যখন রইবে না এই জীবন-জগত সকল খেলার বিধূর দিন

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 10 August 2012, 02:04 PM
Updated : 10 August 2012, 02:04 PM

 
বাংলার পল্লীকবি জসীম উদ্দীন-এর কবিতায় প্রথম পড়ি নকশিকাঁথা জুড়ে বর্ণিত নকশী জীবনগাঁথা। কি যে ভালোলাগায় বুঁদ হয়েছিলাম বহুদিন … ঘুরেফিরেই আবারও পড়েছি … আপ্লুত হয়েছি তার কোনও হিসেবই রাখিনি। এখনও সেসব অপরূপ কাহিনী আমায় বিষম টানে … সময় পেলেই "নকশিকাঁথার মাঠ" কিংবা "সোজন বাদিয়ার ঘাট" পড়তে বসি … সোজন-দুলির বেদনাগাথা কবিতায় কে আর লিখেছেন এমন ছন্দিত হৃদয়গ্রাহী … আমি জানিনা। জসীম উদ্দিন আশ্চর্য সরল দারুণ ছন্দে লিখতে জানতেন বাংলার চিরন্তন জীবনযাত্রার কাহিনী। তিনি ব্যতীত আর কোনও কবি এমন কাজ রেখে যাননি। যা হৃদয় ভাসিয়ে দেয় আজও অম্লান গাঁয়ের পদ্যময় গল্পের চিত্রকলার সহজ করে লেখার অসাধারণ শৈলীতে। তাই জসীম উদ্দীন তুলনাহীন।

আদতে সেই কালে বাংলার মা-বউঝিরা আজকের যুগের আধুনিক জীবনযাত্রার কিছুই না দেখেই তাদের অবকাশে উঠোনে পুরনো কাপড় পেতে বসতেন। এবঙ সুখদুঃখের গালগল্পের ফাঁকে-ফাঁকেই সূঁচ-সূতোর নিখুঁত ফোঁড়ের মধ্য দিয়েই আঁকতেন নিজের জীবনের আনন্দ-বেদনাচিত্রন। আর তাদের সেই জীবনগাঁথা পল্লীকবির হাতে পেয়েছে প্রাণ। আশ্চর্য প্রাঞ্জল ভাষায়-ভাবে বর্ণিল হয়ে উঠেছে বাংলার পল্লীর প্রেমময় জীবনগাথা কবির লেখনীতে। এমনতর আর কেউ-ই আজ পর্যন্ত লেখেননি।

বাংলার সেকালের সেই নকশিকাঁথা কিন্তু আজ ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক আয়ের উতস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবঙ দেশ-বিদেশে বাংলার এক ঐতিহ্যগত শিল্প হিসেবে সমাদৃত। বাংলার এই ঐতিহ্য আজ নিপুণ এক শিল্পিত বিপনন রূপেই ছড়িয়ে পড়েছে সকল বড় বিপনি থেকে ফুটপাথের বাণিজ্যেও। এ যেন মা-বউঝিয়ের একদা অবকাশের কাজের বিশাল কর্মযোগ-এর স্বীকৃতি। তাঁরা তাঁদের অনন্য কাজের স্বীকৃতির ফলেই জীবিকা অর্জনের একটি পথ খুঁজে পেয়েছেন। গ্রামগঞ্জের হাজার-হাজার নারীরা এখন নকশিকাঁথা বুনেই আয়ের উপায় করে নিচ্ছেন। রাজধানী ঢাকার পথে বেরুলে কোনও না কোনও কোণে বাহারি রঙের অপূর্ব ঠাসবুনটের ঝুলন্ত নকশিকাঁথা নজর কাড়ে। অনেকবার আমি আড়ং-এর নয় ফুটপাথের নকশিকাঁথাই কিনে মহানন্দে বাড়ি ফিরেছি। বিছানায় অনন্য নকশিকাঁথার কারুকাজ বিছিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। এ মুগ্ধতা আমায় নিয়ে যায় প্ললীকবির অসামান্য গাঁথায়। আমি আবার এবঙ বারংবার পড়ি তাঁরই চিরন্তন "নকশিকাঁথার মাঠ"। কোনওদিন পড়ি "সোজন বাদিয়ার ঘাট"। পল্লীকবির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হই হাজার বার। হাজার বর্ণমালা ছন্দিত ঝঙ্কারে তাঁর-ই কথা বিষম মনে পড়িয়ে দেয়।

আজও বেশ মনে আছে আমি তখন কুমিল্লা মহাবিদ্যালয়ের বাংলা ডিপার্টমেন্ট-এ সদ্য ভর্তি হয়েছি। সে সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ বাংলা ডিপার্ট্মেমেন্টে-এর উদ্বোধনী এবঙ নবীন-বরণ অনুষ্ঠানে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন-কে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আমাকে দেয়া হয় কবির জন্য একটি স্বরচিত কবিতা উতসর্গ করতে। এবঙ সেটি পাঠও করে শোনাতে হবে অনুষ্ঠানের দিন। তো, আমি বিস্তর মনোযোগেইভেবেচিন্তে একটি উতসর্গ কবিতা লিখি। এবঙ অই অনুষ্ঠানে লালপাড়-হলুদ-শাড়ি-লালটিপ পরেই দুরুদুরু হৃদয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়ে শোনাই। কি আশ্চর্য স্বয়ং পল্লীকবি জসীম উদ্দীন নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে আমায় প্রাণিত করতেই নিজেও বিষম আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তার পরের দিন কলেজ কর্তৃপক্ষ-র কবির সন্মানে আয়োজিত পিকনিক-এ ছাত্রী আর শিক্ষকদের সঙ্গে কবি-ই ছিলেন অনন্য মধ্যমনি। অত্যন্ত আনন্দময় একটি দিন কাটিয়েছি আমরা সেদিন কবির সঙ্গে। এবঙ মহা হৈ-হৈ-রৈ-রৈ আনন্দ-পিকনিক-এর খাওয়াদাওয়ার পালা সাঙ্গ হতেই কবির সঙ্গে কোটবাড়ি-ময়নামতি-শালবনবিহার ঘুরে বেড়ানো … আহ কি যে রোমাঞ্চ জাগানিয়া প্রহর … ফিরে আর আসবেনা কোনওদিন … তবু স্মৃতিরা অমলিন …। বাংলার পল্লীকবির জন্য চির-শ্রদ্ধার্ঘ্য সততঃ।

যখন রইবেনা এই জীবন-জগত সকল খেলার বিধূর দিন, জানিনা, তখনও হঠাত কেউ জীর্ণ পাতার ভাঁজ খুলে সেসব পড়তে বসবে কি না, জানিনা তখনও বেঁচে রবে কি রবেনা নকশিগাঁথা বাংলার।

২৬ শ্রাবন। ১৪২১ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।