বাইশে শ্রাবণের এমন দিনে মহাপ্রয়াণ বর্ষাপ্রিয় কবিগুরুর

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 6 August 2012, 10:56 AM
Updated : 6 August 2012, 10:56 AM

আজ বাইশে শ্রাবণ কবিগুরুর ভাষাতেই বলতে ইচ্ছে –

এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় …
এমন দিনে তারে বলা যায় …
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় ।।

সে কথা শুনিবেনা কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর ।।

সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব –
আঁধারে মিশে গেছে আর সব ।।

বলিতে ব্যথিবেনা নিজ কান,
চমকি উঠিবেনা নিজ প্রাণ।
সে কথা আঁখিনীড়ে মিশিয়া যাবে ধীরে,
বাদলবায়ে তার অবসান –
সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ ।।

তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার !
শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার ।।

আছে তো তার পরে বারো মাস –
উঠিবে কত কথা, কত হাস।
আসিবে কত লোক, কত না দুখশোক,
জগত চলে যাবে বারোমাস ।।

ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
বিজুলি থেকে-থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেলো মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় ।।

১২৯৬ বঙ্গাব্দের ৩ জৈষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন গভীর বর্ষাকাব্য রচনা করেছেন, সুরও করেছেন, এমন বাণী আর সুরের গভীরতা কেবল হৃদি-অনুভবে, কেবল নিভৃত নির্জনে শুনিবার … যখন এ গান হৃদয় জুড়ে বাজে, বাজায় চারিধার … জগতে কেহ যেন নাহি আর … এমন অনুভুতি এমন ঘনঘোর বরিষা কবিগুরু ব্যতীত আর কারও পক্ষেই রচনা অসম্ভব … এ সত্য একান্তভাবেই বুঝি। আশ্চর্যের যা তা এই যে কবিগুরুর বর্ষাপ্রিয়তাই যেন তাঁর অন্তর্ধানেও আরও গভীরতর স্মরণার্হ করেই গেলো। সেদিন বাইশে শ্রাবনের দিন আকাশভর্তি সঘন মেঘের ভেঙে পড়ার কালে কোলকাতার সকল সড়কে 'তিল ঠাঁই আর নাহিরে' অবস্থায় সারি-সারি সজল মানুষের ঢল, শেষবারের মতো একনজর বিশ্বকবিকে দেখার জন্য, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করার জন্য কবিগুরুর 'ওগো আজ তোরা যাসনে, যাসনে ঘরের বাহিরে' অগ্রাহ্য করেই বেরিয়ে পড়েছে মানুষ, লাখো মানুষের যাত্রাটি ছিলো আশ্চর্য চুপ ও সজল। হ্যাঁ, সেদিন কোলকাতার এই মৌন-মিছিল-এর দৃশ্যটি ধারণ করেছে সমস্ত মিডিয়া।

আমি প্রথম কবিগুরুর এমন শ্রাবনদিনে মহাপ্রয়াণ-এর যাত্রাদৃশ্যের কথা পড়ি ১৯৬৯-এ বুদ্ধবেদ বসু-র "তিথিডোর" উপন্যাসে। আজও আমার বিষম প্রিয় উপন্যাস "তিথিডোর"। আজও ঘনঘোর শ্রাবণদিনে বইটি সযত্নে বুকশেলফ হতে নামাই, ধূলো ঝেড়েই পড়ি। বিশেষ করে কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের দিনটি ধারণ করার পাতাগুলি। সেদিন খবরটি জানা মাত্রই উপন্যাসের নায়ক সত্যেন রায় হন্তদন্ত-উশকোচুল-বেদনার্ত মুখেই কড়া নাড়ে উপন্যাসের নায়িকা স্বাতী-র দরোজায় –

" – 'কি? কী হয়েছে?'
শুকনো মুখ, উশকো চুল, চাপা ঠোঁট আর না কামানো গাল- এতদিনের মধ্যে কখনো স্বাতী দ্যাখেনি সত্যেন রায়ের এ-রকম চেহারা। আর কথা যখন বললেন, আওয়াজটাও অন্যরকম শোনালো – 'শোননি এখনো?'
– 'কী?'
সত্যেন চোখ তুললো স্বাতীর মুখে, চোখ নামালো মেঝেতে বললো – 'রবীন্দ্রনাথ -' আর বলতে পারলোনা।
সঙ্গে-সঙ্গে স্বাতীর মাথাও নিচু হলো, … স্তব্দ আনত, দুঃখের আরো গভীর সুষমা।
দু-জনে দাঁড়িয়ে থাকলো মুখোমুখি। কিন্তু মুখোমুখি না, কেননা দু-জনেই নিচু মাথা, আর দু-জনেই চুপ। একটু পরে সত্যেন চোখ তুললো, স্বাতী তা দেখলো না, কিন্তু সেও চোখ তুল্লো তখনই, প্রশ্নহীন শান্ততায় তাদের চোখাচোখি হলো। সত্যেন রায় বললেন – 'চলো'
– 'যাবো? কোথায়?'
– 'যাবে না একবার? দেখবে না?'
– 'নিশ্চয়ই !'
– 'চলো তাহলে'
– 'কিন্তু আপনি এখন – কোত্থেকে?'
– 'আমি ওখানেই – এখন আসতাম না – তোমার জন্য এলাম। তুমি-তো দ্যাখোনি কখনো – দেখলে না – তবু যদি শেষ একটু – '
সত্যেন রায়ের দাড়ি গজানো শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাতী বললো, – 'কিন্তু আপনার স্নান-খাওয়া বোধহয় – '
– 'ওসব এখন না,' ঈষত ভঙ্গি হলো সত্যেনের কাঁধে, ঈষত অসহিষ্ণুতার। – 'আর দেরী না। চলো!'
– ' আপনি একটু কিছু খেয়ে নিন, কিচ্ছু খাননি সকাল থেকে?'
– 'না, না!' একটু জোরেই বলে উঠলো সত্যেন। মনে-মনে একটু খারাপ লাগলো তার – যেন আঘাত লাগলো – আজকের দিনে, এরকম সময়ে এ সব তুচ্ছ খাওয়া-টাওয়া নিয়ে স্বাতীর এই ব্যস্ততায়। সকালে প্রথম চায়ের পরে এ পর্যন্ত কিছুই খায়নি, তা সত্যি, কিন্তু এখন তার ক্ষুধাবোধ একটুও ছিলোনা, ক্লান্তিও না, আর কোনো চেতনাই তার ছিলোনা দুঃখের চেতনা ছাড়া, মহৎ, মহামূল্য, তুলনাহীন দুঃখ, কল্পনায় চেনা, সম্ভাবনায় পুরনো, তবু বাস্তবে আশ্চর্য, আকস্মিকের মতো নতুন, অবিশাস্যের মতো অসহ্য। … সকালে গিয়ে যেই বুঝলো যে আজই শেষ, তখনই স্থির করলো শেষ পর্যন্ত থাকবে, তারপর কেমন করে কাটলো ঘন্টার পর ঘন্টা, ভিড় বাড়লো, জোড়াসাঁকোর বড়ো-বড়ো ঘর আর বারান্দা ভরে গেলো, উঠোনে আরো -, টেলিফোনে বসে গেঞ্জি গায়ে কে-একজন ঘামতে-ঘামতে খবর জানাচ্ছে চেঁচিয়ে, তাছাড়া চুপ, অত লোকের মধ্যে কারো মুখেই কথা নেই, চেনাশোনারা পরস্পরকে দেখতে পেয়ে কিছু বলছে না, নতুন যারা আসছে তারা কিছু জিগেস না-করেই বুঝে নিচ্ছে। অপেক্ষা, বোবা অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা – কিসের? … একবার, অনেকক্ষণ পর, একটু বসে ছিলো সে, বসে থাকতে-থাকতে হঠাত একটা শব্দ শুনলো – পাশের ঘর থেকে – অনেকক্ষণ চেপে রাখার পর বুকফাটা ঝাপ্টা দিয়েই থেমে যাবার মতো, আর সঙ্গে-সঙ্গে অনেকেই তাকালো হাতের, দেয়ালের ঘড়ির দিকে, বারোটা বেজে কত মিনিট কী-যেন ফিশফিশানি উঠলো। খানিক পরে যখন একবার করে ঘরে যাবার অনুমতি দিলো সবাইকে – সেও গেলো। মাথাটি মনে হলো আগের চেয়েও বড়ো, প্রকান্ড, কিন্তু শরীরটি একটু-যেন ছোট হয়ে গেছে, যদিও তেমনি চওড়া কব্জির হাড়, তেমনি জোরালো, প্রচন্ড আঙুল। শেষবার সে চোখ রাখলো তার কতকালের চেনা সেই মুখের, মাথার, কপালের দিকে, মহিমার দিকে, একবার হাত রাখলো হিমঠান্ডা পায়ে। … আর সেই মুহূর্তটি যেই মনে পড়লো সত্যেনের, যেই দেখতে পেলো মনের চোখে আবার সেই প্রকান্ড মাথার ক্লান্ত নুয়ে পড়া, অমনি তার বুক ঠেলে একটা গরম শিরশিরানি উঠলো, মুখ ফিরিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি। মুহূর্তের চেষ্টায় আত্মস্থ হয়ে নিয়ে আবছা একটু হাসির ধরনে বললো – 'আচ্ছা, জল দাও এক গ্লাশ।'
… সত্যেন বল্লো – 'তাহলে তুমি বরং থাকো। কিন্তু আমি আর থাকতে পারছি না।'

স্বাতী তক্ষুনি বল্লো – 'না, আমিও যাবো।'

… নামমাত্র ফুটপাতে গায়ে-গায়ে ধাক্কা বাঁচিয়ে দ্রুতনিঃশব্দে হাঁটতে লাগলো দু-জনে। … কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের ছাতে ঢাকা ফুটপাতে সত্যেন দাঁড়ালো, একটা জুতো-দোকানের সিঁড়িতে উঠলো। আরো অনেকে দাঁড়িয়েছে সেখানে, বেশির ভাগ কলেজের ছাত্র। মুখে-মুখে শোনা গেলো, এক্ষুনি এসে পড়বে।

সত্যেন বল্লো – 'কষ্ট হলো তোমার হাঁটতে?'

– ন-না।'
– 'মনে হচ্ছে কি না এলেই পারতে?'
– 'না।'

কথা ফুরোলো ওখানেই, আবার দু-জনে চুপ। উলটো দিকে একটা একতলা দোকানঘরের কার্নিশছাড়া বিপজ্জনক ছাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরা তাক করে। পাশের দোতলার বারান্দায় মেয়েদের, বাচ্চাদের ভিড়, আশে-পাশে একটা জানালা নেই যেখানে তিন-চারটি করে না বেরিয়ে আছে, আর রাস্তায় কেউ চলছে না, সকলেই দাঁড়িয়ে। সত্যেন অনুভব করলো মনের উপর সেই অপেক্ষার, বোবা অপেক্ষার চাপ।

'আসছে … আসছে …' গুঞ্জন রব উঠলো ভিড়ের মধ্যে।

স্বাতী মনে-মনে ভাবছিলো লম্বা গম্ভীর আনত আচ্ছন্ন স্তব্ধ মন্থর মিছিল, কিন্তু মাত্রই কয়েকজন যেন অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এলো কাঁধে করে – নিয়ে গেলো উত্তর থেকে দক্ষিণে – পিছনে এলোমেলো লোক – বিদ্যুতের ঝিলিক দিলো লম্বা শাদা চুল আর মস্ত শাদা শান্ত তন্ময় কপাল। ঐটুকু দেখলো স্বাতী, আর দেখতে পেলো না।

সত্যেন দেখলো, স্বাতী দাঁড়িয়ে আছে শক্ত সোজা হয়ে, হাত মুঠ করে, ঠোঁটে ঠোঁট চাপা, দেখলো তার কন্ঠের কাঁপুনি, ঠোঁটের কাঁপুনি, গালের ঘন রঙ, দেখলো তার তরল কালো উজ্জ্বল চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল হলো, ঝকখকে দুটি আয়না হয়ে উঠলো, তারপর ভাঙলো আয়না, আবার তরল হলো, উপচালো, মাথা নিচু হলো।

আর তা-ই দেখে সত্যেনের নতুন করে গলা আটকালো, চোখ ঝাপসালো, আর সেজন্য লজ্জা করলো নিজের কাছেই। এ মৃত্যু তো কান্না চায়না, এই দুঃখ মহান, মহামূল্য দুঃখ, আশি বছরের পরম পরিশ্রমের এই সবশেষের রত্ন – এ কি চোখের জলে বাজে খরচ করবার?

বুদ্ধদেব বসু-র এই অসাধারণ কালোত্তীর্ণ লেখায় এভাবেই কবিগুরুর মহাপ্রয়ানের চিত্রটি ধরা। প্রতিবারের বাইশে শ্রাবনে আমি এই অধ্যায়খানা পড়ি আর দেখতে পাই সেদিনকার সেই অন্তিমযাত্রার সজল চিত্রায়ন, বিশাল উপন্যাস, তারই একাংশে কবিগুরুর মহাপ্রয়ানের দিনটি ধরা। আজ তারই সংক্ষেপিত অংশ লিখতে-লিখতে তাঁর সে অন্তিমযাত্রা অামায় অাবারও বাইশে শ্রাবণ দিনটি মনে পড়িয়ে দিলো। কবিগুরুকে হৃদয়জ প্রণতি।

২২শে শ্রাবণ। ১৪২১ বঙ্গাব্দ।