মানুষের ‘ভেতরের কুকুর’

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 17 Sept 2020, 03:01 PM
Updated : 17 Sept 2020, 03:01 PM

আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি

তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে

(আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি) –সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মানুষের ভেতরের পশু বা কুকুরটাকে দেখতে চায় অনেকে। কিন্তু যে কুকুর নিজের জানবাজি রেখে মনিব বা প্রভুকে বাঁচায় তার গল্প কয়জন মনে রাখে? মনিব মরে যাবার পরে যে কুকুর প্রতিদিন তার কবরে মাথা রেখে শুয়ে থাকত, মনিবের শোকে যে কুকুর একদিন নিজেও মারা যায় তার গল্প জেনে কয়জন মন খারাপ করে? যে কোনো বিচারে এটা নিশ্চিত যে কুকুরের চেয়ে মানুষভক্ত ও উপকারি প্রাণী আর কোনোটা নেই। তবু যে গল্প জনপ্রিয় হয় তা এমন–

একলোকের বউ মারা গেছে। শেষযাত্রায় অনেক মানুষ তার পেছন পেছন যাচ্ছে। দূর থেকে একজন খুবই অবাক হলো শেষযাত্রায় এত মানুষকে দেখে। সেই একজন দ্রুত এসে স্বামীর কাছে জানতে চাইলো-

– আপনার স্ত্রী মারা গিয়েছেন?

– জ্বী।

– সে খুব ভাগ্যবান। এত মানুষ তার শেষযাত্রায় সমবেত হয়েছে। তো কীভাবে ওনার মৃত্যু হয়েছিল?

– কুকুরের কামড়ে!

– ঐ কুকুরটাকে কী একটু ধার নেয়া যাবে?

– তাহলে প্লিজ শৃংখলা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান!

তবে গল্পের সব কুকুর যে কামড়ায় তেমন কিন্তু না! যেমন;

এক লোক মুদি দোকানদারি করে। সে খেয়াল করল প্রতিদিন একটা কুকুর এসে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে যায়। কুকুরের গলায় সুদৃশ্য বেল্ট। সে একটা চিঠি লিখে বেল্টে গুজে দিল। চিঠিতে লিখল- দেখে মনে হয় ভালো কারো পোষা কুকুর। কিন্তু আমার এখানে এসে ঘুমায় কেন? পরদিন কুকুর এসে তার বেল্টের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মুদি দোকানদার দেখল বেল্টের ওখানে কেউ চিঠি গুজে দিয়েছে। সে চিঠি খুলে দেখল সেখানে লেখা- ভাই আপনাকে ধন্যবাদ। বউয়ের যন্ত্রণায় আমি ও আমার কুকুরটা ঘুমুতে পারি না। কাল থেকে আমিও কুকুরটার সাথে এসে আপনার ওখানে ঘুমুতে চাই!

গল্প তো গল্পই। কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির কুকুর? যেসব কুকুর ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে থাকে কী অবস্থা তাদের? এইসব 'বেওয়ারিশ' কুকুর মারার জন্য নাকি ফান্ড থাকে। একসময় গুলি করে কুকুর মারা হতো। এরপর ইনজেকশন দিয়ে কুকুর মারার প্রচলন চালু হয়। এইসব কুকুরদের ঢাকা শহর ছাড়া করার জন্যও বাজেট থাকে। এমন কী এইসব রাস্তার কুকুরদের 'প্রজননহীন' করার জন্যও নাকি সিটি করপোরেশনের ফান্ড থাকে। প্রজননহীনতার ইনজেকশন নিলে রাস্তাঘাটে বা "ভাদ্রমাসে' এসব কুকুর যাই করুক এদের সংখ্যা আর বাড়বে না! আহহ কী বুদ্ধি মানুষের!

অবশ্য সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুকুরের কামড়ে আহত হয়ে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন প্রতি বছরের জুলাই, অগাস্ট, সেপ্টেম্বরে তাদের সংখ্যা বাড়ে! ব্যঙ্গ করে বলা হয় ভাদ্রমাসের কুকুর নাকি কামুক কুকুর। কুকুর শুধু তাদের প্রজনন কাজে বাঁধা দিলে কামড়ায় না আরও অনেক কারণে কামড়ায়। ক্ষুধার জ্বালায় যেমন কুকুর কামড়ায় তেমনি পাগলা কুকুর নাকি কারণে-অকারণে মানুষ কামড়ায়! প্রতিবছর নাকি সারা বাংলাদেশে প্রায় তিনলাখ মানুষ কুকুরের কামড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এদেশে গড়ে পনের জন মানুষ নাকি প্রতিদিন কুকুরের কামড় খায়! ঘুষের মতো কুকুরের কামড়ও নাকি এক ধরনের খাওয়া! মানুষ বিষও খায় আবার চুমুও খায়!

মানুষকে কামড়ানোর কারণেই সম্ভবতঃ কুকুরের পেছনে মিউনিসিপ্যালিটির এত টাকা খরচ হয়! আগে কুকুর হত্যা ও সৎকারের জন্য বাজেট ছিল, এখন আছে কুকুরকে দেশান্তরী করার জন্য (ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেয়াটা নাকি কুকুরের জন্য দেশান্তর। তবে দেশান্তরী কুকুরদের সবই নাকি পথ চিনে ফিরে আসতে পারে! পথ চিনে ফিরে আসতে পারাটা কুকুর বা বেড়ালের জন্য এক অন্যরকম গুণ!) আর বন্ধ্যা বা খোঁজাকরণের জন্য। যদিও কয়েকটা পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে ২০১৯ সালের শেষদিক থেকে ২০২০ এর অগাস্ট পর্যন্ত কুকুরের জন্য খোঁজাকরণ পদ্ধতি বন্ধ রেখেছিল দুই সিটি করপোরেশন!

সিটি করপোরেশানের এই একটা দিক খুব ভালো। শুধু মানুষদের জন্যই সিটি করপোরেশন না, তারা কুকুরদের জন্যও! যদিও ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত কত কুকুরকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে বা কত পথকুকুরকে বন্ধ্যা করা হয়েছে তার হিসেব অনেকের কাছেই নেই! যত দুর্নীতি হোক কুকুরদের জন্য কিংবা জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে সংশিষ্ট সরকারি কর্মচারিদের যত বাণিজ্য থাকুক, এখন প্রচুর মানুষ আছেন এইসব বেওয়ারিশ কুকুরদের জন্য। কেউ আহত কুকুরদের সেবা দেন, কেউ আটকে পড়া কুকুরদের উদ্ধার করেন। কেউ কেউ আছেন এসব পথকুকুরদের খাবার কিনে খাওয়ান। কেউ কেউ আশ্রয় দেন। মানুষের মানবতায় যেন বেঁচে থাকে পথকুকুররা সেই কামনা করে সিটি করপোরেশন কুকুরদের কারণে কতটা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হলো সেটা না হয় ভুলে যাই! যেন মনে রাখি কুকুর বিষয়ক গল্প, কৌতুক আর মজাদার তথ্য।

তল্লাশি ও নিরাপত্তার কাজে পৃথিবীর অনেক দেশে কুকুরের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশেও এখন ডগ স্কোয়াড আছে। সারা পৃথিবীতে কুকুরের জনপ্রিয়তম নাম হচ্ছে টমি, রেক্স কিংবা ফিডো। আব্রাহাম লিংকনের পোষা কুকুরের নাম ছিল ফিডো। তবে সোরোয়ানি নামের একজন মানুষের পোষা কুকুর ফিডো এখনও বিখ্যাত হয়ে আছে। কারখানার কাজ শেষে সোরোয়ানি এসে নামত বাসার কাছের রেলস্টেশনে। ফিডো রেলস্টেশনে এসে অপেক্ষা করত। সোরোয়ানি এলে ফিডো তাকে নিয়ে বাসায় ফিরত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একদিন বোমা হামলা হলে কারখানার ভেতরে মারা যায় সোরোয়ানি। ফিডো স্টেশনে এসে সোরোয়ানিকে পায় না। এরপর থেকে সে প্রতিদিন স্টেশনে আসে আর ফিরে যায় বাসায়। সোরোয়ানির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কয়েক বছর পর একদিন নিজেই মারা যায় ফিডো!

সিনেমা ও রিপ্লের 'বিলিভ ইট অর নট' এর কারণে বিখ্যাত হয়ে ওঠা আরেক কুকুরের নাম ছিল ববি। ববি তার মনিবের সাথে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা থেকে সিলভারটন যাবার সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ববির মনিব কত যে খুঁজেছেন ববিকে। কিন্তু ছয়মাস পরে একদিন। বরফ, রোদ ও বৃষ্টিতে টানা ২৫৫১ মাইল পাড়ি দিয়ে মনিবের কাছে ফিরে আসে ববি। ববির এতটা পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছিল ৬ মাস!

গল্পের আরেক কুকুরের নাম গেলার্ট। ইংল্যান্ডের রাজা ওয়েলসের রাজকুমার জন লিওয়েনেলকে এই কুকুরটা উপহার দিয়েছিলেন। একদিন লিওয়েনেল শিকারে যাবার সময় গেলার্টকে খুঁজে পাননি। তিনি শিকার থেকে ফিরে দেখেন গেলার্ট রক্তাক্ত। তার গায়ে ক্ষতচিহ্ন। লিওয়েনেলের মন কেমন যেন করে ওঠে। অন্দরমহলে ছুটে যেয়ে তিনি তার একবছর বয়সী শিশুপুত্রকে দেখতে না পেয়ে মেঝেতে রক্ত পড়ে থাকতে দেখেন। তার মনে হয় যে কুকুর গেলার্ট শিশু রাজপুত্রকে খেয়ে ফেলেছে। লিওয়েনেল তরবারির কোপে মেরে ফেলেন গেলার্টকে। একটু পরেই কেঁদে ওঠে তার শিশু। তিনি অবাক হয়ে দেখেন তার শিশু অক্ষত আছে। আর বিছানার ওপাশে মরে পরে আছে এক নেকড়ে যে কিনা শিশুটিকে মারতে এসেছিল। লিওয়েনেল গেলার্টকে ভুলতে পারেননি। তাকে রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু স্থানে সমাহিত করেছিলেন।

কুকুরদের এমন গল্প শুনলে পথকুকুরদের কামড়ানোর ঘটনাকে নিছক কৌতুককরই মনে হয়। পৃথিবীতে লক্ষ বা কোটি টাকা দামের সেমোয়েড প্রজাতি কিংবা ইংলিশ বুলডগ, চাউচাউ ও লোউচেনের মতো দামী কুকুর যেমন আছে তেমনি আছে চেকো, পিটবুল, জার্মান রয়্যারবুল বা ডোগো আর্জেন্টিনার মতো হিংস্র কুকুর। বাংলাদেশের সরাইলের কুকুর কিন্তু বেশ বিখ্যাত। এদেশের পথকুকুরদের মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যহীন সম্ভবতঃ নেড়ি কুকুর!

লেখার শুরুটা করেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার লাইন দিয়ে। মানুষের বাইরের রূপ এক আর 'ভেতরের কুকুরটার' রূপ আরেক। প্রেমিকার ওপর রাগ করে অনেকেই বলেন তোমার কথা মনে হলেই ভাবনায় আসে যে তোমার চেয়ে পোষা কুকুরটাকে ভালোবাসাই শ্রেয়! লেখাটা শেষ করার জন্য কৌতুকই সম্ভবতঃ শ্রেয়!

একবার ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম এক রেললাইন তুলে নিতে চেয়েছিল সরকার। প্রতিবাদে ৩৪ হাজার মানুষের সাথে একটা কুকুরও পথে নেমেছিল। ৩৪ হাজার মানুষের স্বাক্ষরের সাথে কুকুরের পায়ের ছাপও স্মারকলিপির সাথে দেয়া হয়েছিল। এই কুকুরের নাম ছিল রূসওয়ার্প!

খুশবন্ত সিং-এর কারণে শিখদের নিয়ে কৌতুক এই উপমহাদেশে খুবই বিখ্যাত। এক শিখ সকাল বেলা বৌকে গর্ব করে বলছিল- আজ ভালো খাবার রেধে দিও আমাকে। দুই বন্ধুর সাথে আজ আমার বাঘ শিকারে যাবার কথা। রান্না করে স্ত্রী সেই শিখকে বলল- যাও এখন শিকারে গিয়ে আমাকে ধন্য করো। রওনা হবার জন্য দরজা খুলে আবারও শব্দ করে দরজা আটকে দিল শিখ। বউ জানতে চাইল- কী হলো? শিখ ভয়ে ভয়ে বলল- দরজার ওপাশে একটা বড় কুকুর শুয়ে আছে!

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে কুকুর বিষয়ক ফান্ড, দুর্নীতি কিংবা পরিসংখ্যান যতই বের হতে থাকুক না কেন, মানুষের স্বভাব বদলাবে না! মানুষ প্রশংসা করবে সিংহের কিন্ত গালি দেবে কুকুরের নামেই!