প্রিয় বাংলাদেশ…

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 15 April 2011, 01:07 PM
Updated : 25 Oct 2013, 08:42 PM

এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শাহবাগ চত্বরে যখন কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অবস্থান নিল, তারা ভুলেও আঁচ করেনি পরের দিনগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে। এই আঁচ করতে না-পারাদের তালিকায় আমিও ছিলাম। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার কারাদণ্ডের রায় এবং তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ না থাকাকে মেনে নিতে পারেনি ওই তরুণরা। মূলত অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের এই অবস্থান দুদিনে ছড়িয়ে যায় গোটা দেশে এবং বিদেশেও।

যে প্রান্তেই বাঙালি আছে সেখানেই গড়ে উঠেছে একেকটি রূপক শাহবাগ। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। ৮ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশের দিন গোটা ঢাকা ছিল মিছিলময়। এতে অংশ নিয়েছিলেন সর্বস্তরের জনগণ।

কারণ যে ইস্যু নিয়ে শাহবাগের জাগরণ সেটা কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে– সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছিল– তাদের বিচার চাওয়া কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। একজন শহীদের সন্তান, একজন বীরাঙ্গনার ভাই এই বিচার চাইতেই পারেন। এটা স্বীকৃত চর্চা সারা পৃথিবীতে।

তারপরও একে রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। প্রধান বিরোধী দল ঘোষণা দিয়ে বলেছে, এটা আওয়ামী লীগের নাটক। প্রতিক্রিয়ায় তাদের এমন একটা নাটক মঞ্চস্থ করার আহবান জানানো হয়েছিল যা তারা পারেননি।

এরপর ১৯৯২-র গণআদালতের সময় যে ইস্যুটা সামনে এনেছিল জামাত-শিবির, সেটাই আবার আনল। আন্দোলনকারীদের 'নাস্তিক' বানিয়ে দিয়ে তাদের ধর্মের মুখোমুখী করিয়ে দেওয়া হল। হত্যা করা হল আন্দোলনে যুক্ত একজন ব্লগারকে।

আন্দোলনে বিভক্তি টানতে স্বাধীনতাবিরোধীদের পেইড এজেন্টরা গুজব রটিয়ে দিল গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা চাঁদাবাজি করছে, বিদেশে তারা বিপুল সম্পদ জড়ো করেছে এবং সবার ভিসা হয়ে গেছে, বর্তমান সরকার পদত্যাগ করলেই এরা পালাবে।

তালিকায় আমার নামও আছে যার কিনা কানাডার ভিসা হয়ে গেছে যদিও আমার কোনো পাসপোর্ট নেই! এইসব গুজব সেখান থেকেই এসেছে যেখানে কাবা শরীফের গিলাফ বদলের ছবিকেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

তো শাহবাগের অর্জন কী? চাঁদাবাজি? সরকারের দালালি? বিদেশে সম্পদ ও অভিবাসন? ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান?

না। শাহবাগ জাতীয় সংসদকে বাধ্য করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আপিল করার আইনে সংশোধন আনতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় সম্ভব হয়েছে এই সংশোধনী যা করতে মাত্র ৪৮ ঘন্টা সময় লেগেছে, এর আগের সংশোধনীটি নিয়েছিল ৬১ কার্যদিবস।

সেই সংশোধনীর নিমিত্তেই ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ আপিল আদেশে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দিয়েছেন মাননীয় আদালত। হ্যাঁ, এটাই শাহবাগের অর্জন। এটাই আপনাদের অর্জন যারা সপরিবারে শাহবাগের তরুণদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের এত সহজে রেহাই পেতে দেবেন না। এই আপনারাই ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই' ইস্যুতে। আওয়ামী লীগ এর পক্ষে ছিল বলেই আপনারা ভোট দিয়েছিলেন নৌকায়।

শাহবাগ ঘোষণায় কিন্তু আরও কিছু সংযুক্তি ছিল; তার অন্যতম হচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অবসান এবং এতে সংশ্লিষ্টদের নিষিদ্ধ করার দাবি। আর সে দাবিতে সোচ্চার হওয়ার আগে হেফাজতে ইসলামীসহ নানা বিভ্রান্তির বেড়াজালে শাহবাগের তরুণদের সমাবেশকে ফিকে করে দেওয়া হয়।

তার মানে কিন্তু এই নয় যে সেই তরুণরা চুপচাপ বসে আছে, অভিমান উপেক্ষা করে বিবেকের ডাকে সায় দিয়ে ফের 'জয় বাংলা' বলে রাস্তায় নামবে না। কথা হচ্ছে সেই সময়টা নিয়ে। কাদের মোল্লার ফাঁসিতেই কিন্তু সব শেষ হয়ে যায়নি। বরং প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ ছাড়বে না রাগী তারুণ্য। একজন হলেও থাকবে সেখানে। খালি চোখে সেটা যেমনই দেখাক না কেন।

শাহবাগের মুল অ্যাসেন্স কিন্তু এইসব নয়। সেখানে যদি রাজনীতি বা রাজনৈতিক দাবি থেকে থাকে কোনো, সেটা হচ্ছে এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাজনীতি চায়। তারা যুদ্ধাপরাধীদের এবং তাদের দোসরদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চায় না।

তারা চায় যেই সরকারে আসুক তার আদর্শ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যে বিরোধী দলে থাকবে তারও। এটা বাস্তবায়নের জন্যই শাহবাগে অংশ নিয়েছিল প্রচুর তরুণ। আমি মনে করি, সময় এসেছে সেই দাবিতে আবারও রাস্তায় নামার।

গত কয়েকদিন ধরে যেসব রাজনৈতিক আস্ফালন ও হুমকি দেশের জনগণকে সইতে হচ্ছে তাতে এর আর কোনো বিকল্প দেখছি না তরুণ প্রজন্মের জন্য। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা সম্ভবত ধরেই নিয়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতা একটা ইজারার মতো। পাঁচের নামতা পড়ে তারা ক্ষমতায় আসবেন এবং যাবেন। এখানে জনগণের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার কোনো দামই নেই।

বিরোধী দল নেত্রী শুক্রবারের সমাবেশে ঘোষণাই দিয়ে দিলেন, এই সরকার যাদের আটক করেছে ক্ষমতায় গেলে সবাইকে মুক্তি দিয়ে দিবেন। উচ্চারণ না করলেও হাবেভাবে এই তালিকায় সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীরাও রয়েছেন।

এই প্রতিশ্রুতি তিনি কাদের দিচ্ছেন? জনগণকে? ভোটারদের? তারা কি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চেয়ে আন্দোলনে নেমেছে? ভোটাররা কি আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি রাখেনি বলে নাখোশ তাদের উপর? তাহলে কাদের উদ্দেশ্যে ‌এই ‌পারলে ঠেকাও‌' ‌প্রতিশ্রুতি? কিংবা চ্যালেঞ্জ!

প্রিয় জনগণ, একবার ভাবুন আপনার অস্তিত্বের কথা। এই দেশ নিয়ে আপনার গর্বের কথা। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের তিরিশ লাখ শহীদ ও লাখো বীরাঙ্গনার কথা। লাল সবুজ ওই পতাকার কথা। আমরা কোনো স্বৈরাচারীর বুটের নিচে পড়িনি, আমাদের বুকে কারও বন্দুক তাক করা নেই যে আমরা মনের কথা বলতে পারব না সোচ্চারে।

এই গণতান্ত্রিক পরিবেশে আমরা ক্ষমতা রাখি প্রতিবাদের। আমরা বলতে পারি, থামো, আমি ভোট দিয়ে নির্ধারণ করব এই দেশের শাসনক্ষমতা। আ্মার ভোট নির্ধারণ করবে তুমি আমাকে শাসন করার যোগ্যতা রাখ কিনা। সেই ভোট দেওয়ার আগে আমি অবশ্যই বিবেচনা করব আমি তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করব কিনা, তাদের লুণ্ঠিত আব্রু পায়ে মারিয়ে রাজাকার-আলবদরদের সাংসদ বানাব কিনা, মন্ত্রী বানাব কিনা। সিদ্ধান্ত আমার, সেটা চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার তুমি রাখ না।

প্রিয় প্রজন্ম, সময় হয়েছে আবারও গর্জে ওঠার। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করতে আমরা দেব না, তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষমা এবং মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে আমরা দেব না। এই দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং ধর্মের মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে শোষণ করতে আমরা দেব না।

যে লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা একদিন রাইফেল হাতে জীবন বাজি রেখেছিল, তাদের ত্যাগের সঙ্গে বেঈমানি আমরা করতে দেব না। আমাদের পূর্বসূরীদের ভুল শোধরাতেই আমরা রাস্তায় নেমেছি। আগে হয়নি বলে এখন হবে না এমন কোনো কথা নেই।

যুদ্ধটা শেষ না করে ঘরে ফিরব না আমরা। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ সফল হোক।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় তারুণ্য।

অমি রহমান পিয়াল: ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।