জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে সাধুবাদ

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 8 Feb 2012, 07:00 AM
Updated : 14 Feb 2021, 08:34 AM

গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) জিয়াউর রহমান, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী এবং মোসলেম উদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা খেতাব বাতিল এবং খন্দকার মোশতাককে দেওয়া সম্মাননা বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা উচ্চতর প্রশংসা এবং সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত জনতা।

সাধুবাদ পাওয়ার মতো জামুকার এ সিদ্ধান্তটি ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের পর থেকেই আমরা এ সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাকুল ছিলাম। প্রথমে দেখা যাক জিয়ার বিষয়টি।

জিয়া কি আদৌ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?

গত ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বলেছেন, জিয়াকে বীর উত্তম পদক দেয়াটাই ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি আরো বলেছেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে তেমন কোনো অবদান রেখেছে বলে তার জানা নেই এবং ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল ন্যাক্কারজনক, তিনি মোশতাকের সহচর ছিলেন। কয়েকদিন আগে মুক্তযুদ্ধ গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ একটি অনলাইন সংবাদ পোর্টালে বলেছেন, "জিয়ার যুদ্ধ করার কোন নজির নাই।"

জেনারেল শফিউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধকালে জিয়া সম্পর্কে যা বলেছেন, সে কথা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই সচরাচর বলে থাকেন। আমি যখন তাহের হত্যা সংক্রান্ত রিট মামলা শুনছিলাম তখন যেসব মুক্তিযোদ্ধা সে মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারা এক বাক্যে বলেছেন- মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার বন্দুক থেকে একটি বুলেটও ফোটেনি। সকল শীর্ষ মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনার কথা বিভিন্ন পুস্তকে, প্রকাশনীতে ছাপা হয়েছে। কিন্তু জিয়া যুদ্ধ করেছেন, এমন কথার উল্লেখ কোথাও নেই। জেনারেল শফিউল্লাহ আরো একটি কথা বলেছেন যা হলো- ৭১ সালের ১৩ মার্চ তিনি যখন বিদ্রোহ করেন, তখন জিয়া পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পাকিস্তানি সামরিক সরঞ্জাম খালাস করতে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়েছিলেন। জিয়া যে পাকিস্তানি সমরাস্ত্র খালাসের জন্য সোওয়াত জাহাজে গিয়েছিলেন সে কথা এর আগেও অনেক শীর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিক তার বইয়ে একথা স্পষ্ট করে লিখেছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী আমাদেরকে (আমি, গাফফার চৌধুরী এবং মাইকেল বার্নস) একই কথা বলেছিলেন। আশির দশকে সেসময়ের রাষ্ট্রপতি এরশাদ মীর শওকত আলীকে দেশে তলব করেছিলেন। তখন বিলেতে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার জন্য আমার অফিসে (যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারি সার্ভিস) গাফফার চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এসব কথা তখনই বলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী বহু মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, জিয়া যখন সোওয়াত জাহাজের দিকে যাচ্ছিল তখন বাঙালি সেনারা তাকে সতর্ক করে বলে- জাহাজের দিকে আর এক পা এগোলে তারা জিয়াকে গুলি করবে। এ সতর্কবাণী শোনার পরই জিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে বাঙালি সেনাদের দলে আসেন নিজের জীবন বাঁচাতে। পরবর্তীতে তাদেরই চাপে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধের ঘোষণা পাঠ করেন। এসব কথাও মীর শওকত আমাদের বলেছিলেন ৮০-র দশকে লন্ডনে আমার অফিসে এসে।

পরবর্তীকালে জিয়া পশ্চিম বাংলায় চলে গিয়ে প্রথমে মোশতাকের সাথে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে জড়িত হয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী। কিন্তু এর ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। জিয়ার সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র ছিল মুজিবনগরভিত্তিক সরকারের বিরোধিতা করে বিপ্লবী কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা যাতে তিনি নিজ ইচ্ছায় তা প্রবাহিত করতে পারে। কলকাতা যাওয়ার কিছুদিন পরেই তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই-এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে পাকিস্তানি চর হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাকিস্তানি কর্নেল বেগের চিঠি এর বড় প্রমাণ। চিঠিতে কর্নেল লিখেছিলেন, পাকিস্তান জিয়ার কাজকর্মে খুশি রয়েছে এবং ভবিষ্যতে তাকে আরও বড় দায়িত্ব দেয়া হবে।

অভিযোগ রয়েছে জিয়াও আগে আইএসআই কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বড় হয়েছেন পাকিস্তানে, তার বাবা-মার কবর পাকিস্তানে, তিনি বাংলার চেয়ে উর্দুই ভাল বলতে ও লিখতে পারতেন। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানিরা এমন অনেক সেনাকর্তাকে তাদের চর হিসেবে বাংলাদেশে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে কর্নেল ফারুক-রশিদও ছিল।

জিয়া যে পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে জড়িত থেকে ক্ষমতা জবর-দখলের পর। জিয়া-মোশতাকের প্রথম কাজই ছিল দেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা, যে কথা তখন পাকিস্তানের সব শীর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তারা মুক্তিযুদ্ধের সিগনেচার টিউন 'জয় বাংলা' ধ্বনিসহ সমস্ত বাংলা শব্দ যথা বাংলাদেশ বেতার, বিমান প্রভৃতি সরিয়ে ফেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের স্মৃতি মুছে দেয়ার জন্য যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছিল, যেখানে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ বিশ্বনন্দিত ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই উদ্যানের নাম এবং বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে দেয়, সেখান থেকে ইন্দিরা মঞ্চ ভেঙ্গে দেয়। জিয়া শুধু কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকেই প্রধানমন্ত্রী করেননি, তিনি আগরতলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান, সোলেমান, যাদু মিঞা, আলিমসহ সব মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের তার অবৈধ মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়। তার সাথে আরও ছিল শান্তিবাহিনীর দুই চেয়ারম্যান বিচারপতি সাত্তার এবং আব্দুর রহমান বিশ্বাস। জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ক্যাপ্টেন নুরুল হক তার বই 'হাই টাইড, হাই টাইমে' লিখেছেন- জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসাতে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। একই ধরনের কথা ব্যারিস্টার মওদুদও লিখেছেন। জিয়া ৭২-এর সংবিধান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাসহ মুক্তিযুদ্ধের সব বিধান মুছে ফেলেছিলেন, গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে এনে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। সুযোগ দিয়েছিলেন সম্পদের পাহাড় গড়ার। তার আমলে শীর্ষ রাজাকার শর্ষিনার পীরকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে কলঙ্ক রচনা হয়। পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার আঁতাতেও জিয়া লিপ্ত ছিলেন বলে সে সময়ে ভুট্টোর কথা থেকে আঁচ করা যায়, যে কথা পাকিস্তানি পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হয়েছিল।

যে লোক স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর সমস্ত স্বাধীনতাবিরোধী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে তিনি তিন বছর পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করার কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। জিয়ার পঁচাত্তরের পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকে নিরঙ্কুশভাবে যে সমীকরণে পৌঁছানো যায় তা হলো- তিনি পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হোক তা চাননি, পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে পাকিস্তানি চরের দায়িত্বে ছিলেন এবং দেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। যার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম ভূমিকায় ছিলেন বলে মনে করা হয়।

যে সব ব্যক্তি এবং দল বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিল, পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপক্ষে ছিল, সেসব দল যথা জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম এবং কট্টর চীনপন্থি লোকেরা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই জিয়াকে তাদের ত্রাণকর্তা মেনে তার ছায়ায় জড়ো হয়ে দেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। জিয়া ক্ষমতা দখলের পরই নতুন আনন্দধারা দেখা দেয় পাকিস্তানে, আইএসআই-এর লোকে ভরে যায় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চসহ অন্যান্য ভাষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়, 'জয় বাংলা'র পরিবর্তে পাকিস্তানি স্লোগান 'জিন্দাবাদ' প্রবর্তন করা হয়। পাকিস্তানিরা যে আমাদের দেশে দখলদার বাহিনী ছিল, সে কথা একবারও বলা হয়নি। আমাদের কাছে মাফ চাওয়ার দাবি, আমাদের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি, আমাদের দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে পাকিস্তান যে ক্ষতি করেছে, সে ক্ষতি পূরণ দেওয়ার দাবি এবং বিহারীদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জিয়া একটিবারও তোলেনি, অথচ বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পূর্বে এমনকি পঁচাত্তর সালেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে এসব দাবি তুলেছেন। ১৯৭৫-এর পরই এসব দাবি উধাও হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা টাকার অংক অপরিসীম।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার ভূমিকা

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যে সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা পর্যালোচনা করলে জিয়ার মুখ্য ভূমিকা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। জিয়া যে বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে ডালিম এবং নূর চৌধুরীর সাথে ছিলেন তা মামলার ৯ নং সাক্ষী কর্নেল আব্দুল হামিদের সাক্ষ্যতে পাওয়া যায়। তিনি সাক্ষ্যে বলেন, "১৪ অগাস্ট বিকেলে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের টেনিস কোর্টে চাকরিচ্যুত ডালিম এবং মেজর নূর কেন ঘোরাফেরা করছে, এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তারা বলেছিল জিয়ার অনুমতি নিয়েই তারা টেনিস কোর্টে এসেছে।"

৪৪ নং সাক্ষী কর্নেল শাফায়েত জামিল বলেছিলেন, তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর বাড়ি যাওয়ার পথে জিয়ার বাড়িতে নামলে জিয়া ইংরেজিতে বলে- "So what? President is killed, Vice President is there" জিয়ার এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার সে মোটেও অনুতপ্ত ছিল না।

৪৫ নং সাক্ষী হিসেবে জেনারেল শফিউল্লাহ বলেছিলেন, "জিয়া যখন অতি প্রত্যুষে তার বাড়ি আসে তখন সে ছিল পুরাপুরি শেভ করা এবং ইউনিফর্ম পরা, সেখানে খালেদ মোশাররফ সাহেব এসেছিল ঘুমের পোশাকে। জিয়া জেনারেল শফিউল্লাহকে বললেন- খালেদ মোশাররফকে যেন কোনো দায়িত্ব দেয়া না হয়। ১৯ তারিখে কর্নেল শাফায়েত জামিল জেনারেল শফিউল্লাহকে ইংরেজিতে বলেন- 'আপনার ডেপুটিকে (অর্থাৎ জিয়া) বিশ্বাস করবেন না। কারণ সেই সব কিছুর (হত্যাকাণ্ডের) পেছনে রয়েছে।' জেনারেল শফিউল্লাহ তখন কর্নেল সাফায়েত জামিলকে বললেন, 'এই কথাগুলি বলতে তোমার এত সময় লাগল?"

৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জেনারেল শফিউল্লাহ আরো বলেন, তিনি ১৮ অগাস্ট পর্যন্ত এক কাপড়ে বঙ্গভবনে থাকাকালীন জিয়া, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমানকে বঙ্গভবনে আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী বহু বছর পালিয়ে থাকা ক্যাপ্টেন মাজেদ ২০২০ সালে তার ফাঁসির পূর্বে মৃত্যু পূর্ব ঘোষণায় বলেছিল- হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূল ভূমিকায় ছিল জিয়া।

১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে কর্নেল ফারুক বলেছিল- জিয়া তাদের সাথে ছিল। তাছাড়া লন্ডনের এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ফারুক-রশিদ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে বলেছিল- তারা যখন জিয়াকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার কথা বলল, জিয়া তখন বলেছিল তোমরা চালিয়ে যাও।

জিয়ার তখন সরকারি দায়িত্ব ছিল ফারুক-রশিদকে পুলিশে দেওয়া। তা না করে জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যায় প্ররোচকের ভূমিকা নেয়। সেদিন জিয়া ফারুক-রশিদকে ধরিয়ে দিলে, তাদের কথা ফাঁস করে দিলে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো না। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার বই 'এক জেনারেলের নিরব সাক্ষ্য' পুস্তকে লিখেছেন- তিনি একদিন জিয়ার বাড়ি গিয়ে কর্নেল ফারুককে দেখে জিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন ফারুক তার বাড়িতে কেন? জিয়া কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

মোশতাক-জিয়া প্রত্যক্ষ সব খুনিকে পদোন্নতি দিয়ে, তাদের পক্ষে ইনডেমনিটি আইন করে এবং বিদেশি মিশনে লোভনীয় চাকরি দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা হত্যাকারীদের সাথে ছিল এবং তাদের বিচার হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে।

সুতরাং জামুকার সিদ্ধান্ত উভয় কারণেই যৌক্তিক। প্রথমত, জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন পাকিস্তানি চর। দ্বিতীয়ত, জাতির পিতার খুনি হিসেবেও তিনি এবং অন্যান্য খুনিরা রাষ্ট্রীয় খেতাব পেতে পারেন না।

আইন বলে, কোনো ব্যক্তি প্রতারণা করে বা সত্য গোপন করে কিছু পেলে, সে পাওয়া শুরু থেকেই অবৈধ। জিয়া-মোশতাকও তাদের আসল রূপ গোপন রেখে পদক-পদবি পেয়েছেন বলে তাও আইনের দৃষ্টিতে প্রথম থেকেই অবৈধ। তাছাড়া জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট বলে প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের প্রদান করা জিনিস ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতাও থাকে। ছিনিয়ে নেয়ার অনেক নজির পৃথিবীতে রয়েছে। পাকিস্তান সরকার বিচারপতি ইব্রাহিমকে দেওয়া খেতাব তুলে নিয়েছিল ইব্রাহিম সাহেব ৬ দফা সমর্থন করার কারণে। মিয়ানমার নেতা সুু চিকে দেওয়া বহু সম্মাননা পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

ক্লজেস অ্যাক্ট বলেই ব্রিটিশ রানি ঘোড়া রেইসের বিখ্যাত জকি লেস্টার পিগট, আর্ট অ্যাডভাইজার টনি ব্লান্ট, বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হামিদ নাসিম, টিভি উপস্থাপক ও ব্যক্তিত্ব রল্ফ হ্যারিসসহ বেশ কয়েকজনকে দেওয়া সম্মাননা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

জিয়াকে যখন দেশ মুক্ত হওয়ার পর পরই 'বীর উত্তম' দেওয়া হয় তখন সবকিছু জানার সুযোগ ছিল না। তখনও জিয়ার আসল রূপ জানা যায়নি, যেমনটি করা হয়েছিল সু চি-র বেলায়ও। তাছাড়া হেনরি কিসিঞ্জারকেও শান্তির জন্য নোবেল দেওয়া হয়েছিল, যে চিলি এবং ইন্দোনেশিয়ায় বহু হত্যার নেপথ্য নায়ক ছিল। ভুলে গেলে চলবে না, জিয়ার বিরুদ্ধে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগই নেই, পাশাপাশি অন্তত ১১ শ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগও রয়েছে। যার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করা।

কর্নেল ফারুক এবং রশিদও আমাদের মুক্তির মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিল, যা রেকর্ডেই পাওয়া যায়। সুতরাং তারাও যে এসেছিল পাকিস্তানি চর হিসেবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কর্নেল ফারুক তার জবানিতে বলেছে- সে বাংলা জানে না। তাই জামুকার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যৌক্তিক।