রক্তজলের ১৫ অগাস্ট যদি না আসতো বাংলায়

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 13 August 2012, 10:22 AM
Updated : 13 August 2012, 10:22 AM

লোকে বলে তেরো তারিখ নাকি অপয়া। বিশ্বে তেরো তারিখ "আনলাকি থার্টিন" হিসেবেই বেশিরভাগ মানুষ ধারণা করে। আসলে এই "আনলাকি থার্টিন" বিশ্বে অনেক দুর্ঘটনার শিকার বানিয়েছে অনেক মানুষকে, বিধ্বংসী বিমান দুর্ঘটনাও ঘটেছে। যে কারণে বহুজন-ই তেরো তারিখ অনেকরকম সতর্কতা অবলম্বন করে। এবঙ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। এ দিনে কিছুতেই কোনও শুভকাজ-এর তারিখ যাতে না হয় সেই বিষয়ে সচেতন থেকেই তের তারিখ বাদ দিতেই বদ্ধপরিকর থাকতে ভালোবাসে অনেকে। কিন্তু জানিনা, বঙ্গবন্ধু কেন যে ১৩ আগস্ট একটুও টেরই পেলেন না কি ভয়ঙ্কর অশনি রক্তচক্ষু-দানব-এর বেগেই তাঁকে সপরিবারে রক্তগঙ্গায় ডুবিয়ে দিতেই ধেয়ে আসছে …! আহ, দেশ-বিদেশ-এর গোয়েন্দা সংস্থা বারংবার বঙ্গবন্ধুকে সেই অশনিবার্তা সম্পর্কে সঙ্কেত দিয়েছিলো … অথচ বিশাল-হৃদয় বঙ্গবন্ধু হেসেই উড়িয়েছেন – "আমার মানুষ আমাকে মারবেনা" এমন ধারণার জানান দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। অথচ তাঁর বিশাল হৃদয়ের ভালোবাসার যোগ্য ছিলোনা তাঁর চারপাশের অনেকেই … সে সত্য তিনি বুঝলেন না …! আমি জানিনা, তের তারিখ কতটা অপয়া, কিন্তু অগাস্ট-এর ১৫ তারিখ বাংলাদেশের এক চরমতম অপয়া তারিখ মনে করি। অগাস্ট মাসটিকেই আমার বড়ো অপয়া মনে হয়। ১৫ অগাস্ট-এর "পাকিস্তান" নামের রাষ্ট্রজন্ম, যে রাষ্ট্র এক যোজন ফারাকসম অশুভ জন্ম, ২১ অগাস্ট-এর ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা এবঙ তার অশুভ চক্রান্তের জের সব-ই বড়ো রক্তক্ষরা স্মৃতির ।

আজও ভুলি নাই, সেদিন ভোরের প্রথম বার্তা, কি কালরাত্রিমাখা বজ্রাঘাত যেন বা সত্য নয়, বিষম দুঃস্বপ্ন মাত্র, অথচ দুঃস্বপ্ন নয়। ভোরের রেডিও বারংবার প্রচার করছিলো চরমতম দুঃসংবাদ। আমার তবু বিশ্বাস হচ্ছিলোনা, যেন বা এখনই আবার সংবাদটি সত্য নয় এই সুসংবাদ প্রচার শুরু হবে, কিন্তু না, সুসংবাদ আসেনি আর, বিশ্বাস করতেই হয়েছে ভয়ঙ্কর বার্তাটি অবশেষে। সেদিন আমাদের শহর কুমিল্লায় হঠাত সেই একাত্তুরের কালরাত্রিময় অবস্থা নেমেছিলো। সবার চোখমুখে আতঙ্ক। নরঘাতক-মীরজাফরগঙ আবার কি না কি রক্তগঙ্গায় ভাসায় বাংলাদেশ …! আবার সেই জগদ্দল পাথরসম সামরিক-শাসন-এর কব্জায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। অই কব্জায় অই নীলনক্সায় মীরজাফররা পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ইতিহাসের আরও একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সবচে' ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতাকে কারাভ্যন্তরে হত্যাকান্ডের মাধমে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে বাংলাদেশ-এর জাতীয় চেতনার ধারাকে। সে যে আদতে অসম্ভব, তখন ঘাতক দলের ধারণাতে ছিলোনা। যদিও কঠোর বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনের বদৌলতে অনেক কাল কেবল বাহ্যিকভাবেই চুপ করিয়ে রেখেছে জাতীয় চেতনার উত্তরসুরিদের। বিচারের বাণীটি নিরবে-নিভৃতে কেঁদে ফিরেছে বাংলার বাতাসে-বাতাসে আর অসংখ্য চেতনায়। ঘাতকদল ভুলেও ভাবেনি একদিন বাংলায় তাদের জঘন্যতম অপরাধের কঠিনতম শাস্তিবিধান হবেই। অবশেষে এসেছে সেই দিন, কেবল স্বপন্দ্রষ্টা নেতাই নেই। আহারে, ১৫ অগাস্ট যদি বাংলাদেশে না আসতো সেদিন ! যদি বঙ্গবন্ধু আজও বেঁচে থাকতেন ! বাংলাদেশ হয়তো স্বপ্নের আকাশটা ছুঁয়েই দিতো এ্যাদ্দিনে ! এই ভাবনা আমায় অগাস্ট এলেই বিষম পেয়ে বসে ! আমার সকল শব্দের সাধ আর সাধনা দিয়ে জাতির পিতার অস্তিত্ত্ব টের পেতে চাই রক্তের গভীরতম সঞ্চালনের শিরা-উপশিরা-ধমনী জুড়ে শিকড়সম চেতনায়। আমার সকল বেদনাজাত ঊপলব্ধি আমায় বলে – "জাগো ও জাগাও শিকড়-এর অজর-মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনা …" আমি লিখতে চাই … জেগেও উঠি … এবঙ জাগাতেও চাই … ভাবতে চাই জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশটি বিশ্বময় অর্জন-এর সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল একটি দেশ হয়েই চিরজীবি হউক … কোনও ষড়জাল কোনওদিন আর তাকে ক্ষতবিক্ষত না করুক। আহ, আমায় আবারও রক্তজলের ১৫ অগাস্ট তার অপয়া-রক্তাক্ত-নখর প্রদর্শন করছে … তবু আমি ভাবছি – আহ, আজও বঙ্গবন্ধু বেঁচেই থাকতেন যদি … হয়তো "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" তাঁরই স্বহস্তে লিখিত দলিলের উজ্জ্বল সমাপ্তি টানতো … জাতি পড়তে পেতো দেখতে পেতো অনন্য-অসাধারণ নেতার ব্জ্র-নির্দেশনায় চালিত স্বপ্নের বাংলাদেশ হাঁটছে সম্ভাবনার পথেই … আহ, "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" পড়তে-পড়তে আমি কান্নার আগুনে পুড়তে থাকি … কান্নার আগুনে পুড়তে থাকি …

শব্দরা আমায় লেখায় –

কান পেতে আজ শোনার দিন –
বীর বাঙালির জয়োধ্বনি –
শ্ত্রুবুকে ভয়ধরানি –
বাংলাদেশের বজ্রবীন।
জীবনবাজি জয়বাংলা।
জলেস্থলে মুক্তিকামী জয়বাংলা।
রক্তময় জয়বাংলা .. জয়বাংলা ..
রাত্রিদিন .. রাত্রিদিন।

ঘাতকরা জানেনি, জানেনা
অবিনাশি পিতৃঋণ খুন করা যায়না, যাবেনা।

কান পেতে আজ শোনার দিন –
রক্তমাখা বজ্রবীণ।
স্বপ্নজয়ী পিতৃঋণ ..
পিতৃঋণ .. পিতৃঋণ।