১৯৬৯। আমি তখন নবম শ্রেণী। আমাদের শহর কুমিল্লা তখন মিছিলের শহর। রোজই প্রধান সড়ক ঘুরে ছাত্র নেতা-নেত্রীর ডাকে মিছিলে সামিল হাজার ছাত্রজনতার দল। রোজই আন্দোলনের জোয়ারে স্কুল-কলেজে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠছে জোরে। এমন একদিনের কথা লিখতে বসেছি – তখন সবে শ্রেণীপাঠের প্রথম ঘন্টা চলছে … হঠাৎ
বিশাল এক মিছিল নিয়ে তখনকার আমাদের শহর কুমিল্লা-র ছাত্রনেতা – শিবনারায়ণদা', বাকের ভাই , মিতিল আপা সদলে ঢুকে পড়লেন আমাদের শৈলরাণী উচচ বালিকা বিদ্যালয়ে .. ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিলো মিছিলকারীর কেউ .. কে আর ক্লাশে রইবে বসে! অমনি বেশ মহানন্দে বইখাতা ও ব্যাগ গুছিয়ে বাড়িমুখো আমরা ..
কিন্তু না, ছাত্রনেতা-নেত্রীর তেজালো আহবান –
"প্রিয় বোনেরা বাড়ি যেওনা কেউ। এখন ঘরে বসে থাকার দিন না। এখন দাবী আদায়ের , মিছিলে যোগ দেবার দিন। বোনেরা, তোমরা বেরিয়ে এসো। মিছিলে এসো। সবাই হাত ওঠাও … সবাই জোরসে বলো ..
" জয়বাংলা।"
আশ্চর্যের যা – তা এই যে – একসময় আমি নিজেকে মিছিলের বিশাল সারির ভিতর আবিষ্কার করি .. ! আমিও জোর গলায় সকলের সনে গলা মিলিয়ে উচচারণ করছি – উত্তেজনার জোরালোকন্ঠে – সেই শ্লোগান – রক্ত জাগানো, পাঁজরজাগা –
"জয়বাংলা।"
সেই আমার প্রথম মিছিলে যোগদান .. আজও তার স্মৃতিটি অমলিন একটি জলছবিরূপে জাগায় আমাকে .. সজল হৃদিচোখ মেলে দেখি সেই সৃতিউত্তাল দিন .. কি অমল দৃপ্ত পদচারণার দিন .. চোখ ভিজে যায় স্বপ্নমালায় .. মন ভেসে যায় বঙ্গোপসাগরধারায় .. ইচ্ছেডানায় ওড়ে আজও সেই অজর মুক্তির শ্লোগান –
"জয়বাংলা।"
অই শ্লোগান তখন জাগিয়েছিলো এদেশের সাড়ে-সাতকোটি মুক্তিকামী বাঙালি প্রাণ। জনসমদ্রে উঠেছিলো উথাল প্রাণের জোয়ার .. প্রাণপ্রিয় কান্ডারী একজন বজ্রকন্ঠের অধিকারী – বাংলাদেশ-এর স্বপ্নদ্রষ্টা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর মহান নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিসেনারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধজয়ের পতাকা ওড়ায় .. পরাধীন একটি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন সেদিন হতে থামেনি আর। আকাশছোঁয়া সেই স্বপ্নকে সত্য করেই ছেড়েছিলো মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে – বাংলা মাকে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুমুক্ত – "বাংলাদেশ" নামের রাষ্ট্রজন্ম ঘটিয়ে দিয়েছিলো একাত্তুরের ১৬-ই ডিসেম্বরে। পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তারা পরাজয় মেনেছে অবশেষে। নয়মাসের রক্তজলের ঐতিহাসিক সেই অর্জন বিশ্বকে দিয়েছে তাক লাগিয়ে। বিশ্ব জেনেছে একজন মহানায়ক এর নেতৃত্ব কত সুবিস্ময়ের রাষ্ট্রজন্ম ঘটাতে পারে। কেবলমাত্র মন্ত্রসম একটি শ্লোগান –
"জয়বাংলা"
আহ পাকিস্তানের ভিত্তি কাঁপিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর সূর্য খচিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছিলো – অই
"জয়বাংলা"
বলতে আজও গর্বে হৃদয়ে ওড়ে ।বাংলাদেশের পতাকা – সবুজের ভিতরে লাল সূর্যখচিত পতাকার বিজয় উপাখ্যান রচিত হয় – ঐতিহাসিক মূল্যমানে। একাত্তুরের বীর ও বীরাঙ্গনাদের মহতি আত্মত্যাগের ইতিহাস অনেক রক্তজলের গর্বিত ইতিহাস। অবিসম্বাদিত নেতা – বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বের জোরেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে –
"জয়বাংলা"
বলে হাজার-হাজার বীরের প্রাণ। লক্ষলক্ষ মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথার নাম – বাংলাদেশ। আজও স্মৃতিঅম্লান একাত্তুর এবঙ মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের দিনগুলি – জ্বলন্ত – শঙ্কিত – হাজার দিনরাত্রি – ভুলিনা – ভুলবোনা – এমন জয়গাথা কি করে ভুলি? সে এক অতন্দ্র বাংলাগাথা – ঠাঁই হয়েছে জয়ী একটি স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ইতিহাসের প্রতীক রূপে বিশ্বের মানচিত্রে। মহান নেতা ও জাতির পিতা কবিগুরুর গান –
"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"
হৃদয়জাগা গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করার মাধ্যমে দিলেন আরও অধিক প্রিয় আসনখানি। আমরা কি কোনওভাবেই জাতির ইতিহাস কলঙ্কিত করতে পারি?
পারিনা। ইতিহাসের অবমাননাকারীদের, বঙ্গবন্ধুহত্যাকারীদের, রাজাকার-যুদ্ধপরাধীদের, ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার চাই।
অতঃপর চল্লিশ-চল্লিশ বর্ষের যত অন্যায়-অপালনে আমাদের সহস্র দিন গেছে অশনিময়তায় .. আজও অপরাধীরা যারা লুকিয়ে পলাতক অাসামী হয়ে মিথ্যাচারের পারাকাষ্ঠা দেখায় – তাদেরও বিচার চাই। অাজও আমাদের চারপাশে হাজার সঙ্কট .. হাজার অশনিজাল। এই এতটা বর্ষ পরেও কি আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে তার ঐতিহাসিক জয়ের ধারায় তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল সূর্যালোকে হেসে উঠতে দেখবোনা ! হৃদি বলে, দেখবো .. নিশ্চয় দেখবো। এদেশের বাঙালি বীর বাঙালি। এদেশের জাতির পিতা সহস্র বর্ষের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। যিনি পরাধীন জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনায় পরিচালিত করে বিশ্বমানচিত্রে ঠাঁই করে দিয়েছেন, দিয়েছেন সূর্যখচিত পতাকার অধিকার, আজ সময় হয়েছে আবার সেই চির সমুজ্জ্বল স্বাধীনতার মর্মবাণী পুনরায় সবার মনে শিকড়সম চারিয়ে দিয়ে রোজ তাতে জল ঢেলে পনরুজ্জীবিত করার। যাতে সে বৃক্ষ হয়। যাতে সে শাখাপল্লবে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। আমরা যেন শিকড়জাত রক্তক্ষরা মুক্তির গান মুক্তির দিনলিপি মনে রাখি ও লিখি তাদের কথা .. অজর জলছবিদের রোজই জানাই সালাম। যাঁরা এদেশে স্বাধীনতার জয়োধ্বনিতে জ্বেলে দিয়েছে অশ্রুজলের জয়গান। জ্বেলেছে বাংলাদেশ-এর শিখা-চিরন্তন। আমরা যেন আগামীর হৃদয় জুড়ে জ্বালিয়ে যেতে পারি তারই শিখাময়-আভাময় জ্বলন্ত শিকড়ের সহস্র জলছবির দিনলিপি .. আমরা যেন – "জয়বাংলা" – শ্লোগানটির ঐতিহাসিক সত্য সন্তানদের কাছে সঠিক তুলে ধরতে পারি – আমার আজকের চাওয়া এই।
১৪২১ বঙ্গাব্দ।।
২০১৪ ইং।।