বাঙ্গালি চরিত্রের আদি তত্ব্য – একটা মনগড়া ব্যাখ্যা

মরেনো
Published : 1 Jan 2013, 06:01 AM
Updated : 1 Jan 2013, 06:01 AM

দেশি বিদেশি অনেকের মতেই বাঙ্গালী মাত্রই আয়েসি, আরামপ্রিয়, গপমারা, আড্ডাবাজ, অলস, তাঁবেদার, তোঁয়াজকারি, সুবিধাবাদী, চতুর, ধূর্ত। অনেক বাঙ্গালিই এই নিয়া আত্মগ্লানিতে আর হতাশায় ভোগেন দেশ অ জাতির ভবিষ্যত ভাইবা।

তাদের বলি, বেশি হতাশ হইয়েন না, এই বাঙ্গালি চরিত্রাবলির বেশিরভাগই প্রকারভেদে সাধারন ভাবে ভারতিয় উপমহাদেশের জনসাধারনের বেলায়ও ব্যাবহ্রিত হয়, দেশে এবং বিদেশে। আর ভারতের তথাকতিত নিচু কাষ্টের মানুষেরাও হাজার হাজার বছরের নিস্পেষন ও বিজিতের গ্লানি মাথায় নিয়া আরো বেশি হতাশায় আর হিনমন্যতায় ভোগে। ইংলিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান,গ্রিক, আইরিশ, স্লাভ সবাইরি আছে এইরকম স্টেরিও টাইপ চরিত্রের লিস্ট। মানুষের মৌলিক চরিত্রে দেশ-জাতি ভেদে পার্থক্য বেশি নাই, একই ডি-এন-এ তো। যতটুকু পার্থক্য তা প্রকৃতি আর পরিবেশের দির্ঘস্থায়ি প্রভাব মাত্র – সেই দির্ঘস্থায়ি প্রভাবই নিয়ন্ত্রন করে কোন বেসিক ট্রেইট বা ইন্স্টিকন্টগুলি ডমিনেট করবে বিভিন্ন জাতিকে ইতিহাসের বিভিন্ন খন্ডে।

History and nature works in great sweeps of time – মানুষ এক জীবন অথবা বেশি হইলে দুই তিন পুরুষের সাধারন অভিজ্ঞতার রেফারেন্সে এর বিচার করতে যাইয়া ইতিহাসের বিভিন্ন বিন্দুতে হয় নিজেদের হিনতায় হতাশ হয় আথবা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্যে উল্লাসিত হয়।

আমারা বা আমাগো পুর্ব পুরুষরা হারতে হারতে মাইর খাইতে খাইতে, বিদ্রোহি হইয়া বা অন্য যেইভাবেই হোক এই জলাভুমির বদ্বিপে আইসা আস্তানা গাড়লাম ইতিহাসের কোনো এক সময়ে। আস্তে আস্তে পানি আর আদ্রতায় অভ্যস্ত হইয়া গেলাম, তারপর এক সময় ওয়েট রাইস কাল্টিভেশনও শিক্ষ্যা ফালাইলাম। পুকুরে নদিতে মাছ, মানুষ কম, বছরে তিন চাইর মাস আবাদ করলেই ফসলে বছর চলে; আবার খাল-বিল নদি নালা ভাইংঙ্গা বেশি কেও হামলাও করে না – পাইয়া গেলাম সোনার বাংলা। আমরা হইতে শুরু করলাম আয়েসি, আরামপ্রিয়, গপমারা, আড্ডাবাজ, অলস বাঙ্গালি। আয়েসি সহজ জিবনধারনে প্রয়োজন নাই, আবার কোনো মারকুট্টা বহিরআগতের ধাওয়াও নাই তাই আমরা হইয়া গেলাম ঘরকুনা বাঙ্গালি – static, immobile, innovation less, adventure less, risk averse বাঙ্গালি।

এতো আরামে এতো অবসরে আর সহজলভ্য খাদ্যের প্রাচুর্য্যে মাঝে মধ্যেই জনসংখ্যার বিস্ফোরন ঘইটা সোনার বাংলা যায় যায় হইতো। কিন্তু প্রকৃতিই তার সমাধান কইরা দিত – মা শেতলার দাক্ষ্যিন্যে ওলাওঠায় (কলেরায়) গ্রামকে গ্রাম উজাড় হইয়া যাইতো – জনসংখ্যা ধ্বইসা আবার সোনার বাংলা ফিরা আসতো। বাঙ্গালির চরিত্রের শেকড়ও গভির হইতে লাগলো।

এই আয়েসি প্রাকৃতিক সাইকেলে বাগড়া দিল আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান – মা শেতলা আর তার ওলাওঠাসহ বহু ব্যাধি বিদায় নিল, শিশু মৃত্যুর হার কমতে থাকলো, বুড়া বুড়িরা আরো বুড়া হইয়া মরার অভ্যাস করলো, আর জন্ম হার একই থাকলো। ফলে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকলো – ১৯৪৭ শে সাড়ে তিন কোটি, ১৯৭১ এ সাড়ে সাত কোটি আর ২০১১ তে – কে জানে সাড়ে ষোলো কোটি না আরো বেশি (সবকিছুর মত আদম শুমাড়িতেও ভেজাল)।

এই জনসংখ্যার ক্রমাগত বিস্ফোরনে স্বাভাবিকভাবেই জমি ও অন্যান্য বেসিক সম্পদের প্রতিযোগিতা শুরু হইলো বাঙ্গালির মধ্যে, আর তা ধিরে ধিরে বাড়তেই থাকলো। এই প্রতিযোগিতার প্রতিক্রিয়ায় অলস, আয়েসি, আরামপ্রিয়, গপমারা, আড্ডাবাজ বাঙ্গালির চরিত্রে যোগ হইলো ধুর্ততা আর শঠতা। তার বুদ্ধিমান হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না, প্রকৃতি তারে বুদ্ধিমান হওয়ার মতো কোনো পরিবেশই দেয় নাই।

চিন্তা কইরা দেখেন ধুর্ততা-শঠতা আর বুদ্ধি এই দুইটার মৌলিক পার্থক্য কই? একই সমস্যায় ধুর্ততা-শঠতা খোজে স্বল্প মেয়াদি একবারের সমাধান; আর বুদ্ধি খোজে দির্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান – বাস, এইটুকুই পার্থ্যক্য। এখন বাংলার পকৃতি নরম, এর মোটামুটি সব সমস্যাই সাধারন আর স্বল্প মেয়াদিঃ সামান্য মাত্রার ঋতু পরিবর্তন আর কিছু বাৎসরিক বন্যা আর ঝড় যা তেমন কোনো সমস্যাই ছিল না স্বল্প জনসংখ্যার যুগে। তারমধ্যে নদি নালার জলাভুমিতে ছিল না বহিশত্রুর আক্রমন আর যুদ্ধ বিগ্রহ, এবং তার পরিনামে mass dislocation of population. প্রকৃতি আর পরিবেশ বহুযুগ বাঙ্গালিরে দেয় নাই mobile, innovative, adventurous, risk taker হওয়ার প্রয়োজন। বাঙ্গালি ধুর্ত শঠ না হইয়া বুদ্ধিমান হইবো কোন দুঃখ্যে।

হাজার হাজার বছর পরে স্বাধিন হইয়া, স্বাভাবিক ভাবেই ধুর্ততম আর শঠতম বাঙ্গালিরাই হইয়া গেলো আমাগো শাসক শ্রেনি। সব দেশেই সব কালেই সাধারন মানুষ তার চরিত্র মাজা ঘষা করে শাসককুলের অনুকরনে। আমরাও তাই করলাম, মগ্ন হইলাম আমাগো ধুর্ততা আর শঠতার উৎকর্ষতা সাধনে।

একাত্তরের স্বাধিনতা যুদ্ধ একটা সুযোগ দিছিল আমাগো চরিত্র পরিবর্তনের, আমাগো ডি-এন-এ রে একটা বড় আর দির্ঘস্থায়ি মোচোড় দেওয়ার। কপাল খারাপ, কারা জানি মাত্র নয় মাসেই যুদ্ধটার এবর্শন করাইয়া দিল। না পারলাম আমাগো ডি-এন-এ রে একটা বড় আর দির্ঘস্থায়ি মোচোড় দিতে, না পারলাম মৌলিক সমাজ আর রাষ্ট্র সংস্কার করতে – খালি ধুর্ততম আর শঠতম কতোগুলিরে লুটপাট আর কাইজ্জ্যা করার কায়েমি ব্যাবস্থা কইরা দিলাম।

আশা হারাইয়েন না। আমরা বইসা থাকলেও প্রকৃতি বইসা নাই। তারে খানিকটা বাগড়া দিতে পারি আমরা বিজ্ঞান আর চিকিৎসা বিজ্ঞান দিয়া, কিন্তু তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নাই আমাগো, কারন আমরা প্রকৃতিরই অংশ। সে ধিরে ধিরে কিন্তূ অবধারিত গতিতে আমাগো ডি-এন-এ রে একটা প্রচন্ড আর দির্ঘস্থায়ি মোচোড় দেওয়ার আয়োজন করতেছে।

মরেনো/নির্বোধ