অস্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতা ও আমাদের ভবিষ্যৎ

উজ্জ্বল দত্ত
Published : 15 Jan 2012, 07:36 AM
Updated : 5 May 2020, 10:52 AM

অস্বাভাবিকতা মাত্রই স্বাভাবিক ব্যাপার। একটু খটকা লাগছে তো! না, আপনি ঠিকই পড়েছেন। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশের/সমাজের বর্তমান চিত্র। নিয়মনীতিহীনতা/দায়িত্বহীনতা/মনুষ্যত্বহীনতার মতো অসংখ্য অস্বাভাবিক ব্যাপার আমাদের দেশে এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এর তীব্রতা ও ব্যাপ্তি এতটাই যে এই অস্বাভাবিকতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদে পদে লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা সবাই এর জন্য দায়ী।

শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়েই শুরু করা যাক। বাংলা মাধমের স্কুল/কলেজে শিক্ষকরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে প্রাইভেট টিউশনের দিকে বেশি মনোযোগী থাকেন। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার থেকে শিক্ষার্থীর বেতন/ভর্তি ফি/উন্নয়ন ফি এসবের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক ব্যস্ত থাকেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে কিংবা রাজনীতির আদর্শে দীক্ষিত হয়ে দলাদলিতে। শিক্ষার মৌলিক যে নীতি, শিক্ষাদান, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা গৌণ। এখানে প্রাধান্য পায় অর্থ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মতো নিকৃষ্ট মনমানসিকতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকে গৌণ হিসেবে মূল্যায়ন করাটা আমাদের দেশে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা কি রকম সেটা বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রস্তুতি নিয়ে চলমান বিতর্ক থেকেই আন্দাজ করা যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে বলল সব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু যখন করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা শুরু থেকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের ফেরত আসা শুরু করল ঠিক তখনই বোঝা গেলো স্বাস্থ্য সুরক্ষা রাজনৈতিক বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সরকারি হাসপাতালে অপর্যাপ্ত চিকিৎসক, চিকিৎসকের অনিয়মিত উপস্থিতি, মানসম্মত চিকিৎসা সেবার অভাব, দালালের দৌরাত্ম কি নেই। যন্ত্রপাতি কেনা থেকে শুরু করে ওষুধ সরবরাহ, চিকিৎসা সরঞ্জাম সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির স্পষ্ট আধিপত্য দেখা যায়। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে সেবা দেবার বদলে রোগী থেকে কীভাবে জিম্মি করে টাকা আদায় করা যায় সেদিকে নজর বেশি। বেসরকারি হাসপাতালে একবার রোগী ভর্তি হয়ে গেলে রোগী সুস্থ বা মারা না যাওয়া পর্যন্ত বের করে নিয়ে আসা যাবে না। আপনি চাইলেও কোনোভাবেই অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবেন না। পুরো মগের মুল্লক হয়ে গেছে সব। বিপদে ফেলে সি-সেকশন, অপারেশন, একগাদা টেস্ট, ওষুধ, কি নেই। পুরো একটা সিন্ডিকেট। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার এ বেহাল দশা বলেই আর্থিকভাবে সচ্ছল লোকজন পাশের দেশে চলে যান। অনেকেই আমাদের দেশের থেকে কম খরচে ভালো চিকিৎসা নিয়ে ফেরত আসেন। গরিব মানুষগুলো নেহায়েত বিপদে পড়েই হাসপাতালগুলোতে ভিড় করে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় হিসেবে। আর হাসপাতালগুলো এই মানুষগুলোকে শুধু টাকার বস্তা ছাড়া অন্য কিছুই ভাবে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নয়। এর জন্য ডাক্তার না হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা/কর্তৃপক্ষ দায়ী সেই বিতর্ক থেকেই যায়।

সরকারি অফিসে ঘুষ দিয়েই সব কাজ হবে এটাই স্বাভাবিক। ঘুষ ছাড়া কাজ করতে বলাটা এখানে অন্যায় ও অভদ্রতা হিসেবে দেখা হয়। এক ভদ্রলোক আক্ষেপ করে ফেসবুকে লিখেছিলেন উনার ট্যাক্স ফাইল জমা দেবার সময় ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল। যিনি ঘুষ নিয়েছিলেন তিনি নাকি তার সন্তানকে নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তাই একটু ঘুষ নেন। ঘুষ খেয়ে নিজের সন্তানকে তিনি কি শিক্ষা দিচ্ছেন তা মনে হয় কখনো ভেবে দেখেননি। পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের নামে, মাদক মামলার হুমকি দিয়ে পুলিশের নীরব চাঁদাবাজি সহ্য করে যেতে হয়। পরিবহনে ধর্মঘটের ভয় দেখিয়ে সড়ক আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হয়। প্রভাব ও টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করেও দায়ী ব্যক্তিরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় বা বেকুসুর খালাস হয়ে যায়। নিরপরাধী হয়েও আপনাকে বছরের পর বছর আদালত চত্বরে নিয়মিত আসা যাওয়া করতে হবে। পুলিশ, আইনজীবী আর জজ সাহেবকে টাকা দিতে দিতে একদিন নিঃস্ব হয়ে যাবেন। তবুও মামলা থেকে নিস্পত্তি পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা এই আইন আপনাকে দিতে পারবে না।

এতকিছুর পরও আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কি কোনো দোষ নেই, দায়বদ্ধতা নেই? আমি ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে না চাইলেও অন্য আরেকজন ঠিকই টাকা দিয়ে কাজ করাবেন। আরেকজন ঠিকই টাকা দিয়ে বেশি শিক্ষকের কাছে নিজের সন্তানকে পড়াবেন এবং তা অন্যদেরকে শোনাবেন। সব জায়গাতেই আমরা নিজেদেরকে চালাক ভেবে অন্যদের থেকে একধাপ এগিয়ে থাকার জন্য টাকা ও ক্ষমতার প্রভাব খাটাতে চাই। আমরা সব সময় বলে থাকি নেতারা খারাপ। কিন্তু যখন কোনো সৎ ও যোগ্য লোক নির্বাচনে দাঁড়ায় তখন কিন্তু আমরা উনাদেরকে ভোট দেই না। আমরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে কপটাচারী। কেউ টাকার বিনিময়ে অন্যায় কাজ করতে না চাইলে উনাকে রাজনৈতিক কিংবা আইনের লোকের ভয় দেখানোর মতো জঘন্য কাজ করতে আমাদের এতটুকু দ্বিধা কাজ করে না। করোনাভাইরাসের মতো পরিস্থিতিতেও আমরা আইনের নির্দেশ মানতে নারাজ। সবার মধ্যে এমন একটা ভাব যেনো করোনাভাইরাসে কিছুই হবে না। নিয়ম না মানাটাই আমাদের দেশে নিয়ম হয়ে গেছে।

আমাদের দেশে শিক্ষকের চেয়ে একজন মাস্তানের সম্মান বেশি, শিক্ষার চেয়ে অর্থের কদর বেশি, জ্ঞানের থেকে ক্ষমতাকে বেশি বাহবা দেওয়া হয়, বিনয় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হয়, যোগ্যতার থেকে রাজনৈতিক/ব্যক্তিগত সম্পর্ককে অধিক মূল্যায়ন করা হয়, গরীবের ন্যায্য পাওনা হজম করাকে জনসেবা হিসেবে দেখা হয়, প্রতিবাদ করলে নির্যাতিত/হেয় হতে হয়, একজন উন্নতি করতে থাকলে বাকি সবাই তাকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে আনতে চাইবে, এসবই এখন আমাদের সমাজে স্বাভাবিক, সবাই কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে ব্যাপারগুলোতে।

আমাদের বর্তমান সামাজিক অবস্থান, দায়িত্ববোধহীনতা, অপরের সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য ও শব্দচয়ন, স্বেচ্ছাচারিতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের দায়িত্বহীনতা/উস্কানিমূলক কথাবার্তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করতে না পারার দুর্বলতা, অধিকাংশ সময়ে অন্যায়কে পশ্রয় দেওয়া সবই প্রশ্নবিদ্ধ করে জাতি হিসেবে আমার ভবিষ্যৎ অবস্থানকে। একবার ভাবুন তো, আমরা কি এমন বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য?