তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও আমাদের ভবিষ্যৎ

মিটন কিবরিয়া
Published : 4 June 2011, 04:27 PM
Updated : 4 June 2011, 04:27 PM

বাতিল হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা রহিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ অনুসারী বিজ্ঞজনেরা এটাকে যৌক্তিক বলছেন আর জাতীয়তাবাদীরা করেছেন প্রত্যাখ্যান। যারা রাজনীতি সম্পর্কে তেমন খোজ-খবর রাখেন না তারাও পাচ্ছেন উত্তাপ। একধরনের সহিংস রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। একটি স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে পুরো সমাজে। একপক্ষে সরকার আর অন্যপক্ষে বিরোধীদল।অবিকল ১৯৯৬ সালের মতো। ইস্যুও একই। তখন আওয়ামী লীগ ছিল তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে আর বিএনপি ছিল বিপক্ষে। আজ ১৫ বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। শুধু পক্ষ পরিবর্তন হয়েছে। আসলে পক্ষ পরিবর্তন হয়েছে এটাও ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ যদি আজ কোন কারনে বিরোধী দলে থাকতো আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকতো ঘটনা একই ঘটত। বিএনপি চাইত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে দিতে আর আওয়ামী লীগ রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করতো তত্ত্বাবধায়ক বহাল রাখার জন্য। আমার বাক্তিগত মতামত হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার এই যে সঙ্কট তা আমাদের রাজনৈতিক জীবনের এক অবধারিত পর্যায়। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আপনাকে এই ধরনের সঙ্কট মোকাবেলা করতেই হবে। এবং তা করতে হবে সাহসিকতা আর বিচক্ষণতার মাধ্যমে। শুধু সাহসিকতা এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয় বরং মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। গত কয়েকদিনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে এটাই পরিষ্কার হয় যে আমাদের অসমসাহসী রাষ্ট্র একটি ক্ষতিকর সমাধানের রাস্তা বেছে নিতে যাচ্ছে।

আজকের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্কটটা আসলে কোথায়? এবং কেন আমি বলছি এই সঙ্কট আমাদের রাজনৈতিক জীবনের এক অবধারিত পর্যায় তা একটু ভেঙ্গে বলা প্রয়োজন। এখানে আগেই বলে নেয়া ভাল যে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিদৃষ্টবাদী নই কিন্তু ইতিহাস এবং অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এমন এক জায়গায় দাড় করিয়েছে যে একজন নিদৃষ্টবাদীর মতো আমিও বিশ্বাস করি এটা আমাদের অমোঘ নিয়তি। আমার এখনও মনে আছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হল। অনেকেই বলল এটা বাতিল হওয়া উচিত। বিএনপি নির্বাচন নিয়ে মোটেই খুশি না হলেও প্রথম থেকেই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির পক্ষে বক্তব্য রাখতে শুরু করল। বিএনপি হয়ত নিজেও তত্ত্বাবধায়কের বর্তমান কাঠামোতে খুশি নয় কিন্তু বিশ্বাস করে যে এই পদ্ধতিতে নির্বাচনে যাওয়া আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে আগেও অনেক নির্বাচন হয়েছে কিন্তু কখনই এই পদ্ধতি বাতিল কিংবা সংস্কারের কথা আমরা শুনতে পাই নি, যদিও প্রতিবারই পরাজিত দল আকারে-ইঙ্গিতে হলেও কারচুপির অভিযোগ করতে ছাড়েনি। কিন্তু এইবার আমরা দেখতে পাচ্ছি বিপ্লবী পরিবর্তন। কেন? মুলতঃ দুটি কারনে তত্ত্বাবধায়কের আজকের সঙ্কট।

১. আগনতান্ত্রিক, সামরিক-সুশীল, নির্বোধ, একগুঁয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের স্বৈরশাসন। এই সময়কাল বাংলাদেশের মানুষ কাটিয়েছে ইতিহাসের দীর্ঘ্তম জরুরী অবস্থার মধ্যে। রাজনীতি, মৌলিক অধিকার, অর্থনীতি সবকিছুকে গ্রাস করেছিল জরুরি অবস্থা। বিশেষকরে রাজনীতিবিদরা হয়েছিলেন এর প্রথম এবং চরম শিকার। তাদের ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক প্রভাব এবং কর্তৃত্ত্ব সবকিছু ধুলায় মিশেছে অকাতরে। ছোটো মাছ থেকে রাঘববোয়াল কেউই রক্ষা পায় নি। কেউ কেউ জনসম্মুখে কেঁদেছেন, কেউ কেউ এমন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন যে এখনও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছেন, কেউ কেউ রাজনীতি আর করবেন না বলে কসম খেয়েছেন, কেউবা ভয়ে সংস্কারপন্থী হয়ে নিজের ক্যরিয়ার এর কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। এসবই সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির কারনে। এই পদ্ধতির কাঁধে চেপেই সামরিক ও আন্তর্জাতিক মদদে কিছু অবসরপ্রাপ্ত রাজকর্মচারী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বাংলাদেশের ক্ষমতায় আরহন করেছিলেন। যাদেরকে আমরা এক-এগারোর আগে দেখেছি হাসিনা-খালেদার কাছ থেকে সুবিধালাভের জন্য হাত কচলে কচলে হাতের রেখা মুছে ফেলতে তারাই ভোল পাল্টে ভণ্ড ফেরেশতা হয়ে প্রবল পরাক্রমে প্রাক্তন প্রভুদের গায়ে-পায়ে শেকল পরিয়ে জুলিয়াস সিজার হয়েছেন। দুর্নীতিমুক্ত, রাজনীতিমুক্ত, সুখি এবং আলোকিত মানুষের এক সোনার বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে, বিদেশি প্রভুদের ক্ষমতায় ক্ষমতাশালী হয়ে, আজন্ম-চাটুকার ফখরুদ্দিনরা সেদিন লৌহমানবের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হাসিনা-খালেদা উভয়ই চরমভাবে লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হয়েছিলেন এই অবৈধ অনুপ্রবেশ কারীদের হাতে। মুলতঃ তখনই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ভাগ্য লিখিত হয়ে যায়। যেই ক্ষমতায় যাক না কেন এই পদ্ধতি যে সংকটের মধ্যে পড়বে এটা নিশ্চিত হয়েছে যখন হাসিনা-খালেদা দুজনেই কারাভোগ করছিলেন। আমার ধারনা বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারাও এই ব্যবস্থা রাখতে চাইত না কারন আমার মতো অনেকেই মনে করেন যে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন এর আমলে বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার পরিবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই হিসেবে তত্ত্বাবধায়কের এই সঙ্কট বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিনতি। আমি বাক্তিগতভাবে মনে করি একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন কোন আইনি সুযোগ থাকা উচিত না যার মাধ্যমে কোন অগণতান্ত্রিক শক্তি দেশকে পরিশুদ্ধ করার নামে ক্ষমতাদখলের মাধ্যমে নাগরিকের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার রহিত করতে পারে। আমি মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের দীর্ঘমেয়াদী জরুরি অবস্থার কথা বলছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ বাহিনীর চালানো তাণ্ডবের কথা বলছি। আমার অনেক বন্ধুর পিঠে এখনও রক্তজবার মতো ক্ষত এবং বুকে আজিজ সুপার মার্কেটের তাণ্ডবের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। আমরা এর পুনরাবৃত্তি চাই না।

২. দ্বিতীয় কারণটি অনেক বেশি অনুমাননির্ভর। নির্বাচনের আগে ও পরে আমরা অসংখ্যবার পাতানো নির্বাচনের কথা শুনেছি। বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলয়ার বারবার একটি পাতানো নির্বাচন এবং এর সাথে জড়িত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। এসব বিষয়গুলোকে নির্বাচন পরবর্তী আত্মপক্ষ সমর্থন বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। কিন্তু ইউনুস বিষয়ক জটিলতা এবং পরবর্তীতে ইন্টারনেট এ ফাঁস হয়ে যাওয়া হাসিনা-হিলারি কথোপকথন; খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক পশ্চিম সফর এবং আন্দোলনের হুমকি আবারও সেই একই চিত্রকে সামনে নিয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। আর তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলের বাংলাদেশের নির্বাচন প্রভাবিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা। বোধকরি হাসিনা-খালেদা দুইজনেই খুব ভালভাবেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অন্তরালের ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যার মধ্যদিয়ে ইচ্ছা করলেই বিদেশি শক্তি তাদের ইচ্ছামত কার্য হাসিল করতে পারে। খালেদার বিদেশ সফর এবং হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের ঘোষণা দৈবক্রমেই একই সঙ্গে হল নাকি এটাও আমাদের রাজনৈতিক জীবনের অমোঘ নিয়তি তা জানার জন্য হয়ত আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। যদি আমার এই অনুমান নির্ভর যুক্তি ঠিক হয় তাহলে নিম্নোক্ত দুটি বিষয়ও ঠিকঃ

প্রথমতঃ হাসিনা পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন এবং তিনি জানেন যারা তার মিত্র ছিল তারা এখন পক্ষ পরিবর্তন করেছেন, ফলে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে আরেকটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা হারাবেন।

দ্বিতীয়তঃ প্রথমটি যদি ঠিক হয় তাহলে শেখ হাসিনা যে কোন মুল্যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করবেন তাতে বিএনপি যত বড় আন্দোলনের হুমকিই দিক না কেন। কারন শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিলের মাধ্যমেই তিনি পরবর্তী সরকার গঠনের ব্যপারে নিশ্চিত হতে পারেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি এটাই করতে যাচ্ছেন।

এসবতো গেল তত্ত্বাবধায়কের সংকটের বিষয়াদি। এই সংকট থেকে উত্তরনের জন্য শেখ হাসিনার হাতের সহজ সমাধান হচ্ছে এই পদ্ধতি তুলে দেয়া। তাহলে কে করবে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন? তার চেয়ে বড় কথা কে নিশ্চিত করবে যে যিনি ক্ষমতায় আছেন তিনি পরাজিত হলে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন? কেন নির্বাচন কমিশন করবে? উন্নত দেশগুলোতে তো এটাই হয়ে আসছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ও গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা হয়তো এটাকে হেসেই উড়িয়ে দেবেন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের লোকবল, আইনি কাঠামো, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তি এবং সর্বোপরি ইচ্ছা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নয় এটা একজন সাধারন বুদ্ধির মানুষও বোঝেন। বিশেষত বিএনপি তো এই নির্বাচন কমিশনকে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। যে কমিশন সংস্কারপন্থী হাফিজকে সংলাপের জন্য চিঠি দিয়ে বিএনপির মহাসচিব বানাতে পারে সেই কমিশনের অন্য অনেক ধরনের জ্ঞান থাকলেও সাধারন জ্ঞানের যে অভাব আছে তাতে সন্দেহ নাই। আমি ভেবে পাই না কতটা নির্বোধ এবং দাম্ভিক হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বুক চেতিয়ে এটাকে ডিফেন্ড করে। তাই বাংলাদেশের এই অসাধারন নির্বাচন কমিশন বিএনপির আস্থা কোনদিনই অর্জন করতে পারে নি। এটাত গেল এই নির্বাচন কমিশনের সমস্যা। সামগ্রিকভাবেও বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সামগ্রিক ভাবে সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষমতা নাই। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে অসহায়, তাদের সেনানিয়োগের এবং রাজনৈতিক প্রশাসন বদল করার এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা নাই। তাদের পক্ষে সম্ভব না মন্ত্রী এমপি দের খেলাপ কিছু করা। তারা হচ্ছেন অনেকটা ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। অনেকে হয়ত আইনি কাঠামো এবং অন্যান্য বিষয়াদি উল্লেখ করে প্রমানের চেষ্টা করতে পারেন যে নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। কিন্তু যারা ক্ষমতার রাজনৈতিক-অর্থনীতি বোঝেন তারা জানেন কেন জলে বসে কুমিরের খেলাপ হওয়া বাংলাদেশের মতো দেশে সম্ভব না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দেশ চলবে ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতিতে। এটা আরেক সমস্যা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ-শিক্ষিত ব্রেইনওয়াশড উপদেষ্টারা আজব আজব সব বুলি তুলে দিচ্ছেন তার মুখে। তাতে তারা তাদের শিক্ষা-দিক্ষার প্রমান রাখছেন ঠিকই কিন্তু বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারন মানুষ। আমি জানি না ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতি বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন এবং তার সাথে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির যোগসূত্র কোথায়? যদি ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতি বলতে তিনি সংসদীয় পদ্ধতির কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তাতো আমাদের আছেই। আর যদি তিনি ইংল্যান্ড এর গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে মস্ত বড় ভুল হচ্ছে। সব অমিলের অবতারনা না করে একটি মাত্র প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। ইংল্যান্ডের সিস্টেমে হেড অফ ষ্টেট হচ্ছেন রানী। এই দেশের রানী হচ্ছেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং তাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতিক। তারা এখনও জাতীয় সংগীত গায় 'গড সেভ আওয়ার গ্রেসিয়াস কুইন' বলে। এমনিতে কুইনের কোন রাজনৈতিক সংযোগ নেই কিন্তু একধরনের সর্বব্যপি অভিভাবকত্ব আছে। যেমন যদি কোন দল নির্বাচনে হারে এবং ক্ষমতা ছাড়তে দেরি করে কুইনের এক ইশারাই তখন কাফি। অনেকে হয়ত গত নির্বাচনে গর্ডন ব্রাউনের নির্বাচন পরবর্তী পদত্যাগ এর বিষয়টি স্মৃতিতে ঝালিয়ে নিতে পারেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল যদি নির্বাচনে হারে তারা যে অতি সহজে ক্ষমতা ছাড়বে এটা আমি বিশ্বাস করি না। আসলে এটা বিশ্বাসের প্রশ্ন ও নয়। আমাদের রাজনীতিতে এই রকম কোন ইতিহাস নেই। তাহলে কে তাদের বাধ্য করবে ক্ষমতা ছাড়তে? প্রেসিডেন্ট? বাংলাদেশের কতজন মানুষ এটা বিশ্বাস করবে? আবার যদি সরকারি দল জেতে তাহলে বিরোধী দল কারচুপির অভিযোগ এনে পরেরদিন থেকেই শুরু করবে সরকার বিরোধী আন্দোলন। যে দলই জিতুক আর যে দলই হারুক দেশের মানুষের কপালে দুঃখ আছে। একটা অস্থির অবস্থা আবার আমাদের দেশটাকে গ্রাস করবে। ক্ষমতা পাওয়া আর ক্ষমতা ছাড়ার জটিলতায় আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, ও জীবন-জীবিকার বারটা বাজার পর হয়ত একদল বিদেশীর সহায়তায় অথবা মদদে আমাদের রাজনীতি সাময়িক স্থিরতা অর্জন করবে। এই পর্যায়ে এসে যারা বিদেশি হস্তক্ষেপকে সার্বভৌমত্ত্বের জন্য হুমকি মনে করেন প্রকারান্তরে বাংলাদেশের গনতন্ত্রকেই সার্বভৌমত্ত্বের হুমকি হিসেবে ভাবতে পারেন। এই জাতীয় উদাহরণ খুজতে বেশি দূর যেতে হবে না। ২০০৭-২০০৮ এ কেনিয়ায় বছরব্যপি নির্বাচন-পরবর্তী গৃহযুদ্ধ, তারপর জিম্বাবুয়ের নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত এসবই খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। এইসব দেশে এখন নতুন ফর্মুলা চলছে। পাওয়ার-শেয়ারিং। দুই দল মিলিয়ে দেশ পরিচালনা করছে ফলে কোন কার্যকর বিরোধী দল থাকছে না। সরকার চলছে অনেকটা জয়েন্ট ভেঞ্চার ব্যবসার আদলে। যে যার মতো লুটেপুটে খাওয়ার একটা বেশ ভাল বন্দোবস্ত হচ্ছে এই পাওয়ার-শেয়ারিং। এতে গনতন্ত্রের বারটা বাজলেও সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে ষোল আনা। রাজনীতি যদি দিনান্তে ভাগবাটোয়ারা ছাড়া আর কিছুই দিতে না পারে তাহলে কি লাভ সেই গনতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়ে। এভাবেই গনতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের অংশে পরিণত হয়।

ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতির বুলি না আউড়ে শেখ হাসিনা ও তার উপদেষ্টাবর্গের একটু মাথা খাটানো দরকার ছিল এই বিষয়ে। কারন বিষয়টি আসলেই জটিল এবং এর প্রভাব সুদুরপ্রসারী। একদিকে আপনি চান না তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি থাকুক আবার আপনার সামনে কোন ভাল বিকল্পও নেই। এই জায়গায় জনগনের পয়সায় পোষা বিদেশ-শিক্ষিত হাই প্রোফাইল অর্ধ ডজন উপদেষ্টাদের কিছু করার ছিল। কে জানে তারাও আবার জলে থেকে কুমিরের প্রভুত্ব মেনে উপদেষ্টা থেকে চাটুকারে পরিণত হয়েছেন কিনা। যাই হোক এই জায়গায় শেখ হাসিনার খুব একটা সুযোগ ছিল সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। তিনি জাতিকে তত্ত্বাবধায়ক সংকটের হাত হতে মুক্তি দিয়ে একটি এমন ব্যবস্থা উপহার দিতে পারতেন যাতে তিনি অবৈধ ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করতে পারতেন এবং সাথে সাথে একটি সুন্দর, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাও করতে পারতেন। তিনি অন্ততঃ তিনটি কাজ করতে পারতেনঃ

১. যারা জরুরি অবস্থা ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে কলুষিত করেছে তাদের শক্ত হাতে বিচার করতে পারতেন। যেসব মাথামোটা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এর মদদ দিয়েছেন এবং পেছনে থেকেছেন তাদেরও বিচার হওয়াটা জরুরি ছিল। তিনি তা করলেন না। এই বিচার অন্য অনেক বিচারের চেয়ে সময়ের বিচারে যে গুরুত্বপূর্ণ তা শেখ হাসিনাকে কে বোঝাবে? একটি বিচারকাজ শুরু করে অন্তত একটি সংকেত দেয়া যেতো যে জনগনের শক্তি কতটা? কেউ যেন আর কোনদিন জনগনের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করার সাহস না পায়।

২. তিনি একটি সর্বদলীয় রাজনৈতিক, আইনি এবং প্রশাসনিক কমিটি কে দায়িত্ব দিতে পারতেন এই ব্যাপারে কি করা যায় তা নির্ধারণ করার জন্য।

৩. তিনি সংসদ কে ব্যবহার করতে পারতেন- এই বিষয়ের আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।

কিন্তু তিনি এসবের কিছুই করলেন না। তিনি কোন আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগ জাতিকে দিলেন না। সুপ্রিম কোর্ট কে বানালেন বলির পাঠা। হায়রে সুপ্রিম কোর্ট! বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সুপ্রিম কোর্ট ধীরে ধীরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠছে এটা আঁচ করলেও আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। কারন আপনি আদালত অবমাননার দায়ে ফেঁসে যেতে পারেন। তাই সুপ্রিম কোর্ট এখন ক্ষমতাধরদের উপযুক্ত বলির পাঠা। শেখ হাসিনার এবারের শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের রাজনৈতিক ব্যবহার এক অনন্য উচ্চতায় পৌচেছে। শেখ হাসিনা খুব চাতুর্যের সাথে সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করেছেন তার রাজনৈতিক জটিল সিদ্ধান্তগুলোতে।আমার মতে এটা আইনের লেবাসে একধরনের একনায়কতন্ত্র। আপনি আদালতের রায়ের খেলাপ কিছুই বলতে পারবেন না। এই জায়গায় আপনার বাক-স্বাধীনতা রুদ্ধ। ফলে আদালতের মাধ্যম রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয়ের সুরাহার একটি সুন্দর ট্রেন্ড আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয় গনতন্ত্রের স্বার্থে আমাদের আদালত, সংসদ, প্রশাসন সবকিছুর একটা পরিস্কার সীমাবদ্ধতা থাকা প্রয়োজন।

আমি কোনো আইনজ্ঞ নই। কী বললে এবং কী করলে আদালত অবমাননা হয় সেটাও আমার কাছে সবসময় পরিষ্কার না। একজন সাধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমি শুধু এটুকু জানি যে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে নাগরিকের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেই অর্থে আধুনিক রাষ্ট্রব্যাবস্থা মানেই গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। যদিও আমি বাক্তিগতভাবে মনে করিনা যে গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যাবস্থাই একমাত্র প্রকৃষ্ট ব্যাবস্থা, তবে নাগরিকেরা যদি মনে করে গণতন্ত্র সেই সমাজের জন্য ভাল তাহলে গনতন্ত্রই ভাল। বাংলাদেশের মানুষ নব্বইয়ের গনঅভ্যুথানের মাধ্যমে গনতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই হিসেবে আমরা গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী। কে জানে হয়ত এ সমাজই আবার কোনদিন মিছিল করে একজন স্বৈরশাসক কে অভ্যর্থনা জানাবে। তখন হয়ত আমরা আবার একনায়কতন্ত্রের পুজারি হয়ে যাব। তখন হয়ত আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সব গনতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অবৈধ ঘোষণা করবে। যদি কেউ বেচে থাকে যে গনতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে তাকে হয়ত বিচারের মুখোমুখি করাবে কারন গণতন্ত্র অবৈধ মানে তো গনতন্ত্রের সংগ্রামও অবৈধ। তা হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারন মানুষ একটি অর্থবহ ও টেকসই গনতন্ত্র চায়। এজন্য দেশে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আমার বাক্তিগত মত হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এখনও অনেক কিছুই করার আছে। সময়ও শেষ হয়ে যায় নি। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ব্যপক অপব্যবহার হয়েছে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলে সত্য কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে আমরা যত গুলো ভাল নির্বাচন পেয়েছি সবগুলোই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির অধীনে। আমাদের দেশে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপড়েন ও সংঘাত নেই শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির কারনে। আমরা যদি সীমাবদ্বভাবে এই পদ্ধতি জাতীয় নির্বাচনের জন্য ব্যবহার করতে পারি তাহলে জাতি ও গনতন্ত্র উপকৃত হবে সন্দেহ নাই।

***
লন্ডন
৩/০৬/২০১১

miton.kibria@gmail.com