শাঁওলী মিত্র: কিংবদন্তি পরম্পরা

বিপ্লব বালা
Published : 4 Sept 2011, 02:37 AM
Updated : 18 Jan 2022, 10:10 AM


এমন নাকি ঘটে না তেমন, পিতা-মাতা-সন্তান তিনজনই হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি! ভারতীয় আধুনিক নাট্যের প্রধান পুরুষ শম্ভু মিত্র ছিলেন দিগ্বিজয়ী অভিনেতা, নির্দেশক, বাংলা নবনাট্য দল বহুরূপীর মুখ্য সংগঠক, সংঘটক। ভারতবর্ষের থিয়েটারের আচার্য শম্ভু মিত্র ছিলেন দেশজুড়ে গভীর দায়বদ্ধ নাট্যক্রিয়া প্রবর্তনায়। নাগরিক মঞ্চে বাংলা বাচন আবিষ্কার করেন তিনি রবীন্দ্রনাট্যের যথাপ্রয়োগে। অন্যদিকে, তৃপ্তি মিত্র আমর্ম ছিলেন সেই অভিনয়ধারার মুখ্য অভিনেত্রী, কুশীলব। পাকিস্তান আমলে আমরা আকাশবাণীতে তাঁর মর্মচেরা বাচন ও অভিনয়ের চেতাবনিতে আকুল হয়েছি। গতশতকের ষাট-সত্তর দশকে, বলা যায়, বাংলাদেশের সকল অগ্রজ নাট্যজনই।

এহেন দুই ভারতজয়ী অভিনেত্রীর সন্তান শাঁওলী মিত্রেরও আরেক কিংবদন্তি হয়ে ওঠা কোনো সহজ কাজ ছিল না। পদে পদে তাকে প্রতিভাবান মাতাপিতার হরবোলা অনুসারী কী-না তার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়েছে। নান্দনিক উচ্চতার অসম্ভব এই ধারাপাত আমরা তো সহজে মেনে নিতে পারি না, বিখ্যাতজনের সন্তানকে তাই বড়োই কঠিন বিচারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ি।

সৃজনক্রিয়ায় আমুণ্ডুগ্রস্ত পিতামাতা শৈশবে শাঁওলীকে সময়ও দিতে পারেনি। ছোটো থেকেই রোগাভোগা একলা একা মেয়েটিকে নিজেই বাঁচতে হতো, বাসায় কেউ ছিল না যে লালনপালন করবে।

সেও যে অভিনয় করতে পারে বাবা-মা কেউই তা জানতেনও না। দলের প্রয়োজনেই তাকে ডাকঘর নাটকের অমল হতে হয়েছে কিংবা রাজা নাটকে সুরঙ্গমা। যারা তা দেখেছেন, শুনেছেন ইহজন্মের মতো স্মৃতির সম্বল হয়ে আছে তাদের। আমরা আকাশবাণীতে শুনেছি অমর্ত্য সে রাবীন্দ্রিক বচন। তারপর নিজে নিজে স্কুলকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করে বড়ো হন, অভিনয় করেন বাদল সরকারের পাগলা ঘোড়ায়; চরিত্রের অমন বিমূঢ়, ভূতগ্রস্ত সে অভিনয় আমরা ঢাকায় দেখেছি। চুয়াত্তরে বহুরূপী যখন তৃপ্তি মিত্রর অবিস্মরণীয় একক অভিনয় অপরাজিতা করে।

মনে পড়ে পত্রিকায় লেখা হয়, প্রতিভার একটা সীমা থাকা দরকার! অবশ্য বাংলাদেশের দর্শক ১৯৫৬ সালেই দেখেছিল তাঁর দিগ্বিজয়ী অভিনয়– রক্তকরবীর নন্দিনী আর ছেঁড়াতারের ফুলজান-এ। সেই প্রথম বুঝি ঢাকার নাট্যজনের মনে উপ্ত হয় এহেন নাট্যচর্যার কল্পনা, স্বাধীনতার পরে যা ফলবান হয়। তবে আকাশবাণীতেই বেশিরভাগ শ্রোতা শম্ভু-তৃপ্তি মিত্রর রাজা অয়দিপাউস, বিসর্জন, তাহার নামটি রঞ্জনাসহ আরো সব অভিনয়ের অমিয় বাংলা বচন শোনে। পরে সকল নাট্যজনকেই দুরন্ত সেই সম্মোহন মোকাবেলা করেই নিজস্ব অভিনয়রীতি আয়ত্ত করতে হয়েছে।

আশির দশকে শাঁওলী মিত্র যখন আকাশবাণীতে অভিনয় করতে শুরু করেন তখন তাকেও মুখোমুখি হতে হয়েছে মায়ের সে দিগ্বিজয়ী বচন আর অভিনয়রীতির। তার সাথে পাল্লা দিয়েই পাল্টা এক আত্মপ্রকাশ মুূদ্রা খুঁজে পেতে হয়েছে। তাতে তিনি জয়ী হয়েছেন। তারপর তিনি নিজেই লিখে ফেলেন নাথবতী অনাথবত, দীর্ঘদিন মঞ্চ থেকে দূরে থেকে। পিতার কাছ থেকেই পান স্বদেশীয় কথকতারীতির সুলুক-সন্ধান, সেইসাথে ইরাবতী কার্ভের মহাভারতের নবভাষ্য– যুগান্ত। নেমে পড়েন একলাই, তিনি সমর্থ হন এক অভিনয়রীতির নাগরিক প্রয়োগে। ভারতজুড়ে বছরকয়েক ধরে সাধারণ-অসাধারণ কত যে দর্শককুল আপ্লূত মাতোয়ারা হয়ে ওঠে ধীমতী কথকের সে অভিনয়ে!

কলকাতার নাট্যজন অবশ্য দীর্ঘদিন বিরুদ্ধতা করেছে তার। গ্রুপ থিয়েটারের সেই প্রতাপকালে একক অভিনয়ের এই দর্শকধন্যতায় যখন কিনা তাদের নাটক জনাকয়েক দর্শক নিয়ে টিমটিম করে চলতো। দলীয়তার বাইরে ব্যক্তির এই নীতিবিরোধী রূপায়ণ তারপর তো একের পর এক অভিনেত্রী করে চলে। আমরা ঢাকায় বসে দেখেছি নাথবতী আর কথা অমৃতসমান। অভিনেত্রী হিসেবে তার জয়জয়কার কালে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, শাঁওলী নাট্যকার হিসেবে আরো বড়ো, সেটা উপর্যুক্ত দুই নাট্যলেখন সূত্রেই বলেন। তিনিই বলেছেন মোক্ষম কথাটি– ইতিহাসে দুর্লভ এই কিংবদন্তি পরম্পরা!

শাঁওলী মিত্র বারদুয়েক জাহাঙ্গীরনগর নাট্যতত্ত্বে অতিথি শিক্ষক হিসেবে এসেছেন, সেলিম আল দীনের সনির্বদ্ধ অনুরোধে, বর্ণনাত্মক অভিনয়ের তালিম দিতে। অভিনয় ছাড়াও নানাসূত্রে এসেছেন ঢাকায়, চট্টগ্রাম, সিলেটে। দিগ্বিজয়ী পরিবারের এই ত্রয়ী বাংলাদেশের ধন্যজন। মায়ের বাড়ি ঠাকুরগাঁও-এ, চুয়াত্তরে যখন অভিনয় করতে আসেন, আমন্ত্রিত হয়ে বত্রিশ নম্বরে গেলে, বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসে স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন–জামাই আইছে, আমি প্রটোকল মানি না। স্বয়ং শম্ভু মিত্র মুগ্ধ বিস্ময়ে তার স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রয়াত কন্যারত্নটিও আমাদের বড়োই আপনজন,ধন্য ধন্য তিনি।

ওম শান্তি! ওম মায়া! ওম লীলা!