জনম জনমের লিপিকাখানি জানি জীবনপুঁথি হবে একদিন

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 31 Oct 2012, 02:55 PM
Updated : 31 Oct 2012, 02:55 PM

জগন্ময় মিত্রের গান আমার খুব প্রিয়। প্রাচীন ঘরানায় গাইবার এমন দরদভর্তি কন্ঠমাধুর্য্য কিন্তু বিরল আজকাল। তিনি যে তাঁর জীবনসঙ্গী চলে যাবার পরে নিজের কথা নিজের সুরে গেয়েছিলেন –

"তুমি আজ কত দূরে …"

গানের মাঝে স্বকন্ঠে কথাও রেকর্ডকৃত –

" যত লিখে যাই লেখা না ফুরোয় ……………"

সে গান সে কথামালা আজও একইরকম জীবনীয়া বেদনাগাথায় আপ্লুত করে হৃদয়। সদ্য স্বজন-প্রিয়জন হারানো একজন একটি গানের সুরবাণীতে সবার কাছেই আদরণীয় হয়ে ওঠার একটাই কারণ – অসীম দরদ জাগানিয়া কথা ও সুর। যেন বা আমাদেরই একান্ত চেনা একান্ত কারও জীবনগাথা। বেদনার এতোটা হৃদয়স্পর্শী কন্ঠের অধিকারী আজ আর নেই-ই প্রায়।

লেখার বেলাতেও আমার এমনই ধারণা। তবুও ভাবি – কেন যে লিখি ! কেন যে হৃদয় একটি ক্ষীণ সূত্রেই বাঁধে জীবনে আজন্মের সেই সে সনাতনলিপিকা – যেন সে প্রাগৈতিহাসিক সেই শিলালিপি-ই – জগতের তাবত লিখিয়েরা লিখেই যাচ্ছে – একই সূচিপত্রে – একই জন্ম জন্মান্তরের লিপিখানি ! একই মন্ত্রে একই যন্ত্রণায় গ্রন্থিত একটি সুখের মুখচ্ছবি ! সে সুখ দুঃখের মাঝেই লুকোনো ছলছলানো এক সুখের মুখ। বদলে যাওয়ার পরেও সেই মুখচ্ছবির গভীর সূক্ষাতিসূক্ষ মনোরৈখি। ছাপচিত্র রয়েই যায় – আদিম প্রায় জন্মসূত্রের মতো। তখন সেইখানে নতুন জন্ম আবার নতুন করে রচনা করে তারেই – তারেই – আমরা যারে জীবন নামে বইছি। যেন জীবন-বই। অফুরান জীবন-বই। মরণের পরেও কেউ পড়বে বলে।

প্রতিটি পৃষ্ঠাভর্তি জীবন-এর মুদ্রণ – মেধা ও মনন এর – সে এক অন্যতর ছাপাখানায় শব্দে-নিঃশব্দে-নির্জনে মুদ্রণের অন্যরকম ঘটাং-ঘটাং – কিছুটা সম্পূর্ণ। কিছু আধখেঁচড়া কিছু অনিশ্চয়তাময় টানাপড়েনের ভিতর ভ্রূণাহত – কিছুটা স্পষ্ট-অস্পষ্টতায় জখমিত মেঘের মতো। তবুও সেই যোজন দূরের মেঘলা শূণ্যাকাশ হতেই তার আলোকবার্তা কোনও না কোনওভাবে এসে পড়েই এই জীবন্তলোকে। তখনই অন্ধকারের বিবর ভেদ করার শব্দ কি নৈঃশব্দের গাঢ় কথামালারা কারও করস্পর্শমাত্র অাঙুলে বর্ণময় ছবি ও গান অথবা গল্প-কবিতা হয়। শিল্পের ছোঁয়া পায়না যারা – তারাও যাপিত জীবন ছুঁয়ে আকাশভর্তি সূর্য-তারার অস্তিত্বের সঘন বোধনে জারিত হয়ে জীবনে প্রিয়জনের প্রেমান্ধ গভীরতা – পারস্পরিক সম্পর্কের অসীম মায়াবী বৃত্তের টানে একটি বেঁচে থাকার সুখদুখের ভিতর টের পায় যে – এ জীবন অসীম। তার টানেই সমস্ত সসীম ধাবমান। ধাবমানতা মানেই জীবন। জীবনের অনেক মানেহীন হীনতা, দীনতা অনেক অর্থহীন হানাহানির পরেও জীবন-এর মানেটি সুন্দরের দিকেই বহমান। অসুন্দরও অনেক থাকে জীবনে। সমস্ত নিয়েই জীবন।

যখনই জীবন থামে, তখন অন্যজীবন। অর্থাৎ অনন্তের যাত্রার শুরু হয়তো। হয়তো-ই। কেননা, সেই অনন্ত জীবন ক্যামন সেটি আমরা কেউ জানিনা। ধর্মগ্রন্থের অবশ্য সেই অনন্ত জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধর্মভেদে একেক রকমের বর্ণনা। বেহেশত কিংবা স্বর্গের বাসভূম-এর সুন্দর চিত্রায়ন। যতক্ষণ না সেইখানে যাওয়া সেই অচিনলোকে – ততক্ষণই বর্ণিত অধ্যায় বর্ণনাই কেবল। মর্ত্যবাসি কেবল বর্ণিত অধ্যায়পাঠে ভাবে – এবঙ ভাবে। তথাপি অচিন ক্যামন বোঝা যায়না। জীবিতের সেথায় যাওয়াটি জীবন্ত সম্ভব না। মৃতই হয়তো জানতে পায় – ক্যামন সেই স্বর্গ-নরক / বেহেশত-দোজখ।

কিন্তু জীবন হতে পাওয়া স্বর্গ-নরক / বেহেশত-দোজখ-এর অভিজ্ঞা / চিত্রকল্প জগতে শিল্পী আঁকেন। লেখকরা লেখেন। গীতিকার বাণীতে লিপিবদ্ধ করেন। সুরকার স্বরলিপিতে তুলে ছড়িয়ে দেন সুরের ব্যাঞ্জনায় । সাধারণরা মনে রাখে কি রাখেনা তা সময়কাল হতে একসময় ইতিহাসকাল হিসেবে কালেগর্ভে ভেসে যাওয়া কথামালাসূত্রে পাওয়া যায়। এবঙ সাধারণদের চালায় যারা তাদের মাঝে হয়তো হাতেগোণা গুটিকয়েকজন কীর্তিমানরা ছাড়া বাকীরা যা-যা করেন, করছেন এবঙ করবেন … তারও রূপরেখা খতিয়ে আগামীর চালিকাশক্তি মঙ্গলের না অমঙ্গলের তার হয়তো কিঞ্চিত আঁচ করাও যায়। যায়না কেবল মরণসাগরের ভাঁজে কি অগ্নিবীণা লুকিয়ে অাছে – তারেই ধরা। চিরকালের অধরা সে।

ভাবছি – আজ কি জগত জুড়ে যে শুভ-অশুভর লড়াই – তার কি জিৎ না পরাজয়? আমরা যারা অাজও প্রিয় অধরা ধরবার অাশালতায় জল ঢেলেই যাচ্ছি – সে কার ভরসায়? সে কোন অচিন ভালোবাসায়? সে কি স্বপ্নের জোর খাটিয়ে অশুভকে হটিয়ে শুভকে জিতিয়ে দিতে পারেনা? পারে কি পারেনা তার শুরু তো হোক – হোক সে যতই তুচ্ছাতিতুচ্ছ অামি – অামিও পারি – …পারি না ? আজ হতেই তবে শুরুর এক সামান্য প্রয়াস আমার – এর শেষের ভার রইলো সকলের হাতেই। শেষ না হওয়াতক কারও থেমে যাওয়া চলবেনা, যতক্ষণ না অমঙ্গল হটতে থাকে পিছনপানে। যতক্ষণ না মঙ্গলের জয়বার্তা আসে … ততক্ষণই কিন্তু মরণ ধরে রাখতে হবে সবার সুখদুখের সম্পর্কে …আজ আমার এই চাওয়া মরণের কাছেও। কবিগুরু যদিও রচেছেন ভানুসিংহের পদাবলীতে –

"মরণরে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান"

অামার তেমন সাধ / সাধনা নাই – হাড়ের ক্ষয়ে যাবার বিন্দুবিন্দু সিন্ধুসমান ডাক শুনতে পাই। পাঁজরে তারেই বেঁধেছি – যেন সেই সে গান –

"তুমি অাজ কত দূরে " -র গভীরতম ডাকের মতো গভীর। সম্পর্কের সূতোয়। সে যেন ছিঁড়ে না যায়। সে যেন না হারায় দূরের নাক্ষত্রিক শুকতারায়।

১৪২১ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।