বিটি বেগুনে পোকা: জৈব উপনিবেশের পরাজয়

নাহুয়াল মিথ
Published : 17 April 2014, 01:02 PM
Updated : 17 April 2014, 01:02 PM

জয় বাংলার পোকার জয়। পোকা প্রতিরোধী বিটি বেগুন আক্রমণ করে জিএম GM (genetically modified) প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো বাংলার পোকা। পৌরানিক বেহুলা-লক্ষীন্দরের বাসর ঘর সাপ অপ্রেবশ্য করে তৈরি করা হয়েছিলো। কিন্তু সর্পদেবী মনসার কবল থেকে পুত্রকে রক্ষা করতে পারেনি চাদ সওদাগর। তেমনি বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের ৯ জাতের বেগুনকে জিম্মিকরণের ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে ফেলছে বাংলার পোকাকূল।

বাংলাদেশের প্রথম genetically modified ফসল হিসাবে বিটি বেগুনের ৪টি জাতের বীজ এবছরের ২২ জানুয়ারি বার্ক মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বংপুর, পাবনা, গাজীপুর ও জামালপুরের ২০ জন কৃষকের হাতে তুলে দেন বর্তমান কৃষিমন্ত্রী।

গত ৭ এপ্রিল Financial Express বিটি বেগুনের কৃষক পর্যায়ে প্রথম পরীক্ষামূলক আবাদের উপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বিটি বেগুনের চারা কয়েক প্রজাতির পোকামাকড়ের আক্রমণে নুয়ে পড়েছে। বিটি বেগুন আবাদ করতে গিয়ে কৃষক অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় অধিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ জিন পরিবর্তিত বিটি বেগুন ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী হলেও অন্যান্য পোকার আক্রমণে মারা যাচ্ছে ও রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষকরা বিটি বেগুনের আবাদ করে বিপদে পড়েছে।

বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ৫৭,৭৪৫ হেক্টর জমিতে ৩,৩৯,৭৯৫ মেট্রিক টন বেগুন উৎপন্ন হয় যা দেশের মোট সবজি-আবাদী এলাকার ২৫.৪% ভাগ। ডগা ও ফল-ছিদ্রকারী পোকা বেগুনের আবাদের উপর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এই সমস্যা সমাধানে USAIDএর অর্থায়নে Cornell Universityএর সহযোগিতায় বহুজাতিক কোম্পানি Monsanto ও এর ভারতীয় সহযোগী Mahyco বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI)এর সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯টি জাতের জিন পরিবর্তন করার বিটি বেগুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার চারটি জাত ইতিমেধ্য কৃষকের হাতে তুলে দেয় হয়েছে।

ভারত ও ফিলিপাইনে নিষিদ্ধ হলেও দেশের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারির বদৌলতে একমাত্র বাংলাদেশেই বিটি বেগুন প্রকল্প 'সাফল্যের মুখ' দেখেছে। 'সত্গুরু চুক্তি'র মাধ্যমে বারি দেশের নয়টি বেগুন জাতের জিনসম্পদ মালিকানা মাহিকো-মনস্যান্টো কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

চুক্তির ১.১৯ নং শর্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিটি বেগুন প্রকল্পে ব্যবহূত বিটি জিন, বিটি প্রযুক্তি এবং এই প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবিত বা বিক্রয়যোগ্য সব বিটি বেগুনের মেধাস্বত্ব ও নিয়ন্ত্রণ মনস্যান্টো কোম্পানির। মনস্যান্টোর প্যাটেন্টকৃত বিটি জিন বাংলাদেশি বেগুনে ঢোকানোর ভেতর দিয়ে উল্লিখিত চুক্তি মোতাবেক এখন মনস্যান্টো বাংলাদেশের নয়টি বেগুনের ওপর তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের বৈধতা পেয়েছে।

সংবিধান মতে, দেশের সব প্রাণসম্পদের মালিক রাষ্ট্র ও জনগণ। সংবিধানের ১৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উত্পাদন এবং বণ্টনের মালিক ও নিয়ন্ত্রক দেশের জনগণ।

স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র দেশের সম্পদ কোনো করপোরেট জিম্মায় তুলে দিতে পারে না। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসাবে পরিচিত কৃষিমন্ত্রী কিভাবে জৈব উপনিবেশের অনুগত হলেন তা বোধগম্য নয়।

বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলের 'সত্গুরু চুক্তি'কে মহাজোট সরকার সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করলো। জৈব উপনিবেশের কাছে মাথা নত করেছে দেশের প্রধান দুইটি দল। বড় দুই রাজনৈতিক দল মাথা নত করলেও মাথা নত করেনি বাংলার পোকামাকড়। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বিটি বেগুনের আবাদের বিরুদ্ধে।

বিটি বেগুন হল জিনগতভাবে পরিবর্তীত বেগুনের একটি জাত। মাটিতে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া ব্যাসিলিকাস থুরিংজিনিসিসের ক্রিস্টাল প্রোটিন জিন বেগুনের বিভিন্ন জাতের জিনের সাথে মিশিয়ে বিটি বেগুনের জাত উৎভাবন করা হয়েছে। Bacillus thuringiensis প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার নামের আদ্যক্ষর নিয়ে BT/ বিটি শব্দটি এসেছে। এ প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া Bio-Pesticide বা জৈব কীটনাশক হিসেবে কার্যকর।

২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশের পক্ষে 'বারি', মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি লিমিটেড (মাহিকো) এবং কৃষি প্রাণপ্রযুক্তি সহায়তা প্রকল্প-২-এর পক্ষে শতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্টস প্রাইভেট লিমিটেড 'সত্গুরু চুক্তি' স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের উত্তরা (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪০৯), কাজলা (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১০), নয়নতারা (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১১), শিংনাথ (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১২), দোহাজারী (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১৩), চ্যাগা (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১৪), খটখটিয়া (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১৫), ইসলামপুরী (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১৬) এবং ঈশ্বরদী লোকাল (একসেশন নং-ইসি ৫৪৯৪১৭)-এই নয়টি বেগুন জাতকে বিটি বেগুন গবেষণা প্রকল্পে অনুমোদন দেয় বারি।

বিটি বেগুন প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে ২০০৫ সালে একটি বায়োসেফটি গাইড লাইন তৈরি করে, ২০০৬ সালে জাতীয় খাদ্যনীতিতে জিএম খাদ্যকে বৈধতা দেয়, ২০১০ সালে জৈব নিরাপত্তা আইনের খসড়া করে। জাতীয় বীজ বোর্ড ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা ও বারি বেগুন-৬-কে পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্র অনুমোদিত বিটি বেগুন হিসেবে ছাড় দেয়।

সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত্ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিরাপত্তা বিধান করবে। দেশের বেগুন জাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বিটি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের ক্রিস্টাল প্রোটিন প্রস্তুত করে যা বিশেষ কিছু পোকামাকড়ের জন্য বিষাক্ত। পোকার জন্য প্রাণঘাতী এই বিষ মানুষের জন্যও বিষাক্ত কী না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ জিএম শস্যগুলো যদিও জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন করা হয় কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর শুরু হয়। কিন্তু কখন হবে অথবা কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না -এমন কোনো নিশ্চয়তা কেউ কখনো দিতে পারবে না।

সাধারণ বেগুনের জিনোমে যে সিকুয়েন্স থাকে তার মধ্যে Bacillus thuringiensis এর একটি নির্দিষ্ট জিন প্রবেশ করানো হয়। এটি সাধারণত পোকা-মাকড়ের মিটগাট বা পাকস্থলির ভেতরের রিসেপ্টরের থেকে ভিন্ন হয়। যেহেতু পোকার রিসেপ্টরের ভেতরটা ক্ষারীয় প্রকৃতির তাই পোকার পাকস্থলি ফুলে গিয়ে ধীরে ধীরে মারা যায়।

মানুষের পাকস্থলির ভেতরটা অ্যাসিডিক থাকায় ওই জিনটি মানুষের তেমন কোনো ক্ষতি সাধন করে না বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু জিন যেহেতু অ্যামাইনো এসিড বা প্রোটিন জাতীয়, তাই যেকোনো সময় এর সিকুয়েন্স পরিবর্তিত হতে পারে। এতে বিটি জিনের ওই সিকুয়েন্সটি পরিবর্তন কিংবা পোকা অথবা মানুষের পাকস্থলির প্রোটিনের জিন সিকুয়েন্সের পরিবর্তন হতে পারে। ওই (বিটি জিনের) প্রোটিনের সঙ্গে মানুষের পাকস্থলি অথবা শরীরের অন্যান্য রিসেপ্টর প্রোটিনের সঙ্গে যদি মিলে যায় সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড বা ট্রান্সজেনিক শস্যগুলো সরাসরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার না করাই উত্তম। Solanacae পরিবারের অন্যান্য ফসলের সঙ্গে ক্রস পরাগায়ন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। এতে ওই সব ফসরের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে।

আরো ভযংকর বিষয় হলো যদি জিন সিকুয়েন্স পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিকর পোকা ওই বিষের বিপরীতে প্রতিরোধী (resistant) হয়ে যায়, তাহলে ওই বিটি বেগুনের জিন আর কাজ করবে না। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মহামারী আকারে ফসলের ক্ষতিসাধন করবে। এ ক্ষতি থেকে বাঁচতে উন্নতমানের ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

ভারতে ২০০৯ সালে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য এই জাতকে ছাড়পত্র দেওয়ার পর থেকেই কৃষক, সমাজকর্মী ও বিভিন্ন স্তরের মনুষ্যের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে এবং বহুল আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্কের পর ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই জাতের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন গ্রিনপিসের মতে, বিটি বেগুনের মধ্যে একটি বহিরাগত ব্যাকটেরিয়ার জিনের প্রবেশ ঘটানো হয় এবং এই ব্যকটেরিয়া গাছটিকেই কীড়া থেকে মুক্ত রাখার জন্য বিষাক্ত করে দেয়। তাছাড়া জিএম-সবজিতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধক মার্কার থাকে। মানুষ এই সবজি খেলে তার শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে কাজ করবে না।