আজ ২৫ সেপ্টেম্বর একটি ঐতিহাসিক তারিখ

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 25 Sept 2012, 01:00 PM
Updated : 25 Sept 2012, 01:00 PM

১৯৭৪-এ ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘ-র সাধারণ পরিষদের সর্বসন্মোত অনুমোদন পেয়ে জাতিসঙ্ঘ-র সদস্যপদ প্রাপ্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই জাতিসঙ্ঘ-র ২৯ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়। এবঙ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সচেতন-সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেন নিজেই, যে তিনি জাতিসঙ্ঘ-র সাধারণ পরিষদের সদ্য-সদস্যপ্রাপ্ত একটি নতুন দেশের বাঙালি প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় ভাষণ দেবেন। বাংলাদেশ তখনও একটি সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতির প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু বাঙালি নেতার নামটি বিশ্ব ভালোই জানে, জানে যে বাংলাদেশ মানেই একজন সংগ্রামী নেতার ইমেজ, যিনি নিজের দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে বলিষ্ঠ-সঠিক দিকনির্দেশনায় স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন এবঙ যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে পরিচালিত করেছেন, দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যে কারণে অধিবেশনে সদস্য সকল দেশের প্রধানরা বাঙালি এই মহান নেতাকে দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন। জাতিসঙ্ঘ-র অধিবেশন কক্ষটি ছিলো সম্পূর্ণ ভর্তি। যা এক বিরল ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু তখন যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরেই ভাষণ তৈরীর জন্য তাজউদ্দীন আহমদ-এর পরামর্শ নিয়েই তৈরী করার নির্দেশ দিতেন। ভাষণটি লেখার কাজ করেছিলেন খ্যাতিমান কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী। ভাষণের ইংরেজী অনুবাদ পড়েন কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী। তখন বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীদের মধ্যে বর্তমানের আওয়ামী লীগ-এর অভিজ্ঞ-বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমদ ছিলেন তরুণ পলিটিক্যাল সেক্রেটারী। আজও তোফায়েল আহমদ তা নিয়ে গর্বভরে স্মৃতিচারণা করতে ভালোবাসেন। সে সময় জাতিসঙ্ঘ-র দাফতরিক ভাষার মধ্যে ছয়টি মাত্র ভাষার স্বীকৃত অনুমোদন ছিলো। বঙ্গবন্ধুকে তাই ইংরেজীতে ভাষণ দানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিলো। মহান বাঙালি নেতার কাছে তখন তাঁর মাতৃভাষাকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপনের সুযোগ কাজে লাগানো শ্রেয় মনে হওয়াতেই তিনি সেদিন বিশ্বনেতাদের সামনে বাংলায় ভাষণ দেয়ার একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন। এবঙ সেটি সেদিন জাতিসংঘ-র অধিবেশনে বিকেল চারটায় কালোরঙ গলাবন্ধ কোটের সঙ্গে কালো ফ্রেমের চশমা ও ব্যাকব্রাশ করা চুলের অধিকারী দীর্ঘকায়-সুদর্শন-স্মার্ট আভিজাত্যময় ব্যক্তিত্ব মহান বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভরাট কন্ঠে পাঠ করেন পিনপতন নীরবতায়। ভাষণ শেষে ইংরেজীতে পাঠের পরেই সকলের তুমুল প্রশংসা অর্জন করে বাংলাদেশের ইমেজ শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর বাংলা সাধুভাষায় রচিত ভাষণ-এর বক্তব্য আজ ২০১২-র ২৫ সেপ্টেম্বরে তরুণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি –

আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচিবার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসঙ্ঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ-লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আর সে জন্যই জন্মলগ্ন হইতেই বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত জনতার পাশে দাঁড়াইয়া আসিতেছে। একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপর দিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সঙ্কটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবঙ আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবঙ ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্রের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবঙ আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ন সম্ভব করিয়া তুলিবে। বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে। কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে সক্ষম করিয়া তুলিবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশের শান্তির কাঠামো এবঙ স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সঙ্ঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগীতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবঙ অন্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলের এবঙ বিশ্বশান্তির অন্বেষায় সকল উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে। জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবঙ অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখভোগ করিতে পারি। কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভর হওয়া। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবঙ সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইবো।

বঙ্গবন্ধুর এই অভূত সুন্দর ভাষণ-এর পরপর-ই জাতিসঙ্ঘ-র সাধারণ পরিষদের সভাপতি সহ অন্যান্য দেশের সদস্যগণ উঠে দাঁড়িয়ে তুমুল করতালিতে তাঁকে অভিনন্দিত করেন এবঙ জাতিসঙ্ঘ-র ততকালীন মহাসচিব ভাষণ-এর প্রশংসা করে বলেছিলেন – "বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। তাঁর দেয়া ভাষণটি সহজ, গঠনমূলক ও অর্থবহ।" অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা শুধু অভিনন্দিত করা নয়, বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করেন। তাঁরা বলেন – "বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশ-এর নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতাও তিনি।" জাতিসঙ্ঘ-র বুলেটিনেও একইরকম প্রশংসার শিরোনাম ছিলো – "কিংবদন্তীর নায়ক মুজিব"।

তাতে লিখিত হয়েছিলো – "অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলা অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের নেতা মুজিব তাঁর বক্তব্যে সেটি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।" বিশ্লেষণধর্মী লেখাটিতে বঙ্গবন্ধুকে "ক্রিয়েটর অব আ নিউ নেশন" হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।

আদতেই কতটা দূরদর্শী সম্পন্ন নেতা হলে এমন সচেতনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত মতোই বাংলায় জাতিসঙ্ঘ-র প্রথম সদস্যপদ পেয়েই সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিজের দেশের মাতৃভাষাকে তুলে ধরার ক্ষমতা ধরেন আজ এই সত্যটি বাংলাদেশের সকলের বিশেষভাবে অনুধাবনের বিষয় মনে করি। আজকের ২০১২-র ২৫ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘে আছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা করবেন। পিতার সেই প্রথম ভাষণটি কিন্তু আজও অতিক্রম করার ক্ষমতাও কারও পক্ষেই সম্ভব না। মহান বাঙালি নেতার সেদিনের সেই ভাষণ আজও সমসাময়িকতায় এক গুরুত্বপূর্ণ আর কালোত্তীর্ণ ভাষণ শুধু না, উপলব্ধিরও বিষয়।