“বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?”- যে কবি বাতাসে প্রথম প্রশ্ন উড়িয়েছেন

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 24 Oct 2012, 05:04 PM
Updated : 24 Oct 2012, 05:04 PM

"সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই" …(সুনীল গাঙ্গুলী ইজ নো মোর) …
সংবাদটি শোনামাত্র প্রথম যে কথাটি হৃদয় জুড়ে হাহাকারের মতো বাজলো, তা এই যে – বাংলাদেশ একজন পরম সুহৃদ হারালো। যিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথিতযশা কবি-ঔপন্যাসিক-কলামিস্ট এবঙ প্রণিধানযোগ্য ব্যাক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্য আমৃত্যু বন্ধুসুলভ আচরণ ও উচ্চারণে একান্ত নির্ভেজাল ছিলেন। তাঁর শিকড় কিন্তু বাংলাদেশে। এদেশে ছিলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তিন পুরুষের বসতি। তিনি বিষম ভালোবাসতেন বাংলাদেশ। তাইতো যে কোনও আমন্ত্রণেই ছুটে আসতে দ্বিধা করতেন না। সর্বশেষ তাঁর যে উচ্চারণটি পশ্চিমবঙ্গ হতে বাংলাদেশের জন্যই করা – তা ছিলো –

"বাংলাদেশ যা চায় তা-ই দেওয়া উচিত"।

এই উচ্চারণটি ছিলো পানির হিস্যা এবঙ তিস্তা বাঁধের ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জীর বাংলাদেশ সম্পর্কিত অনড় অবস্থান সম্পর্কে। পশ্চিমবঙ্গের আর কোনও ব্যাক্তিত্বের কাছেই এমনটি বাংলাদেশ পায়নি। পাবেনা আর। পরম সুহৃদ যে একাকী দোসরবিহীন সকল ফেলেই চলে গেছেন না ফেরার চির-ঘুমের দেশে।

জানিনা, সেইখানে কবির অধরা – "নীরা" – কি অশরীরি কবির পাশে দুদন্ড বসে চোখের জলে ভেসেই শেষ ভালোবাসায় কবিকে ভাসাবে কি না ! জানিনা, চলে যাওয়া প্রিয় কবির দল কবিকে ঘিরে ধরবে কি না ! জানিনা, কবির সকল প্রিয় ইচ্ছেরা সেথায় উড়বে কি না ! জানিনা, "পূর্ব-পশ্চিম" হতে – "সেই-সময়" -এর মায়াবি চরিত্ররা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেপুরাণ হয়ে শিথান-পৈথানে যাদুর সেই সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়ে বাঁচাবে কি না ! কেবল একঝাঁক শূণ্যের অবসাদ আমায় জেঁকে ধরেছে তাঁর অন্তর্ধানের কথাটি লিখতে বসে। অথচ তাঁর সঙ্গেতো সরাসরি কথাও হয়নি জীবনে। শুধু পড়েছি তাঁর অজস্র লেখা …অজস্র গল্প-কবিতা-উপন্যাস-সাক্ষাতকার …

"পূর্ব পশ্চিম" উপন্যাসটি প্রথম ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছে "দেশ" পত্রিকায়। তখন "দেশ" পত্রিকা বাংলাদেশে আসতো, তবে অনেক বিলম্বিত অপেক্ষা শেষে। অনেক অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি শুধু উপন্যাসের পরবর্তী অধ্যায়টুকু পাঠের জন্য। দুইবাংলার এক আশ্চর্য সময় ধারণকৃত উপন্যাস। প্রতিটি চরিত্র আশ্চর্যরকম জীবন্ত। যেন কাছের যত মানুষ আর তাদের সুখ-বেদনা-অন্তর্গত দহন-এর একইরকম প্রকাশভঙ্গি। এতো অনন্য উপাখ্যান কমই রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। বাংলাদেশের রাজনীতি, উত্তাল সময়, বঙ্গবন্ধুও যথাযথভাবেই ধরা।

এবঙ – "সেই সময়" সেও একটি ততোধিক বিস্ময়াভিভূত সময়-এর চরিত্রগুলো ধারণ করেই তুলে এনেছে পাপ-পূণ্যের যুগল-সন্মিলনের উপাখ্যান। পড়তে-পড়তে দুচোখ আঠা। আজও মাঝেমাঝে পড়তে বসি। এবঙ বিস্ময়াভিভূত হই।

তাঁর প্রথম কবিতার বইটি আমায় দিয়েছিলেন আমারই অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তিত্ব – বেলাল চৌধুরী, বড়চাচা আমার। আমি তখন সদ্য কলেজ ছাত্রী। "আমার স্বপ্ন" নামের একখানা দারুণ প্রচ্ছদের নতুন গন্ধমাখা উজ্জ্বল পঙক্তিভর্তি কবিতাবই। দেখি – কবির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উতসর্গের পাতায় রয়েছে –

"প্রিয় বন্ধু বেলাল চৌধুরী, সুব্রত রুদ্র ও দেবারতি মিত্রকে -"

একজন নতুন কবি তাঁরই তিন প্রিয় বন্ধুকে প্রথম কবিতার বইটি উতসর্গ করেছেন। এবঙ আশ্চর্যের এই যে – কবির নিজের হাতে উতসর্গিত সই করা বইটি বড়চাচা নিজের প্রিয় ভাইঝি – যে কি না কবিতাপ্রিয় জেনেই – তার হাতেই গচ্ছিত রাখলেন … – আজও সেই "আমার স্বপ্ন" কবিতাবই আমার স্বপ্নের মতো – আমার অনেক পুরনো প্রিয় বইয়ের সারিতে সারি-সারি চলে যাওয়া জীবনের সনেই ঠাঁই পেয়েছে। আমার যাবার পরে কেউ কি যত্নআত্তি করবে তার ! তেমন করে কে আর ভালোবাসে কবি ও কবিতারে ! আজতো এতই ছুটন্ত সময় যে – কবিতা পড়ার প্রহর আদৌ আসেনা …আসেইনা আগের মতো ! তথাপি কবিরা বেজায় ব্যাস্ত ! কত কি সংঘের ধুম ! সেথায় অকবিতা বিস্তর আড্ডায় ঘুমোয় ! আমারও তাইতো কবিতাবিমুখ অজস্র অসুখ – কেবলই আমার মুখ ফিরিয়ে দেয় ক্ষুধার রাজ্যে জ্বলন্ত গদ্যময় বাতাসে।

তবুও আজ কবির কথা বড়ো বেদনা জাগানিয়া পঙক্তিঘোর আমায় কাঁদিয়ে দিচ্ছে বারংবার। বারংবার সে এসে শুধিয়েই মরছে –

"বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?"

"বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?"

এমন আশ্চর্য প্রশ্নটি দিবানিশি হৃদয় জুড়ে ঘুরে-ঘুরেই শুধিয়েছে আমায় –

"বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?"

জবাব পাইনি আজও। প্রশ্নটির আদতে জবাব হয়না। সেতো সুন্দর একটি প্রশ্নই রচে কেবল বাতাসে-বাতাসে। সুন্দরের খোঁজেই সেই প্রশ্নটি আমৃত্যু উড্ডীন। সেইসঙ্গে আমার কেবলই হৃদয় জুড়েই আরও এক অভিজ্ঞা – কেউ কথা রাখেনা …কবিও না …ক্যামন আচমকা কোনও বলা নেই কওয়া নেই এমন শোকাহত হাহাকারেই অগণিত কবিতা ফেলে অনুরক্তের দল ফেলেই অন্তিমযাত্রায় চলে যাওয়া…প্রশ্নহীন …কোথায় কোন অচিনপুরে !

তাঁর মহাপ্রয়ানযাত্রা শুনে তাঁরই প্রিয় বন্ধুও (বেলাল চৌধুরী) যাত্রা দিয়েছিলেন কোলকাতার পথে। আমার সঙ্গে ফোনেই কথা হয়েছে, বলেছি – আমিও শোকাহত – লিখছি তাঁকে নিয়েই –

চির-শ্রদ্ধাঞ্জলি কবির তরে। প্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আপনিও অনেক দূরের স্মৃতির মানুষের দলেই চলে গেলেন। সেথায় আপনি চিরশান্তিলাভ করুন । পরম করুণাময়ের নিকট আমার প্রার্থনা এই।

ঢাকা। বাংলাদেশ।