বাংলাদেশ পেছনে হাঁটছে

নাজমুজ্জামান নোমান
Published : 15 April 2011, 01:51 PM
Updated : 15 April 2011, 01:51 PM

লেখকঃ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান

বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকান্ডের আয়তন পুনর্নিধারণ প্রসঙ্গে দেশটির কংগ্রেসে যে আলোচনা বর্তমানে চলছে, তাতে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসবে বিবেচনা করে এবং উন্নয়নশীল এই দেশটির উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশীদার হয়ে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সরকার সম্প্রতি ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবক ও সফল প্রয়োগকারী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহম্মদ ইউনুসকে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে উৎখাত করেছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়তে চলেছে।

ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। পরবর্তীতে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে মর্যাদাপুর্ণ 'মেডেল অফ ফ্রিডম' এবং মার্কিন কংগ্রেসের তরফ থেকে 'গোল্ড মেডেল' অর্জন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে সময়ের সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিশ্বের অন্যান্য অনেকগুলো দেশে ক্ষুদ্রঋণ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহজ প্রক্রিয়ায় ঋণ লাভের একটি উৎস হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, যার ফলে সেসব মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী, তারা দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে।

ডক্টর ইউনুসের সাথে বাংলাদেশের সরকারের আচরণটি মূলত হয়েছে ঢালাও ভাবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্রঋণকে 'গরীবের রক্তচোষা' হিসেবে আখ্যায়িত করার পরপরই সরকার ডক্টর ইউনুসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অবস্থানের বয়সসীমার অজুহাতটি তৈরি করে।

গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে অবস্থান করার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ষাট বছর। কিন্তু ডক্টর ইউনুসের বয়স ষাট পেরুবার আগেই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদটির ক্ষেত্রে বয়সের ঐ সীমারেখাকে প্রয়োগ করা হবে না। এটি ১৯৯৯ সালের ঘটনা। এমনকি এই বছরের ৮ মার্চ তারিখেও দেশের অর্থ মন্ত্রী জানান যে গ্রামীণ ব্যাংকের বয়সসীমা সংক্রান্ত নীতিমালার ঐ পরিবর্তনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবগত আছে এবং পরিবর্তনটি গৃহীতও হয়েছে।

এক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে ডক্টর ইউনুসের অপসারণের ঘটনা মূলত হচ্ছে বিশাল আয়তনের এই প্রতিষ্ঠানটির উপর কার্যকরী সরকারী নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের একটি প্রচেষ্টা, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসারও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

২০০৭ সালে ডক্টর ইউনুস একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, যেটি মূলত পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকদিন পরিচালিত হয়েছিল এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে সেটির কার্যক্রম থেমেও যায়। ইউনুসের সেই রাজনৈতিক ভূমিকার ব্যাপ্তি নাতিদীর্ঘ হলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেটি ভুলতে পারেননি। দেশব্যাপী তো বটেই, বিশ্বব্যাপীও ডক্টর ইউনুসের প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি তার রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে একটি সুনির্দ্দিষ্ট রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়। অর্থাৎ ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস শেখ হাসিনার একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিপন্ন হন। তার প্রতি সরকারের কুরুচিপুর্ণ আচরণের ব্যাখ্যা হিসেবে একাধিক মন্ত্রী ইউনুসের রাজনৈতিক অভিলাষ ও দল গঠনের ব্যাপারটিকে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ ইউনুস শেখ হাসিনার ব্যাক্তিগত আক্রোশের শিকারই শুধু হননি, সরকারের হাতে তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারও খর্ব হয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণী কাঠামোর উর্ধ্বতন কর্তাব্যাক্তিগণ, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন ও সহকারী মন্ত্রী রবার্ট ব্লেক জুনিয়ার বারবার ইউনুসের সাথে সরকারের দুর্ব্যবহারের ফলে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন এবং স্পষ্ট করে বলেছেন যে বিষয়টির সুরাহা না হলে তা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরই নয়, সেখানকার ২৬ জন জনপ্রতিনিধি স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে শেখ হাসিনার প্রতি ডক্টর ইউনুস ইস্যুর সন্মানজনক সমাধানের জন্য আহবান জানানো হয়।

বিশ্বস্বাস্থ্য ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা কার্যক্রম এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড একাই প্রতি বছর বাংলাদেশকে পৌনে আটশো কোটি টাকার অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। মূলত গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন সহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যয়ের জন্য এই অর্থ সাহায্য দেয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে ডক্টর ইউনুসের প্রতি সরকারের প্রতিহিংসামূলক অন্যায় আচরণের ফলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি তো ঘটবেই, এর ফলে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থ সাহায্যের প্রবাহটিতেও সুদূরপ্রসারী ব্যাঘাত ঘটবে।

ইউনুসের সাথে সরকারের ঐ প্রতিহিংসামূলক আচরণের মধ্য দিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থার পরাধীনতা ও দুর্নীতির বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা শুধু নির্দ্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলছে না, বরং দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আঘাত হানছে, মানুষের মৌলিক অধিকার লংঘন করছে এবং দেশে অস্থিতিশীলতার জন্ম দিচ্ছে। এরই মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেশের বিচার ব্যবস্থার নৈতিকতা ও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং সরকারী হেফাজতে বন্দী নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে।

বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ উঠেছে। গত জুনে 'রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস' সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের গ্রেপ্তার ও পত্রিকাটি বন্ধ করার সরকারী নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। সংগঠনটির প্রকাশিত বক্তব্যে বলা হয়, "(শেখ হাসিনার) সরকার স্পষ্টতই পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনা, বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে সরকারী কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছে।" [(Mrs. Hasina's) government is clearly unable to tolerate criticism from this opposition newspaper and, in particular, its coverage of the controversial award of energy contracts to foreign companies.]

এর আগেও আরও অনেকেই বর্তমান সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক আচরণের শিকার হয়েছে এবং ঘটনাগুলো অনাকাংখিত ভাবে সবার নজর এড়িয়ে গিয়েছে। ডক্টর ইউনুসের প্রতি সরকারের এই আচরণের ফলে বিষয়টির উপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে এই মুহুর্তে বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ব্যাংক ও ডক্টর ইউনুসের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন।

মিত্র বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধসভায় ডক্টর ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংকের সমর্থনে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা উত্থাপন করা উচিত। কঠোর পরিশ্রম ও বহু ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশে একটি ধারাবাহিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে, যে গণতন্ত্রের একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডে ঐ ধারাবাহিক অবস্থাটি অবনতির দিকে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিবর্তে কার্যত পেছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা রোধে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনযোগ ও উদ্যোগ প্রয়োজন।

ডক্টর ইউনুসের সাথে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান মুখোমুখি অবস্থান কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই পরিস্থিতি বর্তমানে পুরো বাংলাদেশের বিচারিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। ইউনুসের মত একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিকে যদি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আক্রান্ত হতে হয়, তাহলে বাংলাদেশে কার্যত একজন নাগরিকও নিরাপদ নন, কোন অবস্থাতেই স্বাধীন নয় বাংলাদেশের সমাজ।