৩ জুলাই ঢাকায় আধাবেলা হরতাল

নাহুয়াল মিথ
Published : 18 June 2011, 05:16 AM
Updated : 18 June 2011, 05:16 AM

আগামী ৩ জুলাই ঢাকায় অর্ধদিবস হরতালের ডাক দিয়েছে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটি। গত ১৭ জুন রাতে কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, '৩ জুলাই ঢাকায় হরতাল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির বিরোধিতা করে এই হরতাল ডেকেছি আমরা।'

কমিটির ঢাকা মহানগরের সমন্বয়ক খান আসাদুজ্জামান জানান, ৩ জুলাই ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হবে। একই দিন সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলবে।

***
সাপ্তাহিক একতার সংবাদে প্রকাশ

রপ্তানিমুখী মডেল উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির আওতায় গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রেখে সমুদ্র বক্ষের ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য মার্কিন কোম্পানি কনকো-ফিলিপস এর সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার। গত ১৬ জুন রাজধানীর পেট্রো-সেন্টারে উভয় পক্ষের মধ্যে এই চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এ সময় বাংলাদেশ সরকার, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং কনকো-ফিলিপস এর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মডেল পিএসসি-২০০৮ প্রণয়ন করে। ওই মডেলের আলোকে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০০৮ সালে বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কনকো-ফিলিপসকে নির্বাচিত করা হয়।

গত ২৩ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কনকো-ফিলিপস এর সঙ্গে পিএসসি চুক্তি অনুমোদন করে। এরপর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৬ জুন কনকো-ফিলিপসের সঙ্গে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি করবে সরকার।

শুরু থেকেই গ্যাস রপ্তানির বিধান বহাল রেখে এই রপ্তানিমুখী মডেল পিএসসি চুক্তির বিরোধীতা করে আসছে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। গত ১৪ জুন এই চুক্তির প্রতিবাদে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে। এ সময় মিছিল নিয়ে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে বেশ কয়েক জন আহত হয়।

সমাবেশে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মোহাম্মদ বলেন, সরকার ও তার আমলারা একের পর পর দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড চালিয়ে জাতীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশীয় কোম্পানিকে 'টাকা নেই' এই অজুহাত তুলে বরাদ্দ দেননা। ফলে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা ভালো রেকর্ড থাকা সত্বেও দিন দিন লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক রক্তক্ষরণ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং অর্থনৈতিক বোঝার মধ্যেও ৮০ ভাগ রপ্তানিমুখী চুক্তির মাধ্যমে কনোকো-ফিলিপস-এর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে সমুদ্রের গ্যাস ব্লক। বলা হচ্ছে, পুঁজির অভাব। কত বিনিয়োগ করবে তারা? পাঁচ বছরে ১১০ মিলিয়ন ডলার বা ৭৭০ কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় তুচ্ছ। এক বছরে এমপি-আমলাদের জন্য সরকারি গাড়ি কেনার বাজেটই এর চাইতে বেশি। অথচ খোড়া যুক্তি দিয়ে সমুদ্রের সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে এই মার্কিনী কোম্পানির হাতে। শতকরা ৮০ ভাগের মালিকানা তাদের, এই গ্যাস তারা এলএনজির মাধ্যমে রফতানি করতে পারবে– এই অধিকারও চুক্তিতে দেয়া আছে। আর এসবই সম্ভব করে তুলেছে দেশের সরকার ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে জাকিয়ে বসা এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ। তাদের কাছে দেশের স্বার্থের চাইতে বিদেশী কোম্পানির স্বার্থ অনেক বেশি। এরাই আমাদের জন্য গুপ্তঘাতক। এই গুপ্তঘাতকদের প্রতিহত করতে হবে।

আনু মোহাম্মদ বলেন, এই কোম্পানির আছে বহু দুর্ঘটনার রেকর্ড। সম্ভবত সে কারণেই দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কনোকো-ফিলিপসের সাথে চুক্তিতে যতটা সম্ভব অস্বচ্ছ করা হয়েছে। চুক্তিতে দুর্ঘটনার দায় থেকে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

আনু মুহাম্মদ ১৯৯৭ সালে মাগুরছড়া গ্যাসেক্ষেত্রে বিস্ফোরণের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, সে সময় কাজ করছিলো যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি অক্সিডেন্টাল, ২০০৫ সালে টেংরাটিলা বিস্ফোরণের সময় ছিলো কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো। এই দুই দুর্ঘটনায় প্রায় পাঁচশ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট হলেও কোনোরকম ক্ষতিপূরণ দেয়নি তারা।

সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সমুদ্র বক্ষের গ্যাস কনকো-ফিলিপস প্রথমে নাকি দেশের কাছে বিক্রি করবে। যদি দেশ কিনতে না পারে তবে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি কিনবে। তারাও যদি কিনতে না পারে তবে গ্যাস এলএনজি হিসেবে বিদেশে রপ্তানি হবে।

এ প্রসঙ্গে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সমাবেশে বলেন, বলা হচ্ছে, কনকো-ফিলিপস সমুদ্রের মেজারমেন্ট পয়েন্ট পর্যন্ত গ্যাস পৌঁছে দেবে। কিন্তু চুক্তিতে মেজারমেন্ট পয়েন্ট কোথায় হবে এটা সুনির্দিষ্ট করা নাই। পরে দেখা যাবে, মেজারমেন্ট পয়েন্ট সাগরের মাঝখানে। চুক্তিতে ফাঁক থাকলে তা তাদের পক্ষেই যাবে।

তিনি বলেন, তখন আবার সরকার ও আমলারা বলবে নিজেরা পাইপলাইন তৈরি করে ভূখণ্ডের গ্যাস আনার চাইতে বিদেশ থেকে আমদানি করাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে । তখন এই গ্যাস ক্রয় করতে হবে ৫০-১০০ ভাগ বেশি দামে।

সমাবেশ থেকে নেতৃবন্দ অবিলম্বে গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করার আহ্বান জানান। এছাড়া বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার সমতা বিকাশে প্রয়োজনীয় পুঁজি বিনিয়োগ, যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধকরণ ও জনসম্পদের বিকাশ সাধনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং এর জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দের দাবিও তুলেছে এই কমিটি।

১৪ জুন সমাবেশে জাতীয় কমিটি অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন সংগঠন সকাল ১০টা থেকেই মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেসকাবের সামনে জড়ো হতে থাকে। কনকো-ফিলিপস এর সঙ্গে চুক্তির বিরোধীতা করে সমাবেশে নেতা-কর্মীরা মহুর্মহু স্লোগান তুলে। বেলা ১২টার দিকে নেতৃবৃন্দ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের ধস্তাধস্তি হয়। সমাবেশে জাতীয় কমিটিভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জানান, ২০০১ সালে গ্যাস রপ্তানির প্রক্রিয়ায় সায় না দেওয়ার কারণেই তখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। এজন্য তিনি কয়েকটি দেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই আওয়ামী লীগ তখন গ্যাস রপ্তানির বিপক্ষে ছিলো। আজ, দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে রেখেছেন। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন মহাদুর্নীতিবাজ হিসেবে স্বীকৃত তৌফিক-ই-এলাহীকে।

এখন কী সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই গ্যাস রপ্তানির বিধান রেখে কনকো-ফিলিপস এর সঙ্গে গ্যাস উত্তোলনের চুক্তি করছে? নাকি আবার ক্ষমতায় আসতে হলে গ্যাস রপ্তানির প্রক্রিয়ায় সায় দিতে হবে এমন ধারণার কারণেই সরকার গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে? বা সরকার গ্যাস রপ্তানি করবে এমন মুচলেখা দেওয়ার পর বিদেশিরা তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব সরকার বা তার আমলাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সরকারের এই গ্যাস উত্তোলনের প্রক্রিয়াকে দেশের জন্য আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এস নুরুল ইসলাম। রপ্তানিমুখী মডেল উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির আওতায় এ চুক্তি দেশের জন্য আত্মঘাতী। এ চুক্তির কারণে প্রকারান্তরে গ্যাস রপ্তানিরই সুযোগ পাবে কনকো-ফিলিপস।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, এ গ্যাস আমাদের দেওয়া হবে ১৫০ মাইল দূরে সমুদ্রের কূপে। সেখান থেকে উপকূলে গ্যাস পরিবহন করার জন্য বিদেশি কোম্পানির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এম নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জন্য এই গ্যাস পরিবহন আর্থিক ও কারিগরি সামর্থের দিক থেকে অলাভজনক। ফলে তা রপ্তানির সুযোগই করে দেওয়া হবে।

এদিকে সরকার কনকো-ফিলিপস এর সঙ্গে চুক্তি করার পর পরই জাতীয় কমিটির উদ্যোগে প্রেসক্লাব চত্ত্বরে পূর্ব নির্ধারিত কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি পালন করে। এ সময় সেখানে জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অদ্যাপক আনু মেহাম্মদ বলেন, চুক্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অচিরেই হরতাল, অবরোধ, লংমার্চ সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা শুনেছি এই চুক্তির আইনগত দিকগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ও আপত্তি জানিয়েছিলো। কিন্তু তাদের আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি।

সমাবেশ শেষে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এসময় সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হায়দার আকবর খান রনো, সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েত সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির মোশরেফা মিশু প্রমুখ।


***
আসুন এই ব্লগটিতে
১. চুক্তির যৌক্তিতা তুলে ধরি ( পক্ষ / বিপক্ষ )।
২. ঢাকায় ৩ জুলাই আধবেলা হরতাল চর্চা করি ( পক্ষ / বিপক্ষ )।
২. তেল গ্যাস বিষয়ক তথ্য, সংবাদ পরস্পরের সাথে বিনিময় করি (কপি-পেস্ট অনুমোদিত) । অবশ্যই বাংলায় ও তথ্যসূত্র সহ।
৩. কোন প্রকার ব্যক্তিগত আক্রমণ না করি। ব্লগিং পরিবেশ সুস্থ রাখি।

***
ফিচার ছবি: তাহমিনা আফরোজ এর ফেসবুক এ্যালবাম "জাতীয় সম্পদ রক্ষায় জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচী" থেকে সংগৃহিত