন পরিষদ এবং পরবর্তীতে ২০০৮ সাল থেকে উপজেলা পরিষদে একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালে ৩৪টি পৌরসভায় পৌর মেয়র হিসেবে ১৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চারজন নারী মেয়র পদে জয়লাভ করেন (নাটোর, তারাবো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বেলকুচি)।

বর্তমানে ৪৮৭ জন উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী এই সভায় জানান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নিতে পারেন না। প্রবল আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে গেলেও বাধা প্রদান করা হয়।

এই সভায় জনপ্রতিনিধিদের তুলে ধরা সমস্যার আলোকে এই সত্যই প্রতীয়মান হয়, নেতৃত্ব ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দরকার। প্রশাসনিক কাঠামোর সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য সরকারের বিধান অনুয়ায়ী কোটা নির্ধারণ করা দরকার। সেইসঙ্গে প্রশাসনিক কাঠামোকে করা দরকার শক্তিশালী, জেন্ডার সংবেদনশীল, কার্যকর, সহায়ক ও জবাবদিহিতামূলক।

সম্পদের যথাযথা বরাদ্দসহ তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ একান্ত জরুরি। তাঁরা মনে করেন, এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন দরকার। দরকার গোটা সংস্কৃতির পরিবর্তন।

সভার পুরো কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে আমাদের একটি চরম সত্য উপলব্ধিতে ও বিবেচনায় আনতে হবে। আর তা হচ্ছে: ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-চেতনাগতভাবে বৈষম্যপূর্ণ সমাজের তৃণমূলের নারীদের বড় একটি অংশ আজ নির্বাচন প্রক্রিয়া, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সহযোগিতা করতে হবে, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ দিয়ে অধিকতর যোগ্য, প্রশিক্ষিত করে অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালনের সহায়ক করতে হবে।